হীরক জয়ন্তীতে রুপোলি পর্দায় সোনার স্বপ্নগুচ্ছ

এক্সিট ডোর দিয়ে পিল পিল করে বেরোচ্ছে দর্শক। ঘেঁটে যাওয়া কাজল-মাসকারা, স্বপ্নে বিভোর চোখে লেগে থাকা আস্ত বলিউড নিয়ে যেন বেরোলেন সবাই। ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো-তে স্বচক্ষে দেখা ভিড়। করণ জোহর, দিবাকর ব্যানার্জি, জোয়া আখতার, অনুরাগ কাশ্যপ পরিচালক-চতুষ্টয় যেভাবে অলিগলি, বস্তি, ফুটপাথ, উচ্চমধ্যবিত্তের চার দেওয়াল, শিশুর স্বপ্নের আনাচকানাচ থেকে বলিউডকে কুড়িয়ে এনে কোলাজ বানালেন, এক কথায় অবিস্মরণীয়!

Updated By: May 3, 2013, 06:41 PM IST

শর্মিলা মাইতি

ছবির নাম- বম্বে টকিজ
রেটিং- ****1/2
এক্সিট ডোর দিয়ে পিল পিল করে বেরোচ্ছে দর্শক। ঘেঁটে যাওয়া কাজল-মাসকারা, স্বপ্নে বিভোর চোখে লেগে থাকা আস্ত বলিউড নিয়ে যেন বেরোলেন সবাই। ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো-তে স্বচক্ষে দেখা ভিড়। করণ জোহর, দিবাকর ব্যানার্জি, জোয়া আখতার, অনুরাগ কাশ্যপ পরিচালক-চতুষ্টয় যেভাবে অলিগলি, বস্তি, ফুটপাথ, উচ্চমধ্যবিত্তের চার দেওয়াল, শিশুর স্বপ্নের আনাচকানাচ থেকে বলিউডকে কুড়িয়ে এনে কোলাজ বানালেন, এক কথায় অবিস্মরণীয়!
এ ছবি দেখার জন্য তিনটি জিনিস আবশ্যক। দূরবীন, আতসকাঁচ আর রুমাল। কখন যে আপনারদর্শনেন্দ্রিয় বিট্রে করবে আপনি জানতেই পারবেন না। রুমালটা সেই জন্যেই। সব ছবিই নামহীন। নম্বরহীন, শুধুই পরিচালকের নাম লিখে, ডায়রির পাতা ছিঁড়ে আনা হল যেন। শতবর্ষ ধরে কোটি কোটি মানুষের বোতলভরা জিন হয়ে বেঁচে থাকে যে বলিউড, দরিদ্রের অধরা বিশ্বের প্রতিভূ হয়ে বেঁচে থাকে যে রঙমহল, শিশুমনের গুপ্ত কুঠুরি হাতড়ে মণিমুক্তোর সন্ধান দেয় যে বলিউড, ক্যালেইডোস্কোপে সেটাই দেখালেন এঁরা।

বলিউডের সঙ্গীত আকাশের সপ্তর্ষিমন্ডলে যে গানগুলি খচিত থাকবে, তার মধ্যে একটি গান অবশ্যই মদনমোহন-লতা মঙ্গেশকর ম্যাজিকের লগ যা গলে...করণ জোহরের এই অণুছবিতে এমন ধ্রুবপদ হিসেবে ব্যবহার করলেন, যা এ যাবত্ আর কোনও ছবিতেই দেখাতে পারেননি। সমালোচনার অবকাশ রেখেই বলা যায়, চারটি গল্পের মধ্যে হিসেবে একটু কম শক্তিশালী হলেও করণ জোহরের শ্রেষ্ঠ ছবি অবশ্যই এটা। রানি মুখার্জি এখানে এক মসালা ম্যাগাজিনের এডিটর। স্বামী রণদীপ হুদা কাজ করেন এন্টারটেনমেন্ট চ্যানেলে। সমকামী যুবকের (সাকিব সালিম) অনুপ্রবেশই তছনছ করে দেয় তাদের মূল্যবোধ, পারস্পরিক বোঝাপড়ার ক্ষীণ সুতোটি। সেই যুবক রণদীপকে নিয়ে যায় কিশোরীর গান শোনাকে। পথের প্রান্তে রুজিরুটির জন্য যে কিশোরী কণ্ঠে সরস্বতী নিয়ে বসে থাকে, বলিউডের রঙিন দুনিয়া একদিন নতজানু হয়ে বসল তার কাছেই। কাপড়ের পুতুল দিয়ে ঢেকে রাখা পয়সার বাক্স, বড় বেশি মনে দাগ কাটে চিত্রকল্প।

দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি সত্যজিত্ রায়ের ছোটগল্প `পটলবাবু ফিল্মস্টার-এর আদলে নির্মিত। মুখ্য ভূমিকায় নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি। এই সময়ের সবচেয়ে উজ্জ্বল নায়ক। নিম্ন মধ্যবিত্তের বলিউডি স্বপ্ন। প্রতি ছাপোষা বাঙালির অবচেতনে আজও এক একজন পটলবাবু বাস করেন। নায়কের সঙ্গে ধাক্কাম্যান-এর চরিত্রে নেওয়া হয় যাঁদের। শেষের দিকটি অপূর্ব। এই গল্পটি দেখার জন্য ছবিটি আরও দু` তিনবার দেখতে লাভ বই ক্ষতি নেই। নওয়াজ যে বলিউড ছবির বিরল প্রতিভার আসনটা পোক্ত করেই চলেছেন, বলার অপেক্ষা রাখে না। শিশুমনের প্যান্ডোরা বাক্স উজাড় করে দিলেন জোয়া আখতার। ছোট্ট ছেলেটির ডান্সার হওয়ার স্বপ্ন মোটে আমল দেয় না বাবা। ছোটদের অন্তর্জগতে যে বলিউড ইন্দ্রজালের মায়া ছড়ায় তার অন্যতম কারণ, ছোটরা সহজেই বিশ্বাস করে, আর বিশ্বাসটা বড় বেশি দৃঢ় হয়ে যায়। বলিউড এখানে ড্রিম মার্চেন্ট, স্বপ্নের সওদাগর। জোয়ার গল্পটি নিটোল। একটি গুরুত্বপূর্ণ মেসেজও আছে। আর মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছে ছোট্ট ছেলেটি, যাকে চিলার পার্টিতে দেখেছেন আপনারা..

অমিতাভ বচ্চন তামাম ভারতীয়ের মনে দিল কা মুরাব্বা হয়ে আছেন। অনুরাগ কাশ্যপ সেই বিশ্বাস, ভরসা ও আবেগের নিটোল গ্লোবটাকে দেখিয়ে দিলেন অনুপুঙ্খভাবে। এই ছবিটিকে অনুরাগীদের উদ্দেশ্যে ট্রিবিউটও বলা যেতে পারে। ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে অমিতাভ বচ্চনকে এক ঝলক দেখার উদ্দেশ্যে মানুষগুলো ছুটে এসে মুম্বইতেই রুজিরুটির কারবার শুরু করেন। কারও স্বপ্ন সফল হয়, কারও স্বপ্ন হারিয়ে যায় মধ্যপথেই। প্রতিটি গল্পেই যেমন শেষ চুমুকের চমক আছে, এ ছবিও তার ব্যতিক্রম নয়। দ্য এন্ডের পরেও পিকচার আভি বাকি হ্যায় মেরা দোস্ত! আমরা দেখি হলদে বেগুনি আভার সুদৃশ্য মাল্টিপ্লেক্সে পপকর্ন-ভুক এক সদ্যযুবক ঢুকল সিনেমাহলে। একশ বছরের বলিউড পরী হয়ে হাতছানি দিল তাকে। বলিউড টকিজ এবার পথ থেকে ছবির হলে ঢুকল। একেবারে বিপরীতমুখী যাত্রাপথ। অন্য সব ছবি আমরা হলের ভেতরে ঢুকে দেখে আসি, এ ছবি আমরা দেখলাম হলের বাইরে থেকে। শেষ হওয়ার পর ঢুকলাম রুপোলি জগতে। তালিকায় বলিউডের কেউ বাদ নেই, ইতিমধ্যেই আপনারা এই বিখ্যাত ট্রেলরটি দেখে ফেলেছেন। যেখানে দিলীপ কুমার, অমিতাভ থেকে এযুগের রণবীর ইমরান আপনাকে নেচে গেয়ে এন্টারটেন করছে, আপনার সবকটি ইন্দ্রিয়কে বশ করে দিচ্ছে। যে বশীকরণের মন্ত্রের অমোঘ আকর্ষণে আজও আপনি প্রতি শুক্রবার দৌড়ে আসেন সিনেমাহলের নীল-নিভৃতে। বার বার বিনোদনের জন্য!
এক কথায়, প্রতিটি অনুছবিতে স্তরে স্তরে অর্থ। যে মানেটা আপনার মনকে সবচেয়ে ভাল বিশ্লেষণ করে দেবে, সেটাকেই আমল দিন। দেখবেন মন পরিপূর্ণতায় ভরে গিয়েছে। বলিউড ছবিতে পূর্ণতার অভিজ্ঞতা এনে দিল বলিউড টকিজ। ভাল লাগল রানির অভিনয়ও। অনেকদিন সকলে মিস করছিলেন যেটা।

.