তুমি মা...

Updated By: Feb 21, 2017, 02:07 PM IST
তুমি মা...

দিব্যেন্দু ঘোষ

ফেসবুক ওয়ালের নোটিফিকেশনটা টুং করে বেজে উঠল।

ছেলেকে মায়ের ফোন : বাবা, তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়। বউমার প্যারালিসিস অ্যাটাক হয়েছে। মুখ বেঁকে ম হয়ে গেছে। চোখ কপালে উঠে চ। ঘাড় বেঁকে ঠিক যেন  ঘ। ভয়ে আমার হাত-পা পেটের ভিতর সেঁধিয়ে যাচ্ছে, বাবা।

সব শুনেটুনে ছেলের গলা শান্ত। গলায় একটুও উত্তেজনা নেই। ধীরে মাকে বলল : মা, তুমি এত চিন্তা কোরো না। ও ঠিক হয়ে যাবে।

মা : বাবা, আমি সামলাব কী করে? বাড়িতে কেউ নেই। তোর তো দেখছি বউয়ের প্রতি একটুও ভালবাসা নেই।

ছেলে : ভালবাসা ষোলোআনা মা। কিন্তু ওর ভালবাসা ফোনের প্রতি।

মা : মানে!

ছেলে : মা, তোমার বউমার প্যারালিসিস-ট্যারালিসিস অ্যাটাক-ফ্যাটাক কিস্যু হয়নি। ও সেলফির পোজ দিচ্ছে। সেলফি তুলে ওর দেওয়ালে সাঁটবে। থুড়ি, ফেসবুকের দেওয়ালে। তুমি না মা, এখনও সেই বোকাই রয়ে গেলে। বাবাটা কবেই তোমাকে ঠকিয়ে পগার পার। একটু তো চালাক হও মা, একটু।

মা : আর চালাক হয়ে কী হবে বাবা? বেলা যে বয়ে গেল... আমি বরং এমনই থাকি।
......

আরও একটা নোটিফিকেশন এসে পৌছল।

জনৈক লিখছেন, আমরাই খুব সম্ভবত শেষ প্রজন্ম, যারা মুখ ধোওয়ার পরে মায়ের আঁচলে মুখ মুছেছি।

ঠিক।
.......

আরও একটা আওয়াজ। টুং...

UNESCO বাংলা ভাষাকে একটা স্বীকৃতি দিয়েছে। হেব্বি স্বীকৃতি। ""Sweetest language in the world''

এত মিষ্টি! চুমো একটা।
......

বাংলাভাষা। মাতৃভাষা। মায়ের ভাষা। মুখ ফুটে বলার ভাষা। শিশু জন্মের পর যে শব্দটা প্রথম উচ্চারণ করে, তা হল মা। এই মা শব্দটা যখন আধো বুলিতে বাংলা ভাষায় উচ্চারিত হয়, তখন সর্বৈব সুমধুর ধ্বনি...
........

শুধু মা কেন? কেন নয় বাবা? সেই সব বাবা-মা। প্রেমদিবস না জেনেও যারা ভালবেসে এসেছে, চিরকাল। বাঙালির প্রেম-পিরিতির দিনকাল আর ২১ ফেব্রুয়ারি এক হপ্তার তফাত্‍। কিন্তু সম্পর্কের ঘষা কাচে লেগে থাকে না দূরত্বের হিসেব-নিকেশ।
..........
ফেসবুকের দেওয়ালে কান পাতিলাম। যা শুনিলাম, বলি। মা, শোনো মন দিয়ে...

কাচফাটা ঘড়ি ১০টা-৫টা পেষে...
ভিড় বাস থেকে অফিসে একুশ আইন...
স্বপ্ন যা ছিল, মিলল না তার কিছু
ঝাপসা চশমা জানে না ভ্যালেন্টাইন।

কলমে-কাগজে প্রেম-মাখা চিঠি নয়
বিদ্যুত্‍ বিল, মুদির খরচ ভাসে
""দামি চকোলেট না-খেলেই নয়, অপু?
টেডিটা, শোন মা, না হয় আসছে মাসে...''

শুধু দুজনের সময় কাটানো? ধুস...
বাঁচানো সময় ছেলে-মেয়েদের নামে
চোখে চোখ পড়ে কীভাবে কাব্য হবে
সারাদিন যদি গেরস্থালি না থামে?

এর প্রেম মানে "চলো শনি-রবি দিঘা'
তার প্রেম মানে বছরে দুখানা শাড়ি
তবু পৃথিবীটা ঘেন্নায় নিভে গেলে
আলো জ্বেলে যায় ভালবেসে থাকা বাড়ি
..........
মানুষ একদিন অমৃতলোকে বাস করত। সে লোক স্বর্গলোক। সেখানে দুঃখ নেই, মৃত্যু নেই। কিন্তু যে স্বর্গকে দুঃখের ভিতর দিয়ে, মন্দের সংঘাত দিয়ে, না জয় করতে পেরেছি, সে স্বর্গ তো জ্ঞানের স্বর্গ নয়-তাকে স্বর্গ বলে জানিই না। মায়ের গর্ভের মধ্যে মাকে পাওয়া যেমন মাকে পাওয়াই নয়, তাকে বিচ্ছেদের মধ্যে পাওয়াই পাওয়া।
........
মায়ের কথা বলতে গিয়ে কবিগুরুর কাছ থেকে ধার নিতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ, মায়ের কথা বলার বা লেখার ধৃষ্টতা আমার কোথায়? প্রথম এবং শেষ কথা তো তিনিই বলে গেছেন। বাঙালির সেরা আইকন তো তিনিই। মা এবং মাতৃভাষার এমন সহজ, সুললিত কথন আর কি কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়?

গর্ভ ছেড়ে মাটির পরে
যখন পড়ে,
তখন ছেলে দেখে আপন মাকে।

তোমারি আচ্ছাদন হতে যেদিন দূরে ফেলাও টানি
সে বিচ্ছেদে চেতনা দেয় আনি-
দেখি বদনখানি।
...........
মা যে আমার ঘরে
বসে আছে চেয়ে আমার তরে,
তারে ছেড়ে থাকব কেমন করে।

তার চেয়ে মা আমি হব মেঘ,
তুমি যেন হবে আমার চাঁদ-
দুহাত দিয়ে ফেলব তোমায় ঢেকে,
আকাশ হবে এই আমাদের ছাদ।

মা যে চেয়ে থাকে,
সন্ধে হলে নাম ধরে মোর ডাকে,
কেমন করে ছেড়ে থাকব তোকে।

তার চেয়ে মা, আমি হব ঢেউ
তুমি হবে অনেক দূরের দেশ।
লুটিয়ে আমি পড়ব তোমার কোলে,
কেউ আমাদের পাবে না উদ্দেশ।।
........

দুপুরবেলা মহাভারত হাতে
বসবে তুমি সবার খাওয়া হলে,
গাছের ছায়া ঘরের জানালাতে
প়ডবে এসে তোমার পিঠে কোলে,
আমি আমার ছোট্ট ছায়াখানি
দোলাব তোর বইয়ের পরে আনি-
তখন তুমি বুঝতে পারবে না সে
তোমার চোখে খোকার ছায়া ভাসে।
..........
আবার আমি তোমার খোকা হব,
""গল্প বলো'' তোমায় গিয়ে কব।
তুমি বলবে, ""দুষ্টু, ছিলি কোথা''
আমি বলব, ""বলব না সে কথা।''
.......

খোকার লাগি তুমি মা গো,
অনেক রাতে যদি জাগো
তারা হয়ে বলব তোমায়, ""ঘুমো।''
তুই ঘুমিয়ে পড়লে পরে
জ্যোত্স্না হয়ে ঢুকব ঘরে,
চোখে তোমার খেয়ে যাব চুমো।

আমি ঋণস্বীকার করছি কবিগুরুর কাছে

আরও পড়ুন আজ একুশে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

.