রক্তে মাখা, গুলিতে ঠাসা, কাব্যে কুর্নিশ ওয়েস্টার্নকে

শময়িতা চক্রবর্তী *****ছবির শুরুতে ডঃ কিং শুলৎস মুক্তি দেওয়ার পরই স্লো একটা শটে দেখা যায় গায়ের দাসত্বের জীর্ণ চাদর ছুঁড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াল জ্যাঙ্গো। শৃঙ্খল-স্খলনের নিপুন ওয়েস্টার্নায়ন। এই ছবির প্রতিটি শটে ওয়েস্টার্নকে কুর্নিশ ঠুকেছেন পরিচালক। তবে ওয়েস্টার্ন গ্রামার দিয়েও ট্যারান্টিনো বাক্য রচনা করেছেন কিন্তু নিজের স্টাইলেই। ছড়িয়ে দিয়েছেন নিজস্ব তুলির টান।

Updated By: Mar 30, 2013, 05:34 PM IST

শময়িতা চক্রবর্তী
*****
"ডি-জে-এ-এন-জি-ও। ডি- সাইলেন্ট।" জ্যাঙ্গো 'দ্য ফ্রিম্যানে'র দুনিয়ায় আপনাকে স্বাগত। প্রথমেই বলে রাখি এই সিনেমা তৈল-ঢালা-স্নিগ্ধ-তনু বাঙালির দুর্বল চিত্তের জন্য নয়। ট্যারান্টিনো-সুলভ হিংসা, রক্তে মাখোমাখো স্টাইলে তৈরি এই সিনেমা স্প্যাগেটি ওয়েস্টার্নকে দেওয়া শ্রদ্ধার্ঘ। দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে স্ত্রীকে উদ্ধার করতে যাওয়ার ভয়াবহ অভিযান এই ছবি। পশ্চিম উপকূলের বর্ণবৈষম্যে দীর্ণ মাটিতে কালো মানুষ হয়ে ঘোড়ায় সওয়ার হওয়ার 'ধৃষ্টতা'র কাহিনি 'জ্যাঙ্গো আনচেইনড'। কোয়ান্টিন ট্যারান্টিনোর এর আগের ছবি ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডসে এক আমেরিকান জার্মানিতে গিয়ে 'ডয়েচ-ডেভিল' সংহার করেছিল। এবারের ছবিতে উলট-পুরান। জার্মান ক্রিতদাস প্রথা বিরোধী ডাক্তার কিং শুলৎজ 'ওয়ারলর্ড' আমেরিকান ক্যালভিন ক্যান্ডিকে সংহার করলেন এখানে। এ কি টারান্টিনোর পলিটিকালি কারেক্ট থাকতে চাওয়ার প্রয়াস? সে প্রশ্ন বরং থাক। শিল্পী নয়, চোখ ফেরানো যাক শিল্পের দিকে। ১৯৬২-র বিখ্যাত ওয়েস্টার্ন সিনেমা জ্যাঙ্গোকে এই ছবিতে কুর্নিশ জানিয়েছেন পরিচালক। ষাটের দশকের জ্যাঙ্গো, ফ্র্যাঙ্কো নেরোকেও ক্যামিওতে দেখা গিয়েছে এই ছবিতে।
এ যুগের জ্যাঙ্গোর গল্প শুরু ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দ। গৃহযুদ্ধের তখনও বছর দুয়েক বাকি। ক্রীতদাস এবং তাঁদের মালিক-বণিকেরা স্বমহিমায় বিরাজমান। দাঁতের চিকিৎসা ছেড়ে বাউন্টি হান্টার (সুপারি কিলার, যাঁরা পুলিসের থেকে 'সুপারি' নিয়ে অপরাধীদের নির্দ্বিধায় কোতল করে) হয়ে ওঠা ডাক্তার কিং শুলৎস (ক্রিস্তোফ ওয়ালৎস) মালিকের কাছ কিনে নেন জ্যাঙ্গোকে (জেমি ফক্স)। শর্ত, চিনিয়ে দিতে হবে অপরাধী ব্রিটল ভাইদের। দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে জ্যাঙ্গো তখন অভূতপূর্ব মুক্ত-কৃষ্ণাঙ্গ।
টাকার বিনিময়ে ব্রিটলদের তিন ভাই সহ পশ্চিম উপকূল জুড়ে দুষ্কৃতী দমনের দাদাগিরি যখন ছড়িয়ে পড়েছে তখনই হৃত স্ত্রী ব্রুমহিলডার (কেরি ওয়াশিংটন) খোঁজে ক্যান্ডিল্যান্ডে আসেন তাঁরা। জার্মান পুরানে ড্রাগনের গুহা থেকে ব্রুমহিলডাকে উদ্ধার করে তাঁর প্রেমিক। ক্যান্ডিল্যান্ড গুহাই বটে। দেখা হয় ড্রাগন-সদৃশ খেতমালিক কেলভিন ক্যান্ডির (লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও) সঙ্গে। ক্রীতদাসদের মল্লযুদ্ধে গ্যাল-গ্যাল রক্ত দেখা যাঁর ফেভারিট পাস-টাইম। কুস্তিতে জিততে থাকা যোদ্ধার হাতে সহযোদ্ধার খুলি ফাটানোর জন্য হাতুড়ি এগিয়ে দিয়ে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন, অথবা পালাতে চাওয়া ক্রীতদাসকে দিয়ে অবলিলায় বুভুক্ষু পোষ্য কুকুরদের খিদে মেটান। এহেন ড্রাগনিয়ান ক্যান্ডিম্যানের কবল থেকে ব্রুমহিলডাকে ফেরত আনতে কেটে যায় ছবির বাকি অংশ।
প্রতিটি চরিত্রই নিয়ম মেনে লার্জার দ্যান লাইফ। জেমি ফক্স প্রোটাগনিস্ট হলেও একটু পড়ে আসছি তাঁর অভিনয় প্রসঙ্গে। ইনগ্লোরিয়স বাস্টার্ডের ট্যারান্টিনোর আবিষ্কার ক্রিস্তোফ ওয়ালৎস। জ্যাঙ্গোতে ডঃ কিং শুলৎস। সামান্য মাংসপেশির সঞ্চার-সঙ্কোচনে, নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে, হাসিতে, এবং শেষের কয়েক পলকের নিপুণ রাগের অভিব্যক্তিতে মুগ্ধ করেছেন ওয়ালৎস। তাঁর স্ক্রিন প্রেসেন্সের প্রত্যেকটা মুহূর্ত ম্যাজিকাল, বিস্ময়কর। জার্মানভাষীর ইংরেজিতে কৌতুক, ব্যাঙ্গ, বিদগ্ধ ডায়লগ ততখানিই আকর্ষণীয়, ঠিক যতটা প্রয়োজন।
ভাল লাগবে নায়কের চরিত্রে জ্যাঙ্গোকেও। মালিকহীন মুক্ত কালো মানুষের জীবনের সম্ভবত প্রথম বিয়র ঠোঁট ছুঁয়ে যাওয়ার হাসি দিয়ে শুরু আর যুদ্ধ ক্ষেত্রে ফিরে এসে মুক্তিদাতার নিথর কপালে চুমুর চিহ্ন এঁকে দিয়ে ফিরে যাওয়ায় শেষ হয় জ্যাঙ্গোর জার্নি। তবে প্রতি মুহূর্তে ওয়ালৎসের ফ্ল্যামবয়েন্ট ঝলকানিতে অজান্তেই ম্লান হয়েছেন জেমি।

ছবিতে ৩৮ বছরের ডিক্যাপ্রিও একজন বর্ধিষ্ণু কিন্তু অমানবিক দক্ষিণী জমিদারের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। লিওনার্দো শুরুর দিকে চরিত্রটিকে সামান্য নমনীয় করতে চেয়েছিলেন। পরে সহ অভিনেতা স্যামুয়েল জ্যাকসন এবং জেমি ফক্স তাঁকে ওই চরিত্রিটিতেই অভিনয় করাতে রাজি করান। মাস্টারস্ট্রোক? পৈশাচিক হাসি মুখে অস্ফুট ব্যাঙ্গে উচ্চারণ 'কিল হিম'। আক্ষরিক অর্থেই শিরদাঁড়া দিয়ে হিমস্রোত বইয়ে দেয়।
ব্রুমহিলডার চরিত্রে কেরি ওয়াশিংটন আরেকটু বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার চেষ্টা করতে পারতেন। জার্মান ভাষা বলতে পাড়া অনন্য কালো দাসের ক্যারিসমা কম পড়েছে মনে হল তাঁকে দেখে। তবে অসাধরণ স্যামুয়েল জ্যাকসন। দশক পেড়িয়ে দাসত্বের শৃঙ্খল না পড়ার অভিনয় করতে করতে জ্যাঙ্গো দ্য ফ্রিম্যানকে দেখে তাঁর চোখে ঈর্ষার ঝলসানি। মালিকের কাছাকাছি পৌঁছিয়েও, তাঁর পাশে বসে ব্র্যান্ডিতে চুমুক দিয়েও যে সে মুক্ত মানুষ নয় একথা তাঁকে বিলক্ষণ জানান দেয় জ্যাঙ্গোর উপস্থিতি। আর সেই কারণেই প্রভুর প্রতি প্রবল আস্থা জ্ঞাপনের অছিলায়, মধ্যে লুকিয়ে থাকা ঈর্ষার সবুজ রঙ ঝিলিক দেয় তাঁর চোখে।
সিনেমা জুড়ে রিচার্ড রবিনসনের অসাধারণ সিনেম্যাটোগ্রাফি। রুক্ষ, উষ্ণ, রক্ষণশীল আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের অপূর্ব চিত্রায়ন। পশুপালের মতো স্লথ ছন্দে হেঁটে চলা কালো মানুষের অক্লান্ত মিছিল, নিষ্পাপ-সৌম্যদর্শন পশুপালক কেলভিন ক্যান্ডির ভয়ঙ্কর খামার বাড়ি আর উল্লেখযোগ্য ভাবে হাল্কা সাদা পেঁজা তুলোর উপর ঝামরে পড়া রক্তের ছিটের দৃশ্য ভোলা যায় না।
ছবির শুরুতে ডঃ কিং শুলৎস মুক্তি দেওয়ার পরই স্লো একটা শটে দেখা যায় গায়ের দাসত্বের জীর্ণ চাদর ছুঁড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াল জ্যাঙ্গো। শৃঙ্খল-স্খলনের নিপুন ওয়েস্টার্নায়ন। এই ছবির প্রতিটি শটে ওয়েস্টার্নকে কুর্নিশ ঠুকেছেন পরিচালক। তবে ওয়েস্টার্ন গ্রামার দিয়েও ট্যারান্টিনো বাক্য রচনা করেছেন কিন্তু নিজের স্টাইলেই। ছড়িয়ে দিয়েছেন নিজস্ব তুলির টান। ডায়লগের ছত্রে ছত্রে তুখোর বুদ্ধিদীপ্ত ঝলকানি, গল্পের ঠাস বুনোন এবং অসাধারণ স্টাইল। অস্কারে সেরা ছবি আরগো নিয়ে যতই রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর অভিযোগ উঠুক, কোয়ান্টিন টারান্টিনো ছাড়া সেরা অরিজিনাল স্ক্রিনপ্লের স্বর্ণমানব অন্য কেউ পেতে পারত না, একথা বাজি রেখে বলা যায়।
নির্দিষ্ট সময়ে ছবি শেষ হল। থেকে গেল নৃশংস ভাললাগার রেশ...

.