"সুনীল দা কেমন আছ?"

আজ তাঁর জন্মদিন। না, আজ আর তিনি দৈহিকভাবে আমাদের সঙ্গে নেই। তিনি আছেন আমাদের মননে, আমাদের চিন্তায়। আজ তাঁর জন্মদিনে একটা বিশেষ ঘটনা ঘটল। তাঁরই লেখা তৈরি চরিত্র নীললোহিতের চিঠি এল সুনীল গাঙ্গুলির বাড়িতে। আসলে এত জীবন্ত লিখতে লিখতে নীলু কখন যে রক্ত মাংসের মানুষ হয়ে গিয়েছে সেটা আমাদের খেয়ালই নেই।

Updated By: Sep 7, 2013, 03:04 PM IST

পার্থ প্রতিম চন্দ্র

আজ তাঁর জন্মদিন। না, আজ আর তিনি দৈহিকভাবে আমাদের সঙ্গে নেই। তিনি আছেন আমাদের মননে, আমাদের চিন্তায়। আজ তাঁর জন্মদিনে একটা বিশেষ ঘটনা ঘটল। তাঁরই লেখা তৈরি চরিত্র নীললোহিতের চিঠি এল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে। আসলে এত জীবন্ত লিখতে লিখতে নীলু কখন যে রক্ত মাংসের মানুষ হয়ে গিয়েছে সেটা আমাদের খেয়ালই নেই।
সেই নীলুর চিঠি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে এমন একটা দিনে এল যেদিন তাঁর জন্মদিন। নীলু এমন একটা জায়গায় থাকে যেখানে এই পৃথিবীর কোনও খবর পৌঁছয় না। তাই নীলু জানেই না তাঁর সুনীল দা আর বেঁচে নেই।
নীলুর তাঁর সুনীল দাকে লেখা সেই চিঠিটাই আজ দেওয়া হল ২৪ ঘণ্টা ডট কম-এ। ঠিক যেভাবে নীলু লিখেছে সেভাবেই, কোনও রকম কাঁটছাঁট ছাড়াই সেই লেখা প্রকাশ করা হল।
প্রিয়, সুনীল দা

সুনীল দা, জানো আজ তোমায় নিয়ে একটা স্বপ্ন দেখলাম। তুমি সেই সাদা পাঞ্জাবিটা পরে আমাদের দিকশূন্যপুরে এসেছো। আর আমায় ঘুম থেকে তুলে বললে, ওঠো নীলু আমায় এক গ্লাস জল দে, খুব ক্লান্ত লাগছে। ঘুম চোখে দেখলাম কেমন একটা কুয়াশা ঘেরা পরিবেশে তুমি হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে হাত বাড়ালে। প্রথমে খুব ভাল লাগল, কতদিন তোমায় দেখিনি। একটু পরেই ভাললাগাটা বদলে গেল। তুমি এখানে কেন! দিকশূন্যপুরে কি তোমায় মানায়!
ঘুমের ঘোরটা কাটতেই বুঝতে পারলাম পুরোটাই একটা স্বপ্ন ছিল। তারপরই ঠিক করলাম তোমায় একটা চিঠি লিখি। তুমি তো জানোই ওসব চিঠি লেখা আমার ধাতেটাতে নেই, কিন্তু আজ মনে হল কলম ধরি। শুধু তোমার জন্য। শুধু তুমিই আমায় নিয়ে লিখে যাবে, সেটা তো হয় না, আমি ছাইপাশ যা পারি লিখব। তোমার মত সাহিত্য না হোক চিঠিতে।
হঠাত্‍ কেলেন্ডারটার দিকে চোখ গেল। বুঝতে পারলাম তুমি যেদিন আমার চিঠিটা পাবে সেদিন হয়তো তোমার জন্মদিনই হবে। দাঁড়াও একটু হিসাব করেনি... আজ তোমার ৮০ তম জন্মদিন, তাই না! জানি তুমি যেমন লোক তাতে জন্মদিনে কেকটেক কাটবে না। তবে তোমরা তো অনেক ভক্ত তারা তো পাঠাবেই। আচ্ছা, স্বাতী দি আজ পায়েস রান্না করেনি! ও দেখেছো, চিঠি লেখার কায়দাটাই শিখিনি। তাই ওসব বাজে কথা প্রথমেই বলতে শুরু করেছি।
আচ্ছা স্বাতী দি ভাল আছে তো! তোমার শরীরটা ভাল তো! তোমার জন্য খুব চিন্তা হয় জানো। আসলে তুমি তো শুধু একটা রক্ত মাংসের মানুষ নও, তুমি আমাদের কাছে তার চেয়েও অনেক অনেক কিছু।
দেখো না গতবছরই দিকশূন্যপুরে একটা ১৪-১৫ বছরের ছেলে এল। ও প্রথম প্রথম খুব কাঁদতো, তারপর দেখলাম হঠাত্‍ করে পাল্টে গেল। রহস্যটা জানতে আমি ওর কাছে গেলাম। ও কি বলল জানো! ও বলল, কাকাবাবু সিরিজের একটা গল্প পড়ে নাকি ও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। তোমার লেখা থেকে ও নাকি পরেছে.. একটা গল্পে কাকাবাবু-আর সন্তু মহাবিপদে পড়েছেন। দুজনের মৃত্যু শুধু সময়ের অপেক্ষা। এমন সময় সন্তু কাঁদতে শুরু করেছে। কাকাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, কাঁদলে কিছু হয় না রে সন্তু, কাঁদলে সমস্যার সমাধান হলে সবাই শুধু কেঁদে ভাসাত রে। বরং এটা ভাব সমস্যার সমাধানটা করবি কি করে।" ছেলেটাই বলল, শেষ অবধি কান্না ভুলে পরিকল্পনা করে সন্তুই নাকি কাকাবাবুকে বিপদ থেকে রক্ষা করে।
জানো তোমার লেখা ওই ছোট কতগুলো কথা ওকে এমনভাবে নাড়া দিয়েছে, যে ও আবার শহরে ফিরে গিয়েছে। আমায় বলে গিয়েছে, একদিন ও চাঁদে যাবেই, তাই নাসায় চাকরি পেতে ও দিনরাত এখন শুধু পরিশ্রম আর পড়াশোনা করবে। ভাবলাম এটাও সম্ভব! একটা গল্প এভাবে কাউকে বদলাতে পারে!
আরও একটা ঘটনা বলি শোনো। আমার ঠিক পাশেই এখন যে মধ্যবয়স্ক লোক উঠেছে। তার কথা শুনে তো আমি অবাক। ওদের পার্টির একটা মিটিংয়ে হঠাত্‍ রড, বোমা নিয়ে হামলা চালায় দুষ্কৃতীরা। লোকটা ওর দলের এক বৃদ্ধ কর্মীকে বাঁচাতে গিয়ে একটা গুন্ডাকে লাথি মারে। লাথির চোটে গুন্ডাটা মাটিতে পরে যেতেই,একটা লোহা মাথাটা ঠুকে যায়। মাথা থেকে প্রচুর রক্ত বেরিয়ে গুন্ডাটা ওখানেই মারা যায়। পার্টির সবাই তখন তাঁকে পালাতে বলেন। এরপরই অনেক অনেক পথ পেরিয়ে উনি চলে আসেন দিকশূন্যপুরে। যখন লোকটা প্রথম দেখেছিলাম খুব খারাপ লেগেছিল, সারাক্ষণ শুধু মাথা নিচু করে কাঁদাতো, আর বলত আমি একটা খুনি।
ওর সমস্যাগুলো শুনে আমাদের সেই লেখকবাবু, যার কথা তুমি তোমার অনেক বইতে লিখেছো, তিনি ওনাকে একটা বই পড়তে দিলেন। বইটার নাম `পূর্ব- পশ্চিম`। বইটা পড়ার পর লোকটা পুরো বদলে গেল। ক মাস আগে তিনিই আমায় বললেন, জানো নীলু তোমার সুনীল দা-র বইটা ভারি সুন্দর। বইটা আমায় অনেক কিছু শেখালো জানো। তুমি তো নিশ্চই পড়েছ বইটা। ভেবে দেখো গল্পটার অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র অতীনও তো সমাজের চোখে একটা খুনি, কিন্তু ছেলেটা আসলে কত ভাল। আমিও ঠিক করলাম নিজেকে দোষী ভেবে সময় নষ্ট করা অর্থহীন। তার চেয়ে অনেক ভাল জীবনের মানে খুঁজে বের করা।

তোমায় তো শুধু দুটো উদাহরণ দিলাম আমাদের দিকশূন্যপুরে আরও অনেকেই তোমার
লেখাকে নিয়ে বেঁচে আছে গো।

তোমায় একটা কথা কিছুতেই চেপে রাখতে পারছি না জানো। তুমিই বলেছিলে আমায়, "
জানিস, মনের কথা মুখে লোকানো যায়, কিন্তু একবার পেন ধরলে সব বেরিয়ে আসে রে।
পড়াশোনা জানা মানুষের মানুষের কাছে পেন নাকি অনেকটা অ্যালকোহলের মত...
একবার হাত নিয়ে ডুব দিলই সব কথা বেরিয়ে আসে।" সেটাই এখন হচ্ছে জানো।
আসলে গত বছর অক্টোবরের শেষের দিকে, কোন তারিখ সেটা খেয়াল নেই, ভোরবেলা একটা স্বপ্ন দেখলাম। একটা পাড়ার প্যান্ডেলে দুর্গাঠাকুরের পুজো চলছে। ঢাক বাজছে, মন্ত্র পড়া চলছে.. হঠাত্‍ কোথা থেকে পুজোর আনন্দ ছাপিয়ে তোমার মুখটা ভেসে এল। তুমি কেমনভাবে যেন ঘুমিয়ে আছো। দেখলাম তোমার বাড়ির সামনে অনেক লোক। স্বাতীদের কান্নার আওয়াজটাও পেলাম। আর শুনতে পেলাম গোটা শহরের দীর্ঘশ্বাস। স্বপ্নের মধ্যেই আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। এ আমি কি দেখছি। ওসব তো মানুষ মরে গেলে হয়। তুমি কি... না না তোমায় ওসব মৃত্যুটিত্যু মানায় না। সেদিন ঘুম থেকে উঠে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। তারপর সব ঝেড়ে ফেলে চোখ বন্ধ করে তোমায় দেখার চেষ্টা করলাম।
দেখলাম তুমি পেন-খাতা নিয়ে বসে লিখছো। খুব আশ্বস্ত হলাম। তবে খটকাও একটা থাকল জানো। দেখলাম তুমি যখন লিখছো, বাইরে তখন কান্নার শব্দ, আর অনেক লেখক কবির ভিড়। বাইরে একটা সাদা গাড়ি দাঁড়িয়ে। তবে আমি জানি, তুমি মরোনি, মরতে পারো না। তোমায় এখন অনেক লিখতে হবে, অনেক অনেক।
সেদিনের পর অবশ্য আর তোমার কথা সেভাবে ভাবিনি। তুমি তো জানোই ভাবাটাবা আমার সেভাবে আসে না। আর আমি ভাবতে চাইও না। আমি জানি তুমি বেঁচে আছো। আর আমার চিঠিটা পড়ে হাসছো। দেখছো তোমায় বলতে ভুলেই গেছি.. শুভ জন্মদিন। কেমন আছো অবশ্যই জানিও। তোমার চিঠির অপেক্ষায় রইলাম...

ইতি- নীলু
দিকশূন্যপুর
(নীলুটা বড় উদাসীন তাই জানে না গত বছর ২৩ অক্টোবর রাত ২.০৫ মিনিটে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে নিজের বাড়িতেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়৷ মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল৭৯ বছর৷)

.