অস্কার মনোনয়নের সশব্দ দাবিদার

মানুষের কথার স্রোতের তোড়ে যারা শ্রুতিগোচর হয় না, এমন কোনও মানুষ আছে কি, যিনি কোলাহলের পাথর সরিয়ে মুক্ত করে দিতে পারেন তাদের? সকাল থেকে রাত এমন অজস্র শব্দ, যা জীবদ্দশায় আমরা শুনেও শুনতে চাই না। শব্দের পৃথিবীতে সেই বাকি সব শব্দ-ই এ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র। এই সব প্রান্তিক শব্দ যিনি চিনে নিতে পারেন, সেই মানুষটি হলেন প্রোট্যাগনিস্ট। সিনেমার ভাষায় ফলি আর্টিস্ট। এই সব সূক্ষ্ম, প্রায় অননুকরণীয়, প্রান্তিক শব্দগুলি রেকর্ডিং স্টুডিয়োতে যান্ত্রিক উপায়ে অনুকরণ করে চলাই যাঁর উপার্জনের মাধ্যম। যাদের নাম টাইটেল কার্ডে থাকে না। থাকে না সাউন্ড জিজাইনারের জায়গাতেও।

Updated By: Apr 15, 2013, 05:19 PM IST

শর্মিলা মাইতি
ছবির নাম-শব্দ
রেটিং- *****
মানুষের কথার স্রোতের তোড়ে যে সব শব্দ শ্রুতিগোচর হয় না, এমন কোনও মানুষ আছেন কি, যিনি কোলাহলের পাথর সরিয়ে মুক্ত করে দিতে পারেন তাদের? সকাল থেকে রাত এমন অজস্র শব্দ, যা জীবদ্দশায় আমরা শুনেও শুনতে চাই না। শব্দের পৃথিবীতে সেই 'বাকি সব' শব্দ-ই এ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র। এই সব প্রান্তিক শব্দ যিনি চিনে নিতে পারেন, সেই মানুষটি হলেন এই ছবির প্রোট্যাগনিস্ট। সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে ফলি আর্টিস্ট। এই সব সূক্ষ্ম, প্রায় অননুকরণীয়, প্রান্তিক শব্দগুলি রেকর্ডিং স্টুডিয়োতে যান্ত্রিক উপায়ে অনুকরণ করে চলাই যাঁর উপার্জনের মাধ্যম। যাদের নাম টাইটেল কার্ডে থাকে না। থাকে না সাউন্ড জিজাইনারের জায়গাতেও।
আসি ছবির একেবারে প্রথম দৃশ্যে। ফলি সাউন্ড না বসানো একটি দৃশ্যের কাট দেখাচ্ছেন সাউন্ড রেকর্ডিস্ট সৃজিত, সাইকিয়াট্রিস্ট চূর্ণীকে। বোঝাচ্ছেন এই দৃশ্যে কিছু একটা মিসিং। চূর্ণী সেটা ধরতে পারছেন না। তার পরেই সৃজিতের বক্তব্য, তারক ইজ মিসিং। অর্থাত্‍ ফলি সাউন্ড মিসিং। এর পর আবার সেই সিকোয়েন্সটি দেখান তিনি। এবার আমরা শুনতে পাই। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার শব্দ, জিনিস পড়ে যাওয়ার শব্দ, বিছানায় মানুষের আছড়ে পড়ার শব্দ...
এই দৃশ্য দিয়ে ছবি শুরু করার জন্যই পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলির নাম খোদাই করা থাকবে চলচ্চিত্র ইতিহাসে। সিনেমা নামক ইন্ডাস্ট্রির সর্বাধিক উপেক্ষিত শিল্পকে প্রায় মাস্টারমশাইসুলভ কায়দায় তুলে ধরলেন দর্শকের সামনে। অজ্ঞ দর্শক শব্দের জগতে প্রথম বর্ণপরিচয়ের খাতা খুলল। মিঠুন চক্রবর্তীর তুড়ি, দেবের ডান্স স্টেপস, এক ঝাঁক পায়রার উড়ে যাওয়া কিংবা নেহাতই পায়ের তলার শুকনো পাতার মচমচ, সবকিছুই আসলে প্রকৃতি থেকে পাওয়া নয়, প্রকৃতির উপেক্ষিত শব্দকাব্য মন-প্রাণ ঢেলে শুনে, কৃত্রিম পদ্ধতিতে সাউন্ড-প্রুফ স্টুডিয়োর অন্তরমহলে শব্দ বানায় তারকেরা। তাদেরই শ্রবণেন্দ্রিয়ের সৌজন্যে শুকনো মুড়ির কৌটোর ঝাঁকুনি সিনেমার পর্দায় বদলে যায় টয় ট্রেনের সাউন্ডে, শুকনো একগুচ্ছ শালপাতার পতপতানির শব্দ সুর তোলে একরাশ কপোতের উড়ে যাওয়ার। দর্শকের এই অজ্ঞতার জায়গাটা জেনে নিয়ে ডায়গনসিস এবং কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে আরোগ্যের সিঁড়ির ধাপগুলো দেখাতে শুরু করলেন পরিচালক।

শব্দচয়নের যে প্রতিভা এই কেন্দ্রীয় চরিত্রের, সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে তার কোনও স্বীকৃতি নেই। তাদের করা কাজ নিয়ে পরিচালক প্রযোজক ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পান। ফলি আর্টিস্টরা ডুবে থাকেন সৃষ্টির আনন্দে। যে সৃষ্টিসুখে কোনও উল্লাস নেই, রয়েছে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর শব্দের খোঁজে শ্রবণযন্ত্রকে ক্ষয় করে ফেলা। একটি দৃশ্যে তারক বলছে, তার ছবি ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে ন বার। একটি ধাতব ফলকও কিন্তু তার আলমারিতে শোভা পায়নি, তা হলেও কখনও শিল্প থেকে বিরত থাকতে পারে না সে। প্রশংসার শব্দ তার কানে পৌঁছয় না। জীবনের অন্যতম মুগ্ধতা। আর পাঁচজন স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে অন্য। অসামান্য এক শ্রুতিধর ব্যক্তিত্ব। ঋত্বিকের জীবনের প্রথম `অর্থবহ` ছবি। যে মাপের অভিনয় দিয়ে তিনি শব্দ-কে শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে দিলেন, ছবির ভাগ্য দর্শক কতদূর গড়ে দেবে জানা নেই, কিন্তু ঋত্বিকের অভিনয় যে মাত্রা যোগ করল ভারতীয় ছবির ইতিহাসে, তার তুলনা এখনও অবধি ভেবে পাচ্ছি না। কাস্টিং ডিরেক্টর অবশ্যই প্রশংসা পাবেন। যাঁরা ছবিটা দেখতে যাবেন, ঋত্বিকের কানের গঠনটা খেয়াল করলেই বুঝবেন কথাটা কেন বলছি। হাল আমলের সব অভিনেতাদের মধ্যে ঋত্বিকই আছেন যিনি এই চরিত্রটি পূর্ণ মর্যাদায় সম্পন্ন করতে
পারেন। বেড়াতে গিয়েও স্ত্রীকে বোঝায়, "কত বড় আর্ট বল তো? তোমরা খালি দেব- মিঠুন চক্রবর্তীকে নিয়ে... আরে অ্যাকশনের সাউন্ড করে কে? এই তারক।" এই কটি কথাতেই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির বঞ্চনার ইতিহাসের নিবিড় গভীরে পৌঁছে যান পরিচালক, সত্যিই তা জানানোর মত শব্দ অভিধানে নেই। সিনেমার শতবর্ষে এক বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করেছে শব্দ। এই সেলিব্রেশন কাদের জন্য?
আসি পরিচালকের কথায়। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে একগুচ্ছ পরিচালক টেলিফিল্ম দুনিয়ায় একটা বিপ্লব এনেছিলেন। কৌশিক গাঙ্গুলিও ছিলেন সেই তালিকায়। প্রথম দিকেই। দীর্ঘ এক দশকের অনুশীলনের পরেই বোধহয় প্রায় ডাক্তারি দক্ষতায় এমন ছবি বানানো সম্ভব। ছবিটার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটি শব্দও অতিরিক্ত বলেননি। অতিরিক্ত সিনেমাটিক কারিকুরিতে যাননি। গেলেও সেটা দর্শকের মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়নি। সোজা সরল শব্দবন্ধের প্রয়োগে একটি অন্য জীবন বর্ণনা করেছেন। নিজেও একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন, (তাঁর নিজস্ব বক্তব্য অনুসারে, ওটা তিনি ছাড়া আর কেউ করতে পারতেন না! ছবি দেখলে বুঝবেন কথাটা কতখানি সত্যি) যেটা আসলে কেন্দ্রীয় চরিত্র তারকের সমস্যাটা ডিকোড করে। সাইকিয়াট্রিস্টকে সাহায্য করে তারকের সঠিক চিকিত্সার জন্য। এই সঠিক চিকিত্সাই তারককে স্বাভাবিক মানুষ করে, তার অতীন্দ্রিয় প্রতিভাকে নষ্ট করে... আর দর্শকের শ্রবণান্দ্রিয়কে সজাগ করে দেয়। হল থেকে বেরিয়ে, তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো অচেনা, নতুন শব্দ খুঁজতে থাকেন দর্শক। গোটা ছবিতে কোনও গান নেই। জাতীয় পুরস্কারজয়ী সাউন্ড ডিজাইনার জুটি জীবনের সেরা কাজ দেখানোর সুযোগ হাতে পেয়েছেন, জান লড়িয়ে সাউন্ড ডিজাইনিং
করেছেন। অসাধারণ এডিটিং মৈনাক বিশ্বাসের। ভাল লাগবে সৃজিতের মার্জিত অভিনয়, অসহায় স্ত্রীর ভূমিকায় রাইমাকে। প্রতিষ্ঠিত সাইকিয়াট্রিস্ট প্রফেসরের চরিত্রে ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
রিভিউয়ের হেডিং দেখে যাঁরা ভাবছেন ওভার দ্য টপ, তাঁদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা। ইদানীংকালে পুরোপুরি মৌলিক এবং দেশীয় সিনেমা সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত এমন ছবি অবশ্যই বিদেশি ছবির ক্যাটেগরিতে নমিনেশন পাওয়ার যোগ্য। আমাদের দেশ থেকে পাঠানো অধিকাংশ ছবিরই এই দুটো গুণ না থাকায়, মাঝপথেই খালি হাতে ফিরে আসতে হয়। সঠিক মূল্যায়ন ও প্রচার হলে, কৌশিক গাঙ্গুলির শব্দ সেই প্রথায় ভাঙন ধরানোর ক্ষমতাও রাখে!

.