পিকে অবশ্যই নিষিদ্ধ হওয়া উচিত...

Updated By: Jan 5, 2015, 06:44 PM IST

সোমনাথ মিত্র

"পিকে হো কেয়া?" পিকে দেখার পর একটা সিদে প্রশ্ন বারবার মাথায় ঘুরছিল, বাস্তবে পিকে কারা? বোকা বোকা প্রশ্ন করে সমাজের ভুলগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় তাঁরা পিকে! না কি ভুলকেই আঁকড়ে দিনের পর দিন ফুলেফেঁপে ওঠা কিছু ভুঁইফোড়! না কি কোমরে, হাতে, আঙুলে মাদুলি-তাবিজ-আংটিতে আবৃত ভীরু সাধারণ মানুষ! সত্যি এ 'গোলা মে বহত কনফিউজ হে'।     

জুলাইয়ের শেষে পিকের প্রথম পোস্টার প্রকাশ পায়। সেখান থেকেই শুরু হয় বিতর্ক। সিকিভাগ ঢাকা নগ্ন শরীরে আমিরের পোস্টার হৈ হৈ পড়ে গিয়েছিল কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর।

তারপর প্রায় পাঁচ মাস বাদে রিলিজ হল পিকে। কিন্তু বিতর্ক ফিকে হয়নি। রিলিজ হওয়ার পর বিতর্ক ১৮০ ডিগ্রি টার্ন নেয়। ধর্মের সোঁদা গন্ধ খুঁজে পায় দুঁদে রাজনীতিবিদরা। কেউ কেউ বলছেন পিকে ভারতের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত হেনেছে। নিষিদ্ধ করে দেওয়া হোক পিকে কে। তবে কয়েকটি কারণ খুঁজে বার করা গেছে 'পিকে'-কে নিষিদ্ধ করার জন্য-----

১. ভিন গ্রহের মানুষ-

এলিয়েনের অস্তিত্ব এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করতে পারেননি। তাঁরা বিভিন্ন গ্রহের তাঁবু ফেলে দিনরাত এক করেও এতদিনে একপিস এলিয়েন ধরে আনতে পারেননি।  অতএব ভিনগ্রহ থেকে 'পিকে' এসে ছয় ঘন্টায় ভোজপুরি ভাষা শিখে আমাদের জীবনযাত্রা নিয়ে উঙলি করবে এটা মেনে নেওয়া যায় না। প্রথমত রেশন কার্ড নেই। ভোটার লিস্টে নামও নেই। তাই তাঁর উপদেশ আমাদের দেশে সাংবিধানিকভাবে গ্রহণ করা যায় না। কিন্তু আমাদের কোথাও মনে হয়েছে  পিকেও 'রং নম্বর' করেছে। কারণ বিজেপি নেতা সুব্রহ্মনম স্বামী এক চান্সে ধরে ফেলেছেন 'পিকে'র সঙ্গে আইসিস জঙ্গির হাত আছে। আর হ্যাঁ, হাত বলতেই মনে পড়ে গেল সুব্রহ্মনম স্বামী নিশ্চই 'পিকে'র হাত ধরে তাঁর সব মনের কথা পড়ে নিয়েছেন।

আমাদের 'গোলে' ভগবান কুড়ি, একশো, পাঁচশো টাকায় বিক্রি হোক তো পিকের কি এসে যায়। দাম দস্তুর করে ভগবানকে আরও কম টাকায় বাড়িতে এনে প্রতিষ্ঠা করতেই পারি। যেমন দাম ভগবানের তেমন কাম! যদি আমাদের বড় চাওয়া পাওয়া থাকে তাহলে পনেরো টাকার ভগবানের কিছু করার নেই। আকাশচুম্বী মন্দিরে সোনায় মোড়া যে ভগবান বিরাজমান যেখানে গোটা একশো টাকা আর নারকেল না দিলে তিনি প্রসন্ন হবেন না। ভগবানের সঙ্গে এমন 'লেনদেন' যদি ভিন গ্রহের মানুষ জেনে যায়, তাহলে আমাদের লজ্জার শেষ থাকবে না। 'বুদ্ধিমান' মানুষের এই অপকর্মের কথা জেনে গেলে অন্য গ্রহের মানুষের কাছে মুখ দেখাতে পারব আমরা (যদি কোনও দিন দেখা হয়)! অতএব  এই মুহূর্তে পিকে কে নিষিদ্ধ করা উচিত।

২. 'দৃশ্য দূষণ' -
পিকে রিলিজ হওয়ার পর থেকেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সেন্সর বোর্ডের কাছে বারংবার দাবি জানিয়েছে সিনেমা থেকে কিছু দৃশ্য  বাদ দেওয়ার জন্য। বেশ কিছু দৃশ্য নাকি ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত হেনেছে। তাঁদের মতে সানি লিওয়নের সিনেমার থেকেও বেশি দৃশ্যদূষণ করছে এই সিনেমা। সত্যিই তো আমাদের দেশ ধর্মপ্রাণ দেশ। আর সেই দেশের ধর্মকে নিয়ে 'কুরুচিকর' মন্তব্য করবে এ মেনে নেওয়া যায় না। আমরা মেনে নিতে পারি কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতির 'সু-মন্তব্য'। আমরা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কার্যকরী সভাপতি প্রবীণ তোগাড়িয়া 'দুরদৃষ্টি'র পরিচয় দেখে মুগ্ধ হতে পারি।
কিন্তু ভিনগ্রহের প্রাণী 'ধর্মের নামে বজ্জাতি'কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে, একজন 'মানুষ' হিসাবে কি করে সহ্য করা যায়! কুসংস্কার এ দেশের ভবিষ্যত! মাদুলি, তাবিজ, আংটি আমাদের শিল্প। আমরা ধর্মকে রক্ষা করার জন্য নিস্পাপ শিশুর রক্তে হোলি খেলতে পারি। ধর্মের নাম করে নারীর শ্লীলতাহানি করতে পারি। ভগবানের কাছে পৌঁছানোর জন্য আমাদের এতবড় শিল্পের বিশাল প্রসার এক মুহূর্তে ধ্বংস করবে এই 'পিকে'! এটা কখনও মেনে নেওয়া যায় না।

৩. চুমুর দিব্যি-
 
ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচ ছাড়া দুই দেশের কথাবার্তা চলে বন্দুকের নলে। সেখানে ঠোঁটে ঠোঁট রেখে দুটি দেশকে এক বন্ধনীতে বেঁধে রাখার স্পর্দা কতখানি হজম করতে পারবেন 'রং নম্বর' ধর্মরক্ষকরা এ নিয়ে সন্দেহ আছে।  

পিকে সিনেমার বিষয়বস্তু  দেশ, ধর্ম, বর্ণের বেড়াজাল পেরিয়ে মানুষই শেষ কথা। একটা দেশ ভরসা করে আরএকটা দেশের কাঁধে মাথা রেখে দিব্যি ঘুমাতে পারবে। প্রতিহিংসার লেশমাত্র থাকবে না। কিন্তু 'রং নম্বর' ধর্মরক্ষকদের কাছে এই তত্ত্ব নতুন মনে হলে  গীতা, বাইবেল, কোরাণের মতো পবিত্র গ্রন্থর জ্ঞান তাঁদের কাছ থেকে কয়েক হাজার আলোকবর্ষ দূরে, পান চিবাতে চিবাতে বুঝিয়ে দিয়েছিল পিকে। আবার পিকেকেও এক চড়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন জগ্গুর বাবা, "ধরমকে মামলোমে সাওয়াল নেহি উঠাতে। এ বিশ্বাস কি বাত হে।"  

৪. রং নম্বর -
পিকে 'রং নম্বর হে'। দিল্লি, মুম্বই, আমদাবাদ, লখনউ, ভোপাল, এলাহাবাদ, আগ্রা, বরেলি, রাঁচি, শিলচর - সর্বত্র পিকে-র বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে সংঘ পরিবারের বিভিন্ন শাখা সংগঠন। ছেঁড়া হচ্ছে পোস্টার, পুড়ছে আমির খানের কুশপুতুল। চলছে সিনেমা হলে ভাঙচুর।

পিকে এক জায়গায় বলেছিল "য ডর গয়া ও মন্দির যায়েগা"। এই কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করবে, যে এইসময় মাধ্যমিকের প্রস্তুতি নিচ্ছে। যতক্ষন না ভগবানের নিমোনিয়া হচ্ছে তাঁর মাথায় জল ঢেলেই যাই। সত্যি ভয় মানুষকে দিশেহারা করে তোলে। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে, যা খুশি তাই করতে পারে। তাই কি করছে সংঘ পরিবারের বিভিন্ন শাখা! কীসের ভয়ে? তাঁদের 'রং নম্বর' ধর্ম এতই ঠুনকো! যদি ধর্ম এতই ঠুনকো হয় তাহলে পিকে নিষিদ্ধ হওয়া উচিত।

৫. সিক্স প্যাক না সিক্স সেনস!

পিকে সিনেমায় আমির খান কী কারণে নগ্ন হয়েছিলেন, এই কৌতূহল বোধ করি ১০০ কোটি জনগণের মধ্যে উঁকি মারচ্ছিল। বিতর্কের ঝড় উঠেছিল আমিরের প্রথম পোস্টার প্রকাশেই । ভারতীয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচরন এই পোস্টার।  আমির খানের সুন্দর গঠনশৈলী নগ্ন সিক্স প্যাক সবথেকে বড় আকর্ষণ ছিল এই সিনেমায়।
কিন্তু পিকে সিক্স প্যাকের থেকে সিক্স সেনসের পরিচয় দিয়েছেন বারংবার। পিকের সোজাসাপটা প্রশ্নে হোঁচট খেয়েছে আমাদের সমাজ। জন্মের সময় ভগবান মানুষের পিছনে কোনও 'ধাপ্পা' বা স্ট্যাম্প না দিলে হিন্দু, মুসলিম, খ্রীষ্টান বুঝব কি করে? ভগবানের আর্শিবাদ পাওয়ার জন্য বারবার রং নম্বর হতে হয় কেন? কন্ডোম যদি ভারতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তাহলে বিষয়টাকে আমরা সোজাভাবে নিই না কেন?
কিন্তু প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা...। যাই হোক আমরা আপাদমস্তক 'ধর্মনিরপেক্ষ', সংস্কৃতিবান, নিয়মানুবর্ত সুশীলসমাজ। নাম-গোত্রহীন নগ্ন পিককে আমরা কখনও মেনে নিতে পারি না। সেন্সর বোর্ডের কাছে বিনীত নিবেদন পিকের নগ্ন দৃশ্য বাদ দেওয়া হোক। শেষে একটা তথ্য দিয়ে রাখি ভারতে গত দু বছর ধরে গুগল সার্চে নীল ছবি দেখার ক্ষেত্রে আমাদের দেশ কিন্তু এক্কেবারে প্রথম সারিতে...(যদিও এই লেখার উদ্দেশ্য নীল ছবি দেখার বিরোধিতা নয়, শুধু একটা পরিসংখ্যান পেশ করা)।

এই হল কয়েকটি কারণ যা পিকেকে নিষিদ্ধ করার 'যথাযথ' যুক্তি। তবে পিকে দেখার সময় একটা জিনিস মনে হয়েছে পিকের প্রশ্নগুলো আমরাও ছোটোবেলায় বাবার কাছে কোনো না কোনও সময় করেছি। ধর্ম কখনও 'রং নম্বর' দেখায় না। সঠিক মার্গ দেখায়। ধর্মের উপরে মানুষ সত্য অন্য গ্রহের মানুষ বুঝতে পারলেও আমরা কোনওদিন বুঝতে পারব না। তাই তো আড়াই ঘন্টা পিকে সিনেমা শেষ হওয়ার পরও হল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দেখতে পাবেন আরও একটি LIVE PK। শুধু চোখ কান খোলা রাখুন।

 

Tags:
.