বিশ্বজুড়ে পাড়ায় পাড়ায় জঙ্গিদাদের কোচিং সেন্টার চলছে!

Updated By: Jul 17, 2016, 09:53 PM IST
বিশ্বজুড়ে পাড়ায় পাড়ায় জঙ্গিদাদের কোচিং সেন্টার চলছে!

স্বরূপ দত্ত

জানি না, আপনি কোনওদিন পাড়ার কোনও 'দাদা'র কাছে টিউশন পড়তে গিয়েছেন কিনা। সাধারণত, আটের দশকের শেষ এবং নয়ের দশকের শুরু থেকেই আমাদের শহর, শহরতলি, গ্রামে পাড়ার দাদারা পড়ানো শুরু করলেন। সেই সময় মূলত লড়াইটা ছিল, স্কুলের স্যার বনাম পাড়ার দাদারা। কে বা কাঁরা বেশি ভালো পড়ান। কাঁর ছাত্ররা পরীক্ষায় বেশি ভালো ফল করে। স্কুলের পরীক্ষায় স্যারদের ছাত্ররাই বিভিন্ন বিষয়ে বেশি নম্বর পেত। আর মাধ্যমিক কিংবা উচ্চমাধ্যমিকে পাড়ার লাল্টুদা, বিল্টুদা, শিবুদা, শঙ্করদা, সৌমেন-দারাই বাঘ মারতেন!(আসল সাজেশন দাদাদের নাম দিব্যি মনে আছে, তবুও ইচ্ছে করে তাঁদের সম্মানার্থে কাল্পনিক নামের ব্যবহার করলাম)।

এরপর এক-দু'বছরের মধ্যেই চালু হয়ে গেল সাজেশন। এবার আর কে, কত ভালো পড়ান, সেটা আর মোটেই বিচার্য বিষয় থাকল না। কাঁর সাজেশন প্রশ্নপত্রের সঙ্গে হুবহু মিলে গেলে, সেই নিয়েই চলত পাড়ায় পাড়ায় দাদাদের 'ভাইরাল' হওয়ার দৌড়। অমুক দাদা-র বাড়িতে তখন ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী ছেলে-মেয়েদের ভিড় দেখলে মনে হত, নকশাল আমল হলে কী যে হত! আর ওই দাদার মা, বাবা, দিদি, বোন, ভাইদের তো মাটিতে পা-ই পড়ত না। তাঁদের ছেলে কিংবা ভাইয়ের কাছেই তো গোটা পাড়ার ছেলে-মেয়েরা শিক্ষিত হচ্ছে! আর অবশ্যই এই চ্যাপ্টারের আরেকটা কথা না বললে ভুল হবে। সেটা হল, এই দাদাদের বিজয়া দশমীর খাবার খাওয়ানোটা তোফা ছিল। এলাহি আয়োজন। আসলে ভালো খাওয়ালে, তবেই না নাম হবে। নুনের দাম আর কে কবে না দিয়ে পেরেছে!

একটা জিনিস তখনও খেয়াল করে দেখেছি, এখনও দেখি, এই যে দাদারা পড়ায় পাড়ায় পড়িয়ে এত নামডাক করা মানুষ হয়েছেন, ব্যক্তিগত জীবনে এই দাদাদের নিজেদের রেজাল্ট মারাত্মক ভালো তেমন কিছু ছিল না। (অবশ্যই ব্যতিক্রম আছে) তবে, বেশিরভাগ দাদারাই, নিজেরা ছিলেন মার্কসের বিচারে মিডিওকার। কিন্তু এঁরা তৈরি করতেন দুর্দান্ত সব ছাত্র। মানে, এই দাদাদের ছাত্ররা এমন সব নম্বর পাওয়া শুরু করল, যা তার পাড়ায় আগে কেউ কখনও পায়নি। অথবা তার পরিবারেও কেউ কখনও পায়নি। তাই এইসব দাদাদের সামাজিক প্রভাবও বাড়তে লাগলো। স্বাভাবিক তো। পাড়ার সবথেকে ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট যাঁর কাছে শিখে এত বড় মানুষ হয়ে উঠছে, তাঁকে তো বাড়তি সমীহ করবেনই পাড়ার কাকু, জেঠু, মোড়লরা।

এই সামাজিক মর্যাদাটা পাওয়ার পর থেকে ওই দাদাদেরও বলার অনেক কিছু বেশি হয়ে গেল জীবনে। এতদিন তাঁরা শুধু আর্টস, সায়েন্স বা কমার্স পড়িয়েই ক্ষান্ত থাকছিলেন। কিন্তু একটু নামডাকের প্রভাব তো তাঁদের মানসিকতাতেও পড়বে। তাই, তাঁরাও এবার থেকে ছাত্রদের বলতে লাগলেন অতিরিক্ত কিছু 'জ্ঞানের' কথা। আসলে মোটিভেশনাল টক বলতে পারেন। ভালো শিক্ষক হওয়ার সবথেকে বড় গুণ তো বোধহয় এটাই যে, ছাত্রকে প্রেরণা দেওয়া। সে যেন, যেকোনও কঠিন পরিস্থিতিতেই মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারে। ঠিক খারাপ অবস্থা থেকে নিজেকে বের করে আনতে পারে। ১৪ থেকে ১৮ বছরের কিশোরের বুকের আগুনকে সঠিকভাবে 'হাঁপড়ের' হাওয়া ভরে দেওয়াটাই তো শিক্ষকের কাজ। ওই বুকের বারুদের স্তুপে শুধু সপ্তাহে তিন দিন বা দুদিন একটু ফুঁ দিয়ে দিতে হবে। বাকিটা ছাত্ররা এমনিই পারবে।

আমার আগের প্রয়োজনীয় কথাগুলো বলা হয়ে গেল। এবার যে প্রসঙ্গে আসব বলে, এই কথাগুলো বললাম, সেই প্রসঙ্গে ঢুকি। ইদানিং, যেভাবে আইসিস এবং বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনগুলো মানুষ মারছে, তাতে ভয় লাগছে বইকি। অবাক করা ভয়। রোজ রোজ কত কত কথা শুনছি, পড়ছি, দেখছি। ভাবতে বসছি, কীভাবে একটা মানুষ একটা লড়ি নিয়ে একটা উত্সবের জায়গায় ঢুকে পড়ে ৮০ জনকে চাকার তলায় পিষে দিয়ে চলে গেল নিমেষে! কীভাবে বুকের মধ্যে বোম রেখে বিমানবন্দরে শুয়ে পড়ে নিজেই সেটাকে চেপে ফাটিয়ে দিল! নিজে তো মরলই, সঙ্গে শয়ে শয়ে জীবন শেষ! এক মুহূর্তে! আর এই বিষয়গুলোতেই শুনতে পারছি যে, এখন নাকি জঙ্গিদের 'মোটিভেট' করা হচ্ছে! তার মানে, আসলে এটাও সেই জঙ্গি সংগঠনের দাদাদের কাজ! (আমার কথা আমার মতো করেই বুঝবেন প্লিজ। পাড়ার দাদাদের সঙ্গে একেবারেই তুলনা করা হচ্ছে না। তাঁরা অনেক মানুষের জীবন গড়েছেন। এভাবে মানুষ মারতে শেখাননি)।

জঙ্গি সংগঠনের দাদারাই নতুন জঙ্গিদের দলে টেনে এভাবে মোটিভেট করছেন! আরে বাপ রে বাপ! এ কী মানের মোটিভেটর! কী এমন মন্ত্র দিচ্ছে তারা তাদের তথাকথিত ছাত্রকে? যে, সেই ছাত্র গুরুর কথা অক্ষরে-অক্ষরে পালন করে ঢুকে পড়ছে জনবহুল এলাকায় আর কালিপটকার মতো বোম কিংবা গুলি ছুঁড়ছে! একজন মানুষকে, আরেকজন মানুষকে হত্যা করার প্রেরণা দেওয়া এত সহজ কাজ নাকি? আমি পারবো আপনাকে বলে অন্য মানুষকে খুন করাতে? আপনি পারবেন অন্য কাউকে বুঝিয়ে, আর একজনকে খুন করতে! অথচ, এই 'জঙ্গি-দারা' তো দিব্যি সেটাই করে ফেলেছে! এবং এই জঙ্গিদাদের বিস্তার তো আমার আপনার পাড়া থেকে সারা বিশ্বেই! ছেলেবেলা থেকেই একটা কথা খুব শুনেছি। তা হলো, অপরাধীদের মস্তিষ্ক নাকি বেশি ধুর্ত হয়। এখন তো হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। এখন বিশ্বজুড়ে যদি সত্যিই সন্ত্রাসকে মুছে ফেলতে হয়, তাহলে বসতে হবে এই জঙ্গিদাদাদের সঙ্গেই। যাদের কোচিং সেন্টার থেকে এসব রত্ন বেরোচ্ছ প্রতিদিন, প্রতি মাস অথবা প্রতি বছরে। আর ওই জঙ্গিদাদেরই উল্টে মোটিভেট করতে হবে, মানুষ মারতে মোটিভেট করতে পারিস হতভাগা আর একটা মানুষকে জীবনে মানুষের মতো মানুষ গড়তে পারবি না? দেখতাম ওই জঙ্গিদারা এর উত্তরে কী বলে!

আরও পড়ুন প্রেম গোপন ভালো নাকি খুল্লামখুল্লা?

.