ফিল্ম রিভিউ: মুক্তধারা

ফি-হপ্তা এত এত ফিল্ম রিলিজ! কোনটা দেখবেন, কেন দেখবেন, কী দেখবেন? বক্স অফিসে টিকিট কাটার আগে এক্সক্লুসিভ অ্যান্ড সুপারফাস্ট রিভিউ পড়ে নিজেই জেনেবুঝে নিন। হলি-বলি-টলি ছবির চুলচেরা বিচার করছেন ২৪ ঘণ্টার প্রতিনিধি শর্মিলা মাইতি।

Updated By: Aug 7, 2012, 07:14 PM IST

ফি-হপ্তা এত এত ফিল্ম রিলিজ! কোনটা দেখবেন, কেন দেখবেন, কী দেখবেন? বক্স অফিসে টিকিট কাটার আগে এক্সক্লুসিভ অ্যান্ড সুপারফাস্ট রিভিউ পড়ে নিজেই জেনেবুঝে নিন। হলি-বলি-টলি ছবির চুলচেরা বিচার করছেন ২৪ ঘণ্টার প্রতিনিধি শর্মিলা মাইতি।
মুক্তির আনন্দধারা
ছবি-মুক্তধারা
প্রযোজক-বাচ্চু বিশ্বাস
পরিচালক- নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
অভিনয়ে- নাইজেল আক্কারা, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, ব্রাত্য বসু, শিবপ্রসাদ, দেবশঙ্কর ও অন্যান্য
রেটিং- 8.5/10
আবু ঘ্রাইবের জেলে থার্ড ডিগ্রি টরচারের কথা শুনে, কাগজে পড়ে আতঙ্কে কাঁপতাম। ইউটিউবের রমরমায় এখন নাকি ইন্টারনেটেই দেখা যায় সে-সব ছবি। মিডিয়ার নিয়মিত আতসকাঁচে আরও কত না জেলবন্দির অত্যাচারিত জীবনের নমুনা দেখি আমরা। সেসব পড়লে মনে হয়, সমাজের অন্ধকারকে নর্দমার আরও জমাট পাঁকে পুঁতে ফেলাটাই দস্তুর। জেলখানা তেমনি এক অস্পৃশ্য বহ্নিশালা।
অপরাধী, সমাজবিরোধী, মানে সমাজের ব্রাত্যজনকে মানুষের স্মৃতি থেকে অদৃশ্য করে দেওয়ার কারখানা।
এ ছবিতে দেবশঙ্কর হালদারের চরিত্র বলে, জেলখানা নয়, বলুন সংশোধনাগার। অপরাধী নয়, বলুন আবাসিক। ধরে নিন, এক সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা নিরাপদ কোনও রেসিডেন্সিয়াল কমপাউন্ড, যেখানে জীবনের কিছু ভুল শুধরে নেওয়ার অবকাশ দেওয়া হয়েছে আপনাকে। কেমন হত তবে? আসলে এসব অলীক তো নয়! সংশোধনাগারের ধারণাই তো শুরু হয়েছিল এইখান থেকে। জীবনে ইচ্ছাকৃত বা সম্পূর্ণ রাগের মাথায় ঘটে যাওয়া কোনও কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্তের জন্যই সমাজ থেকে দূরের কোনও স্থানে আবার যত্সামান্য, তিলধারণের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানটুকু নিয়ে জীবনের ধারাপাত পুনরাবৃত্তি করা। ক্ষুণ্ণিবৃত্তির জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করে সামান্য উপার্জন। আর এভাবেই কষ্টসহিষ্ণুতার মাধ্যমে অপরাধপ্রবণ মনের হয়ে ওঠা শান্ত-ধীর-স্থির...

বাস্তবে তা হয় না। বন্দিদের চরিত্র সংশোধনের নামে বেদম প্রহার, অবর্ণনীয় যৌন নিপীড়ন চলে নির্বিচারে। অনেকদিন কি অল্পদিন পরে, জেলখানার চারপ্রাচীরের মধ্যে বন্দি থাকতে থাকতে সেই কাঙ্খিত স্থিতি ফিরে আসে অনেক বন্দিরই মধ্যে। যেমন ফিরে এসেছিল মুক্তধারার রফিক চাচার মধ্যেও। যে-হাতে নকশাল আন্দোলনের সময়ে কুকুরের মতো গুলি করে মেরেছিলেন মানুষ, সেই হাতেই তিনি রক্তগোলাপ ফোটান। বাইশবছর ধরে তাঁর মুক্তির আবেদন ক্রমাগত খারিজ হতে থাকে পাস্ট রেকর্ডের জন্য। অপরাধের পর অন্তবিহীন পথ পেরিয়ে কেউ কেউ ভুলেই যান কী করেছিলেন তাঁরা। তবুও তাদের তাড়া করে পাস্ট রেকর্ড, আইনের নানান ধারা আর সমাজের বিষদৃষ্টি। `গুনতির জীবন`, নম্বর দিয়ে মাপা জীবনেই পড়ে থাকতে বাধ্য হন তাঁরা, চাপা কান্না বুকে নিয়ে। এরই মধ্যে পাথরে ফুল ফোটে। রংতুলির অভাবে কাঠকয়লা দিয়েই সারা দেওয়াল জুড়ে ছবি আঁকে এক বন্দি। ফেলে-দেওয়া কাঠকুটো-আয়না দিয়ে পাঠ্যবইয়ের বিজ্ঞানস্মৃতি সম্বল করেই নজর রাখার যন্ত্র বানায় আরেকজন। প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য সিমকার্ড নিয়ে আসে রুটির ভাঁজে... এমনি কত সৃষ্টিশীলতার নমুনা উদ্বেল হয় তাদের অন্দরে।
মুক্তধারা ছবি পরিচালকদ্বয় সেই আলোর পথটাই সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করেছেন। বাংলা ছবির ইতিহাসে নতুন দিকনির্দেশ, নতুন ভাষাপ্রয়োগ করে এমন একটা ভাবনার অবতারণ সত্যিই আগে হয়নি। একটা কালচার থেরাপির দরকার সত্যিই ছিল। ছবিতে খবরে নিত্যদিন যে ভাবে ভায়োলেন্সের ভাইরাস ঢুকে পড়েছে, তার থেকে একটা নিরবিচ্ছিন্ন নিষ্কৃতির পথ দেখানোর সাহস রাখে এই ছবি। আর ঠিক এই সামাজিক অবস্থানই দাবি করে এক নন্দিনীর। এক মহীয়সী নারীর যিনি এই চাপা, ঘুণধরানো অসুখটাকে মুক্তি দেবেন। এই ছবিতে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের সেই চরিত্র। মানানসই কস্টিউম এবং স্বাভাবিক অভিনয় মুগ্ধ করে অনেক দিন পরে।
মধুর ভান্ডারকরের জেল ছবির সঙ্গে গল্পের ধাঁচ খুঁজতে গেলে বোকামিই হবে। জেলের ভেতরকার পাওয়ার-রিলেশন দেখিয়েছিলেন তিনি। সেই বড়মাছ-ছোটমাছ ক্ষমতার খেলাটা এখানেও দেখিয়েছেন নন্দিতা শিবপ্রসাদ। শিবপ্রসাদ নিজেও দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন হ্যাপি সিং-এর চরিত্রে। নাইজেল আক্কারা এই ছবির রত্নাকর। এক কথায়, রত্নের আকর। এ ছবির ভরকেন্দ্র। বাল্মীকি। কী নিখুঁত আন্ডারটোন অভিনয়। তাঁর বাস্তব-জীবন সম্পর্কে অনেকেই জেনেছেন ইত্যবসরে। বাস্তব অভিজ্ঞতা ফুটিয়ে তুলেছেন বলেই যেম মনে হয় তাঁর অভিনয়ে ক্যামেরা অদৃশ্য। ক্লাইম্যাক্স সিকোয়েন্সে, ইউসুফ যখন চার বন্দিদের নিয়ে পালাচ্ছেন, সেখানে অহেতুক নাটকীয় সংলাপ গল্পটাকে শিথিল করে। তবুও এ ছবি কালোত্তীর্ণ। অষ্টধাতুর বিগ্রহেও তো খুঁত থাকে!
বহু পরিশ্রম, বাধাবিঘ্নের পর অবশেষে মঞ্চস্থ হয় বাল্মীকিপ্রতিভা। বেরিয়ে আসে জেলের ভেতর আর জেলের বাইরের মানুষগুলোর খলনলচে। শ্রাবণের ধারার মতো মুক্তস্নান সেরে, সবার অন্দরের বল্মীকস্তুপ পরিষ্কার করে শুদ্ধ হওয়ার এক অলিখিত আখ্যান আছে এই ছবিতে। শেষ হওয়ার পর দর্শকের মনের পাতায় ধরা থাকে যেটা।
মুক্তধারা কেমন লেগেছে আপনাদের? আমাদের সঙ্গে একমত না অন্যমত? দেখে এসে লিখে জানান

.