আমার বাবা

Updated By: Sep 25, 2017, 08:59 PM IST
আমার বাবা

বাবিন

এই গল্পটা আমার নিজের। একান্ত ভাবেই নিজস্ব। কারো সঙ্গে ভাগ করে নেবার মত নয়। কারণ কেউ যে আমার কথা বিশ্বাস করবে না। নিজের স্বামীই যখন বিশ্বাস করেনি তখন গল্পের পাঠককে কোন সাহসে বলি যে আমি পাগল নই, আমি সত্যি কথা বলছি? কিন্তু আমি তো জানি, আমার সিঁথির সিঁদুর যে এখনও অক্ষত আছে, আমার মেয়ে যে সুস্থ্ স্বাভাবিক আছে, সেটা বাবার জন্যই। অথচ এই কথাটা আমি কাউকে বিশ্বাস করাতেই পারলাম না। তাই আপনাদের ওপরেই ছেড়ে দিলাম বিশ্বাস-অবিশ্বাসের অংশটুকু, শুধু বাবার প্রতি আমার শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার জন্যই কাহিনীটা আপনাদের জানাতে চাই।

            ছোটবেলায় আমরা থাকতাম শ্রীরামপুরে গঙ্গার ধারে একটা বাড়িতে। আমার বাবা হরিমোহন চক্রবর্তীর নামটাই একটু সেকেলে, কিন্তু মনেপ্রাণে ছিল ভীষণ আধুনিক। বাবা ছিল আমার বন্ধুর মত। ছোট থেকেই আমি মায়ের চেয়ে বাবার কাছাকাছি থাকতেই বেশি ভালবাসতাম। বাবা ছিল আমার খেলার সাথী। পুতুলখেলা আমি বেশি করিনি। ফি-রোববার সকালে বাবার সঙ্গে যেতাম দত্তপুকুরে মাছ ধরতে। বারোটা নাগাদ ইয়া বড় মাছ ধরে বাড়ি ফিরতাম। মায়ের মুখ হাঁড়ি হয়ে থাকত। গজগজ করত মাছ কাটতে কাটতে। অবিশ্যি খাবার সময় মাছের তাগড়া সাইজের সুস্বাদু পেটিটা তারিয়ে তারিয়ে খেতে খেতে মা সেসব কষ্ট ভুলেও যেত। পাড়াপড়শীরা মাছের ভাগ পেত। তারাও বাবার মাছ ধরার তারিফ করত। সেসব শুনে গর্বে আর খুশিতে আমার মন ভরে যেত।

            রাতের দিকে বাবা যখন রেকর্ড প্লেয়ারে গান শুনত, আমিও বাবার গলা জড়িয়ে ধরে সেইসব গান গুনগুনাতাম। আমার গানের গলা মোটেই ভালো ছিল না। তবু বাবা আমার গানের কত্তো তারিফ করত। আমার জ্বর হলে বাবার রাতে ঘুম হত না। পাশে শুয়ে আমার খেয়াল রাখত। দরকার হলে জলপট্টি দিত। মাঝে মাঝে থার্মোমিটার লাগিয়ে জ্বর মাপতো।

            বাবার আর একটা গুণ ছিল। খুব ভালো হাত দেখতে পারত। এটা কিন্তু বাবার পেশা ছিল না। বাবা রেলে চাকরি করত। জ্যোতিষ চর্চাটা শখ। বাবার ভবিষ্যতবাণী ছিল অমোঘ। রাজুকাকুকে বাবা বলেছিল, একটু বেশি বয়সে ভালো চাকরি হবে। বত্রিশ বছর বয়সে কাকুর সরকারী চাকরি হয়। রিংকুদির বিয়ে হচ্ছিল না। বাবা বলেছিল, এক মাসের মধ্যে ওর বিয়ে হবে। তাই হয়েছিল। যোগাযোগটাও খুব অদ্ভুত ভাবে। ওরা পুরী বেড়াতে গেছিল। সেখানেই কলকাতার এক পরিবারের সঙ্গে হোটেলে আলাপ হয়। বেড়িয়ে ফেরার পর ওরা নিজেরাই যোগাযোগ করে বাড়ির বড় ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে ফেলে। রিংকুদি এখন খুব সুখী। শুনেছি একটা ছেলে ওর। সমীর জেঠুকে জল থেকে সাবধান থাকতে বলেছিল। জেঠুর মৃগী রোগ ছিল। পুকুরে হাত-পা ধুতে নেমেছিল সন্ধেবেলায়। মৃগীর আক্রমণে অজ্ঞান হয়ে এক হাঁটু জলে পড়ে গিয়ে জেঠু মারা যায়। লোকের মুখে মুখে বাবার নাম ছড়িয়ে পড়েছিল।

            আমার ব্যাপারেও বাবা যেগুলো বলেছিল তার সবটাই মিলে গেছিল। কলেজে পড়তে সুদীপের সঙ্গে আলাপ হবার পর সেটা যখন প্রেমের দিকে গড়াতে থাকে বাবা আমাকে বলেছিল এ প্রেম টিঁকলে হয়। আমি বাবার কথা শুনিনি। রাগ হয়েছিল বাবার ওপর। মনে হয়েছিল সুদীপকে বাড়িতে এনেই ভুল করেছি। সুদীপকে মায়েরও ভীষণ পছন্দ ছিল। হবে নাই বা কেন? যেমন সুন্দর দেখতে, তেমনি বংশ! লক্ষপতি ব্যবসায়ী বাপের একটি মাত্র ছেলে। যে কোন মেয়ের পছন্দের মানুষ। তা বলে আমাকেও দেখতে কিছু কম নয়! আমার জন্যও ছেলেরা হা-পিত্যেশ করে বসে থাকত সে সময়। এখন এত বড় মেয়ে আমার তাও অনেকে ঝিনুক ঝিনুক করে হাঁফিয়ে মরে। হ্যাঁ আমার নাম ঝিনুক। ঝিনুক দত্ত চক্রবর্তী। বাবাকে আমি ভুলতে চাই না। তাই পিতৃদত্ত উপাধি ‘চক্রবর্তী’টাকে আমার স্বামীর ‘দত্ত’ উপাধির সঙ্গে জুড়ে রেখে দিয়েছি।

            সুদীপের সঙ্গে আমার প্রেমটা দু’বছরের বেশি টেঁকে নি। কারনটা সুদীপের পোজেসিভনেস। সবসময় ও আমাকে আগলে আগলে রেখে দিত। আমার প্রতিটি পদক্ষেপ ওর নখদর্পনে থাকা চাই। কোন ছেলে আমার দিকে চেয়ে হাসলে, ও পারলে যেন তাকে খুনই করে ফেলে। আমার জন্য কতজনের সঙ্গে যে ও শত্রুতা করে ফেলেছিল তার ইয়ত্তা ছিল না। শেষমেষ যখন একবার পুলিস কেস হয়ে গেল, তখন সুদীপের বাবা বাড়ি বয়ে এসে আমার বাবাকে অপমান করে গেলেন। আমার নামেও যাতা বলে গেলেন। আমাকে খারাপ বললে যদিও বা সহ্য করে নিতাম, আমার বাবার অপমান আমি সহ্য করতে পারব না কক্ষনো। মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে গেলাম যে আর নয়, অনেক হয়েছে। সুদীপের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দিলাম।

            সুব্রতর সঙ্গে পরিচয় হয় কলেজ পাশ করে চাকরি করতে গিয়ে। ও আমাদের পাশের একটি অফিসে চাকরি করত। সফটওয়্যার ডেভেলপার। উজ্জ্বল ভবিষ্যত। বিদেশ যাবার কথাও চলছিল। উত্তর কলকাতার বনেদী বংশ। ওর সঙ্গে দেখা একটি কফিশপে। আলাপ হলো। চটপটে ছেলে, প্রেম নিবেদন করতে একটুও দেরী করে নি। ওর সরলতা আর অকপট স্বীকারোক্তিতে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। বাবার সঙ্গে আলাপ করালাম। বাবা এক কথায় রাজি হয়ে গেল। বলল, ‘তোদের জুড়ি একদম রাজযোটক।’ ব্যাস বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়লাম। সুব্রতও চড়চড়িয়ে উন্নতির চরম শিখরে উঠতে লাগলো। দু’মাস পরই আমরা ছ’মাসের জন্য চলে গেলাম তানজানিয়া। সুব্রত কোম্পানির ওখানকার ব্রাঞ্চের প্রজেক্ট ইনচার্জ হয়ে গেল। বাবা বলেছিল আমাদের বিয়ের দু’বছরের মাথায় সময় একটু খারাপ যাবে। সেটাও মিলে যায়। রিসেসন এসে গেল। কোম্পানি লাটে উঠে যাবার উপক্রম। সুব্রতর মত মাসে আড়াই লাখ বেতন পাওয়া কর্মচারীকে পঞ্চাশ হাজার দিতে চাইল। সুব্রত সটান বলে দিল, ‘বসে থাকব তাও ভালো, তবু নিজের যোগ্যতার সঙ্গে আপোস করতে পারব না।’ তা বসিয়েই দিল আমাদের পথে। কলকাতায় ফিরে পাক্কা ছ’মাস ঘরে বসে সুব্রত। জমা টাকা সব প্রায় শেষ। যখন বিপুল বেতন পেয়েছিল আমরা ফুটানি মেরে সেই হারে খরচও করেছি। ভবিষ্যত নিয়ে খুব একটা ভাবিনি। এইবার তার ফল ভুগতে লাগলাম। কলকাতার পুরনো অফিসের চাকরিতে আমি ফের যোগ দিলাম। দশ হাজার টাকাও তখন আমাদের কাছে অনেক। আর আমি তো কোনদিনই বিশাল বেতনভুক ছিলাম না, তাই আমার কোনো ইগো সমস্যা হলো না। কিন্তু সুব্রতর হতে লাগলো। ওর মত ছেলে ঘরে বসে বৌয়ের পয়সায় খাবে এটা ও বরদাস্ত করতে পারল না। একদিন দুপুরে অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিল। অফিসে শাশুড়ির ফোন পেয়ে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে আমার একটাই নাম প্রথমে মনে এলো — ‘বাবা’। সব শুনে বাবা বলল, ‘কিচ্ছু হবে না দেখে নিস।’ সত্যিই কিছু হয় নি। ডাক্তাররা পাম্প করে সব ওষুধ বের করে দিয়েছিল।

            বাবার কথামত দিনসাতেক পরই সুব্রত একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি থেকে দেড় লাখের অফার পেয়ে গেল। কলকাতা অফিসের ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের পোস্ট। আমি কিন্তু চাকরিটা ছাড়লাম না। খুব শিক্ষা হয়েছে আমাদের। যেমন চলছিল তেমনিই আমার টাকাতে সংসার চলতে লাগলো, আর সুব্রতর মাইনের পুরো টাকাটা জমাতে লাগলাম আমরা।

            সুখ চিরদিন যে থাকে না সেটা আমি জানতাম। কিছুদিন পরই রাতে ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাট্যাক হয়ে বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেল। আমার সবচেয়ে বড় আশা ভরসার জায়গাটা হারিয়ে নিজেকে বড্ড অসহায় বোধ করতে লাগলাম। প্রচন্ড ভালবাসতাম যে বাবাকে।

            বাবা যে আমাকে ছেড়ে যেতে পারে নি সেটা বাবার মৃত্যুর পরদিনই অনুভব করলাম। শ্রীরামপুরের বাড়িতে সন্ধেবেলায় বসেছিলাম সোফার ওপর। বাবার কথাই ভাবছিলাম। ঘরে আর কেউ ছিল না সে সময়। হঠাৎ সোফা থেকে কেউ বসে থাকা অবস্থায় উঠে গেলে যেমন একটা মচমচ আওয়াজ হয় ঠিক তেমনি একটা শব্দ শুনে আমি চিন্তার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে এলাম। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। বড়ই অদ্ভুত লাগলো। কী মনে হতে আমি সোফার আমার পাশের খালি জায়গাটাতে হাত রাখলাম। চমকে উঠে হাতটা সরিয়ে নিলাম। জায়গাটা বেশ গরম। কেউ কিছুক্ষণ বসে থাকলে যেরকম গরম হওয়া উচিত ঠিক সেই রকম অনুভূতি। বিশ্বাস করুন, আমি একটুও ভয় পাইনি। বরং আনন্দ পেলাম এই ভেবে যে, বাবা আমার সুখেদুঃখে আগের মতই থাকবে। বাবার আশির্বাদ থেকে আমি কোনদিনও বঞ্চিত হব না।

            বাবার মৃত্যুর বছরখানেক পর আমি মা হলাম। মিষ্টি একটি মেয়ের মা। অনুষ্কা। ডাকনাম সুমো। গোলুমোলু সুমো পালোয়ানের মত মোটাসোটা আমার মেয়ে। মাঝে মাঝেই আমি অনুভব করেছি যে বাবা এসে আমার মেয়েকে দেখছে। আমি বাবাকে দেখতে পাইনি ঠিকই, কিন্তু মেয়ের শুন্যের দিকে চেয়ে খিলখিল হাসি আর মাঝে মাঝে পাওয়া গরম নিশ্বাস আমাকে বুঝিয়ে দিত যে বাবার স্নেহ আমাদের ঘিরে রেখেছে। আমাদের কোনো ক্ষতি হতেই পারে না।

            এরপরের ঘটনাটা বলার আগে আমার শ্বশুর বাড়ির একটা বর্ণনা দিয়ে দিই তাহলে বুঝতে সুবিধে হবে। আমার শ্বশুরবাড়ি বনেদী বংশ। পুরনো কলকাতার এক গলিতে অন্তত দেড়শ বছরের পুরনো বাড়ি এটা। আগেকার দিনের মত ভিতরে দুর্গাদালান। আর তাকে ঘিরে তিনতলা বাড়ি। প্রতি তলে আটটি করে ঘর। একতলায় রান্না খাওয়া চাকরবাকরদের থাকার ব্যবস্থা। দোতলায় শ্বশুর-শাশুড়ি কাকা-জেঠারা থাকেন। তিনতলায় দুটি ঘর নিয়ে থাকি আমি আর সুব্রত। অন্য ঘরগুলোয় সুব্রতর কাকার ছেলেরা। তারাও বিবাহিত। দেওর-ভাসুর-জা নিয়ে এক্কেবারে জমজমাট ব্যাপার। সুব্রত আমার শ্বশুরের একটিমাত্র সন্তান। ঘরগুলো এমন ভাবে বানানো যে তার একদিকের বারান্দা দিয়ে দুর্গাদালান দেখা যায়, আর অন্যদিকে রাস্তা। অর্থাৎ দুদিকেই টানা বারান্দা। কাঠের জাফরী লাগানো। একেবারে পুরনো কলকাতার ছাপ বসানো।

            দিনটা ছিল শনিবার। সুব্রত শনিবারটা তাড়াতাড়ি ফেরে। বিকেলের দিকে। মেয়ের জন্মের একটু আগেই আমি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিলাম। তাই দুপুরে একটু চমত্কার ভাত ঘুম দিই। সেদিন আবার খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। মনোরম পরিবেশ। আমি খুব আরামে ঘুমাচ্ছিলাম। স্বপ্নে বাবা দেখা দিল। মাঝে মাঝেই আমি স্বপ্নে বাবাকে দেখি। বাবা এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর আমি নিরুদ্বেগে ঘুমিয়ে পড়ছি। সেদিন বাবা এসে মাথায় হাত রাখল না। বরং বাবার মুখটা যেন চিন্তাক্লিষ্ট দেখালো। বাবা আঙ্গুল তুলে আমাদের ঘরের বাইরের যে বারান্দাটা রাস্তার দিকে সেটার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখালো। দেখলাম সুব্রত একটা তোয়ালে হাতে সেই বারান্দাটার দিকে যাচ্ছে। স্বপ্নটা পুরো দেখা হলো না, কারণ এই সময়ই সুব্রত আমাকে ঝাঁকিয়ে ঘুম থেকে তুলে দিল। ও ফিরে এসেছে। ঠিক হল যে আজ সন্ধ্যেয় আমরা পার্ক স্ট্রিটের একটা রেস্তঁরায় ডিনার করতে যাব। আমি খুব খুশি। মাঝে সাঝে বাইরে খেতে আমার খুব ভালো লাগে। রোজ রোজ ঘরের খাবার কাঁহাতক ভালো লাগে!

            সুব্রত স্নান করতে গেল। ও স্নান করে এসে তোয়ালেটা মেলতে যাচ্ছিল বারান্দায়। চক্ষের পলকে আমার স্বপ্নের কথাটা মনে পড়ে গেল। বাবা কী কিছু বলতে চাইছিল? কী বলতে চাইছিল? আমি প্রায় আর্তনাদ করে সুব্রতর নাম ধরে চিৎকার করে উঠলাম। সুব্রত বারান্দার দিকের দরজাটা খুলে পা রাখতে যাচ্ছিল তখন। আমার ডাকে চমকে ঘুরে তাকানো মাত্র ঝরঝর করে পুরো বারান্দাটাই খসে পড়ে গেল! পুরোনো দিনের বাড়ি, প্রবল বৃষ্টিতে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে নি। তীব্র আতঙ্কে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। সুব্রতর অবস্থাও তথৈবচ। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। আর একটু হলে যে কী হত সেটা ভেবেই আমি আকুল হয়ে গেলাম। ওর কোনো ক্ষতি হবে আমি স্বপ্নেও তা ভাবতে পারি না। ও আর মেয়ে যে আমার জীবন। বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে গেল।

            ব্যাপারটা সামলে নিয়ে একটু রাতের দিকে সুব্রতকে সেদিনই প্রথম আমি বাবার কথাটা বলে দিলাম। বুঝলাম ব্যাপারটা ওর ঠিক বিশ্বাস হলো না। কিন্তু আমার বিশ্বাসকেও আঘাত করতে চাইল না ও। খুব ভালো ছেলে তো। আর আমাকে দারুণ ভালবাসে। এই ব্যাপারটা নিয়ে আমার সঙ্গে আর কোনো কথা হয় নি।

            অনেকদিন আর এরকম কোনো স্বপ্ন দেখিনি। মেয়ে যখন প্রায় এক বছরের তখন আবার দেখলাম। শনিবারের দুপুরেই। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। তার মধ্যিখানে আমার সোনামণি দাঁড়িয়ে। আমি চিৎকার করে যাচ্ছি কিন্তু আমার ডাক শোনার জন্য কেউ নেই আশেপাশে। বাবা দূরে দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের জল ফেলে যাচ্ছে।

            ঘুম ভেঙ্গে দরদর করে ঘামতে লাগলাম। নাহ এই বাড়িতে আর নয়। তিনতলায় আগুন লাগলে মেয়েকে নিয়ে পালাব কোন পথে? ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেই আর এক মুহূর্ত নষ্ট না করে একটা ব্যাগে টুকিটাকি জামাকাপড় গুছিয়ে আর দেয়ালে টাঙানো বাবার ছবিটা নিয়ে নিচে নেমে এলাম। তখন সাড়ে তিনটে বাজে। সুব্রত’র আসতে অনেক দেরী। শ্বশুর শাশুড়ি কাউকে কিছু জানাবার প্রয়োজন বোধ করলাম না। কারণ ওরা যদি আটকে দেয় তাহলে আমি আর আমার মেয়েকে বাঁচাতে পারব না।

            বাড়িতে আমাদের গাড়ি, ড্রাইভার — সব ছিল। কিন্তু তাকে ডাকতে গেলে হাজার কৈফিয়ৎ দিতে হবে। আর আমার কাছে প্রতিটা মিনিটই গুরুত্বপূর্ণ। একটা মায়ের কাছে তার সন্তানই সবচেয়ে কাছের। ঘুমন্ত মেয়েকে ডানহাতে কোলে তুলে নিলাম আর বাঁ-হাতে ব্যাগ নিয়ে আলুথালু চুলো হয়ে আমি সোজা রাস্তায় নেমে গেলাম। বুঝতে পারছি রাস্তার লোকজন আমাকে নির্ঘাৎ পাগল ভাবছেন। কিন্তু আমি সেসব অগ্রাহ্য করে একটা ট্যাক্সি ডাকলাম। উঠে বললাম শ্রীরামপুর যাব। বালি ব্রিজ হয়ে চল। সে এতটা পথ শুনে গাঁইগুঁই করছিল। আমি বললাম, ‘মিটারের ওপর যা ইচ্ছে নিও এখন চল তো।’

            এরপর মোবাইল থেকে সুব্রতকে ফোন করলাম। ওকে বললাম, ‘মায়ের শরীরটা ভালো নেই। আমাকে এভাবে না বলে যেতে হচ্ছে। তুমি বাড়িতে একটা খবর দিয়ে অফিস থেকে সোজা শ্রীরামপুর চলে এস। বাকি কথা দেখা হলে হবে।’ জানতাম সত্যিটা কেউ বিশ্বাস করবে না।

            মা’ও আমাকে এভাবে হঠাৎ আসতে দেখে অবাক হয়ে গেল। তবে খুশিও হলো। অনেকদিন পর একমাত্র মেয়েকে দেখে কোন্ মা না খুশি হবে! খুশির চোটে মা আমাকে বসিয়ে রেখে বাজারে গেল। নিজের হাতে গঙ্গার ইলিশ কিনে আনতে। শ্রীরামপুরে গঙ্গার ধারে একটা চমৎকার বাজার আছে। মাঝিরা নৌকা থেকে টাটকা ইলিশ তুলে দিয়ে যায় বিক্রির জন্য। আমাকে বলে গেল, ‘রান্নাঘরে গ্যাসের একটা ওভেনে দুধ বসিয়ে রেখেছি আর একটায় ভাত হচ্ছে একটু লক্ষ্য রাখিস। ফুটে গেলে বন্ধ করে দিস।’

            মা চলে যেতে আমি মেয়েকে নিয়ে গেলাম বাবার ঘরে। বাবার ঘরটা কেউ ব্যবহার করে না। বাবার ব্যবহৃত জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো। মা’ও কি বাবাকে অনুভব করে এখনো? কী জানি। এসব নিয়ে আমি কোনদিন মা’য়ের সঙ্গে আলোচনা করিনি। শুধু মা’য়ের সঙ্গেই কেন, সাহস করে কারো সঙ্গেই কোন কথা কোনদিন বলতে পারিনি। যদি সুব্রতর মতো সবাই আমাকে অবিশ্বাস করে? পাগল ভাবে?

            মেয়েকে একটা সোফায় বসিয়ে রেখে আমি পুরো বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। চতুর্দিকে ছোটবেলার স্মৃতি ছড়িয়ে। আমাদের বাড়িটা দেড়তলা। বাবা নিজের রোজগারের টাকা পয়সা জমিয়ে করেছিল বাড়িটা। বাড়ি বানাবার সময় বাবা গ্যারেজ ঘরের প্ল্যান করেছিল। কিন্তু গাড়ি কেনার সামর্থ্য ছিল না। তাই পরে গ্যারেজ ঘরটাই রান্নাঘরে পরিবর্তিত হয়ে যায়। আর গ্যারেজের ঠিক উপরের দেড় তলার ঘরটাই ছিল বাবার ঘর। বাবার খুব পড়ার শখ। বাবার ঘরে দেয়াল জোড়া তাক। তাতে অজস্র পুরনো পুরনো বইয়ের স্তুপ। সব সাজানো যেমনকার তেমন। মেয়ে টলমল পায়ে নিজে নিজেই ঘুরে বেড়াতে লাগলো। বাবার ছবিটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে হাসতে লাগলো। আমার ওকে হিংসে হচ্ছে। বাবাকে আমি তো দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু ও হয়ত পাচ্ছে। যাক সান্তনা এইটুকুই যে বাবার আশীর্বাদ আজও আমাকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করছে।

            সুব্রতকে ফোন করা দরকার। শ্বশুরবাড়ির কী অবস্থা কে জানে। কিছু যে একটা দুর্ঘটনা ওই বাড়িতে ঘটতে চলেছে সেটা নির্ঘাৎ। শ্রীরামপুরে আমাদের এই বাড়িতে নেটওয়ার্কের খুব সমস্যা হয়। ভালো করে কথা শোনা যায় না। তাই বাড়ির পিছনের বাগানটায় এসে চেষ্টা করতে লাগলাম। একটু পরে লেগে গেল। ও বলল, অফিস থেকে পাঁচটায় বেরিয়ে এইমাত্র বাড়ি পৌছেছে। স্নান করে শ্রীরামপুর আসবে।

            আমি রাগত স্বরে বললাম, ‘তোমাকে যে বলেছি বাড়িতে থাকার দরকার নেই! কথাটা কানে ঢুকলো না? এই মুহুর্তে তুমি বেরিয়ে এসো। এখানে তোমাকে খুব দরকার সুব্রত।’

            আমি সচরাচর সুব্রতর সঙ্গে এইসুরে কথা বলি না। ও একটু থতমত খেয়ে গেল। বলল, ‘ঠিক আছে আমি বেরোচ্ছি।’

            ফোনে কথা বলতে বলতেই বাড়ির ভিতর থেকে আসা একটা চাপা হিসহিস শব্দ কানে আসছিল। না সাপের হিসহিসানির মত নয়। অন্য কিছু। তখন গ্রাহ্য করিনি, এবার কলটা কেটে দিয়ে শব্দ লক্ষ্য করে এগোবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু — কিন্তু তার আগেই ভয়াবহ শব্দ করে রান্না ঘর থেকে কিছু একটা ফেটে পড়ার শব্দ ভেসে এলো। দৌড়ে এগোবার চেষ্টা করলাম! কিন্তু দাউ দাউ করে লেলিহান আগুনের শিখা ততক্ষণে ছড়িয়ে পড়েছে রান্নাঘর থেকে! হে ভগবান! গ্যাস সিলিন্ডারটা বোধহয় বার্স্ট করেছে! মা বলে গেছিল গ্যাসের দিকে নজর রাখতে। আমি ভুলে গেছিলাম। দুধ উপচে পড়ে বড় ওভেনটা নিভে গেছিল। গ্যাস বেরিয়ে সমস্ত বাড়িতে তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ। কিন্তু সুমো তো রান্নাঘরের ঠিক ওপরেই বাবার ঘরে আছে!! আর সে ঘরটা তো দাহ্য বইতে ঠাসা! রান্নাঘরের পাশের সিঁড়ি বেয়ে কোনমতে উপরে ওঠার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু চতুর্দিকে আগুন আর আগুন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লাম সিঁড়ির ওপর।

            অনেক লোকের মিলিত চিৎকারে যখন আমার জ্ঞান ফিরল, দেখি আমি বাড়ির বাইরে বাগানে ঘাসের ওপর পড়ে আছি। দমকলের ঘন্টি বাজছে। চতুর্দিক লোকে লোকারণ্য। ঝটকা মেরে উঠে আতঙ্কে চিত্কার করে উঠলাম, ‘সুমো ... আমার সুমো কোথায়?’

            সুব্রত আর মা এগিয়ে এলো। মায়ের কোলে আমার সুমো। হাসছে খিলখিলিয়ে। মা বলল, ‘খুব জোর বেঁচে গেছিস তোরা। ভাগ্যিস মেয়েকে কোলে করে বাইরে আসতে পেরেছিলিস।

            সুব্রত ভর্ত্সনার সুরে বলল, ‘কী করে তুমি ভুলে গেলে যে গ্যাসে দুটো ওভেনই মা চালিয়ে দিয়ে গেছিল? কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার হয়ে গেল বলত?’

            মা সান্তনার সুরে বলল, ‘যাক প্রাণটা তো বেঁচেছে। বাড়ি পুড়েছে তাতে ক্ষতি নেই। ওর বাবা ইনসিওরেন্স করে গেছিল। কিন্তু ক্ষতি যেটা হল তা অপুরনীয়।’ একটু থেমে মা ধীরে ধীরে বলল, ‘বাবার ঘরটা সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বাবার স্মৃতি বলতে আর কিছুই রইল না।’ মায়ের গলায় বিষন্নতার সুর।

            আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। ডুকরে কেঁদে উঠলাম। হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলাম। বাবার মৃত্যুতেও আমার এত শোক হয়নি বোধ হয়, আজ বাবার সমস্ত স্মৃতি নষ্ট হয়ে গেছে শুনে যতটা হল। ওরা না জানলেও আমি তো জানি আমার মেয়েকে আর আমাকে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা বাড়িটা থেকে কে বাইরে এনেছে! বাবা নিজের সবকিছু বাজি রেখে আমাদের আজ বাঁচিয়ে দিল।

           আর কখনো বাবা আমার স্বপ্নে আসেনি। আজকাল আর অনুভব করি না বাবার সেই গরম নিশ্বাস। মেয়েও আর শুন্যের দিকে তাকিয়ে খলখল করে খুশিতে হেসে ওঠে না। সেদিনের আগুনে বোধহয় বাবার প্রেতজন্মটারও মৃত্যু হয়েছিল। যেখানেই থাকো বাবা তুমি ভালো থেকো। আমি চাই আমার মেয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-এমবিএ হোক না হোক অন্তত একটা মানুষ অবশ্যই হোক — বাবা, ঠিক তোমার মতো।

আরও পড়ুন- ঝুলন শব্দের মানে হল, মেয়েরাই অগতির 'গতি'

.