তুহি তো মেরি দোস্ত হ্যায়

Updated By: Dec 20, 2015, 02:25 PM IST
তুহি তো মেরি দোস্ত হ্যায়

প্রিয় যুবি
একটা চিঠি। আমরা বলি খোলা চিঠি। তোমায় লেখা। অনেক কথা বলার। কাল দেখলাম, তোমাকে ফের ভারতীয় দলে ডাকা হয়েছে। হ্যাঁ, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সিরিজ শুরু হবে তো আর কয়েকটা দিন বাদেই। সেখানে ৫ টা একদিনের ম্যাচ আর তিনটে টি-২০ ম্যাচ খেলবে ভারত। যার ওই তিনটে টি-২০ ম্যাচে দলে নেওয়া হয়েছে তোমাকে। খুশির খবর। খুশি হয়েওছি। কিন্তু এত কথা মনে জমে গিয়েছে এই খবরে, তাই এই লেখা। মনের প্রথম প্রশ্ন। কেন তোমায় হঠাত্‍ করে টি-২০ দলে ডাকা হলো? উত্তরগুলো পরপর সাজালাম। এক, সম্প্রতি ঘরোয়া ক্রিকেটে অসাধারণ পারফরম্যান্স করেছো তুমি। কিন্তু পারফরম্যান্সের বিচারে এ দেশে আবার কবে দলে জায়গা পাওয়া যায়! তাই মন মানলো না। দুই, অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে দল। যারা নিজেদের দেশেই দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারাতে পারছে না, তারা আবার অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে ম্যাক্সওয়েলদের কীভাবে হারাবে! তাই বোধহয় শরণাপন্ন হওয়া পাঞ্জাব কি পুত্তরের। তিন, হতে পারে হেজেলের হাত ধরে তোমার জীবনে ফের বসন্ত এলো। না হলে, ঘরে বসেছিলে পাক্কা এক বছর আট মাস। কেউ তো তোমার কথা মনে করেনি। তাহলে হেজেলের সৌভাগ্যের দামই পাচ্ছো তুমি। আর সবশেষে যে যুক্তিটা দিলাম, তাহলো, অস্ট্রেলিয়া সিরিজের পরই যে দেশের মাঠে টি-২০ বিশ্বকাপ। সেখানে জিততে গেলে একটা যুবরাজ সিং লাগবে না? অস্ট্রেলিয়ায় তোমাকে একবার খেলিয়ে দেখে নিতে চাইছে বিসিসিআই। যদি তুমি ঠিক-ঠাক খেলে দাও, তাহলে টি-২০ বিশ্বকাপেও তোমায় দলে রেখে দেবে। আর ভালো খেলতে না পারলে, ব্যাস, ভুলে যেও ইন্ডিয়া টিমকে। এখানে তোমার আর কোনও জায়গা থাকবে না। এঁরা বীরেন্দ্র সেওবাগকে আড়াই বছর বাড়িতে বসিয়ে রেখে খেলা ছাড়িয়ে দিতে বাধ্য করেছে। তোমাকে দেড় বছর বাড়িতে বসিয়ে রেখে দিয়েছে। তুমি অস্ট্রেলিয়ায় একটু খারাপ খেললে, আর তোমায় এঁদের মনে রাখতে বয়েই গেছে! আর এই ভাবনাগুলো মনে আসতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল।

১৯৯৫ সালের আগের ক্রিকেটের কথা তুলছি না। কিন্তু শেষ ২০ বছরের ক্রিকেট মানেই তো পরপর এই নামগুলো উঠে আসে। সচিন, সৌরভ, সেওবাগ, দ্রাবিড়, কুম্বলে, লক্ষ্মণ, এরপর বড় জোর মহেন্দ্র সিং ধোনি। কিন্তু তুমি যুবরাজ সিং, পছন্দের হলেও কুলীন হলে কোথায়? তোমায় কিছুতেই এঁদের পাশে বসানো হয় না। তার বড় কারণ? তুমি যে টেস্টে খুব একটা ভালো খেলতে না। ৪০ টেস্ট খেলে ১৯০০ রান। ৩ টে সেঞ্চুরি যে সত্যিই যুবরাজ সিংয়ের প্রতিভাকে 'রিপ্রেজেন্ট' করে না। করে না তো করে না। মাইকেল বিভান কত বড় টেস্ট ক্রিকেটার ছিলেন? তা বলে অসিরা নাকি ক্রিকেটবিশ্ব, কেউ মাইকেল বিভানকে ভুলতে পেরেছে নাকি? তুমি যে আমাদের দেশের ক্রিকেটের মাইকেল বিভান ছিলে, আছে, থাকবে। আর আগের ওই নামগুলো, দেশকে কটা করে বিশ্বকাপ জিতিয়েছে? ভারতীয় ক্রিকেটের সবথেকে বড় তিনটে ঘটনা কী? সিম্পল। তিনটে বিশ্বকাপ জেতা। এর প্রথমটা ১৯৮৩ সালে। তখন তুমি কতটুকু! তাই ওতে তোমার কোনও অবদান থাকার কথাও নয়, নেইও। কিন্তু তারপর? ২০০৭-এ প্রথম টি-২০ বিশ্বকাপ জেতা?ওটা তুমি ছাড়া হতো নাকি? ভারতীয়দের উপর বর্বর ব্রিটিশরা ২০০ বছর রাজত্ব করেছে। অত্যাচার করেছে। খেলার আঙিনায় সেই ব্রিটিশদের ধুর ছাই করতে পারার যে কয়েকটা গর্বের মুহূর্ত হয়, তা সাজালাম। এক, মোহনবাগানের সেই ২-১ ব্যবধানে ইস্ট ইয়র্কশায়ারকে ১৯১১ সালে হারানো। দুই, শৈলেন মান্নার খালি পায়ে হাত দিয়ে ব্রিটিশ রানির বুঝতে চেষ্টা করা যে, ও পা লোহার নাকি রক্ত-মাংসের! তিন, বিজেন্দর সিং পেশাদার বক্সিংয়ের প্রথম ম্যাচে খেলতে নেমে, ইংল্যান্ডেরই মাটিতে, এক ব্রিটিশ বক্সারকে নাকি ৬ রাউন্ডের খেলায় ২ রাউন্ডের মাথাতেই মাটিতে ফেলে শুইয়ে দিলেন! ইংরেজদের বিরুদ্ধে এরকম বদলার ছবি, আর কোথায়? এই আর কোথায় বললেই মনে পড়ে। তোমারটা যে এই তালিকায় সবসময় এক নম্বর। ২০০৭ টি-২০ বিশ্বকাপ। তুমি মাঠে নামার পরই ফ্লিনটফ কী সব আজে বাজে কথা বলে তোমার মেজাজটা চড়িয়ে দিল। আর তারপর ব্রডকে তুমি যে, কষিয়ে হাফ ডজন থাপ্পড়টা মারলে, প্রতিটা ইংরেজের মুখে এরকম সপাটে হাফডজন থাপ্পড় মারার সুযোগ আর কখনও তো ভারতীয়রা পায়নি খেলার মাঠ থেকে।

কী তাত্‍পর্য! মঞ্চ-বিশ্বকাপ।সামনে ইংরেজরা। হাতে বল, স্টুয়ার্ট না ব্রড, নামেই দ্বিচারিতা! তাঁকে পরপর ৬ বলে ৬ টা ছক্কা। আলাদা আলাদা জায়গায় উড়ে গিয়ে পড়ল বলটা। হতে পারে ব্রডের কলজেটাও! ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে খেলার মাঠে ওদের সিংহের ল্যাজ মুড়িয়ে দেওয়া কাকে বলে দেখিয়েছিলে যে তুমিই। সেই বিশ্বকাপটাই তো জিতল ভারত তোমার জন্য। ও ম্যাচে ১২ বলে ৫০! এরপর এল ২০১১। আবার একটা বিশ্বকাপ। দলে তারকার ফুলঝুরি। সচিন, সেহবাগ, গম্ভীর, ধোনি, আজকের বিরাট, সব। কিন্তু ভারত বিশ্বকাপটা জিতেছিল কার জন্য, সবাই বলে দেবে একবারে তোমার নামটাই। ব্যাট হাতে ৩৬২ রান। বল হাতে ১৫ উইকেট। তুমি দেশকে দু-দুটো বিশ্বকাপ জোতানো ক্রিকেটার একদম একার হাতে। আবারও বলছি একার হাতে। মারাদোনার পাশে বুরুচাগার সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়াটা যদি ১৯৮৬-তে 'ইগনোর' করা যায়, তাহলে ২০১১-র বিশ্বকাপেও ধোনির ৯১ 'ইগনোর' করার চেষ্টা করা উচিত ছিল ভারতীয়দের। কাকতালীয়ভাবে ধোনির উইনিং স্ট্রোকেরসময়ও যে ২১ নট আউট ক্রিজে ছিলে তুমি! তুমি আমাদের দেশের ক্রিকেটের মারাদোনাই তো বটে। তোমার মতো বর্ণময় চরিত্রের ক্রিকেটার হালে আর কটা পেয়েছি আমরা? তুমি সচিন তোন্ডুলকরকে দেখে বড় হয়েছো। সেই তুমিই সচিনের সঙ্গে এক যুগেরও বেশি সময় খেলেছো। কখনও কখনও তাঁকে কিছু ম্যাচে ছাপিয়েও গিয়েছো। আর কী আশ্চর্য, যে ইয়র্কশায়ার কোনওদিনও বিদেশি ক্রিকেটার খেলাতো না, তারাই নাকি তাঁদের দলে শুধুমাত্র দুই ভারতীয়কে খেলার সুযোগ দিয়েছে। একজন তোমার আইডল সচিন। অন্যজন তুমি। এর থেকে বড় পাওনা আরকী হতে পারে?

প্রত্যেকটা বছর আইপিএলের নিলাম হয়েছে। আর তোমাকে কিনতে টাকার যুদ্ধ চলেছে ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের মধ্যে। বারেবারে তুমিই সবথেকে দামি ক্রিকেটার! আজ পাঞ্জাব, কাল দিল্লি, পরশু পুনে অথবা আজ বেঙ্গালুরু, সব জায়গাতেই রাজা, মহারাজা অনেক থেকেছে টেকেছে, কিন্তু যুবরাজ যে তুমিই ছিলে। সেই ২০১৪-র ৬ এপ্রিল। টি-২০ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ফাইনাল খেলছিল ভারত। কিন্তু তোমার যে কী হল। কিছুতেই ব্যাট আর বল এক হচ্ছিল না। ২১ বলে ১১ করলে! ধরা পড়ে গিয়েছিলে ওই ম্যাচটায়। ব্যাস তোমায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল বিসিসিআই। কেউ মনেই রাখেনি যে, ওর একটা ম্যাচ আগেও অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে তুমি একা কাঁধে করে ম্যাচ জিতিয়েছিলে। তাই তো ভারত ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছেছিল। মানে, কী চেয়েছিলো ওরা তোমার কাছে? দেশকে তিনটে বিশ্বকাপ জিতিয়ে এনে দেবে তুমি। আর দেশ পুজো করবে সচিন, গাভাসকার, কপিলকে! হাঃ, হাঃ।

যাক গে যাক, মাঝের এই এক বছর আট মাসে ভারত আহামরি কোনও পারফরম্যান্স করেনি, যার জন্য তোমায় ডাকা যেত না। লজ্জার হার হেরেছে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে। এখন বোধোদয়-টয় কিছু হয়নি। তাহলে শুধুমাত্র হিমাচলপ্রদেশের ক্রিকেটার, এই যোগ্যতায় ঋষি ধাওয়ান, অস্ট্রেলিয়া দলে চান্স পায়? নাকি টি-২০ বিশ্বকাপের ভারত-পাকিস্তান ম্যাচও ধর্মশালায় হয়! অনুরাগ ঠাকুর অ্যান্ড কোং মোটামুটি অল্পদিনেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, ভারতীয় ক্রিকেট কোন পথে চলবে। সেইজন্যই তো যুবি তোমায় সাবধান করা। অথবা বলতে চাওয়া। কোনওরকমে এই অস্ট্রেলিয়া সিরিজটা খেলে এসো। তারপর পারলে টি-২০ বিশ্বকাপটা খেলে দাও। ব্যাস, তারপর দুগ্গা-দুগ্গা বলে ক্রিকেটকে বিদায় জানাও। হেজেলকে নিয়ে নতুন সংসার করো। এঁদের কলকাঠি নাড়ার উপরেই নিজেকে নিয়ে যেও প্লিজ। সবাই এবি-র কথা বলে। অথচ, আমরা বলি না, তুমিও শুধু ক্রিকেট নয়, কত খেলাই তো কত ভালো খেলো। তুমি তো রোলার স্কোটিংয়ে আন্ডার ফোরটিন ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নও। তুমি যে বরাবরাই ডাকাবুকো। ছেলেবেলায় আব্দার করে বলেছিলে, সাইকেল কিনে দিতে। প্রথম চাপাতেই মেরেছিলে রিক্সার পিছনে ধাক্কা! বন্ধু কিনে এনেছিল এয়ার গান। গুলি চালিয়েছিলে কিনা তারই পেটে! সেই তোমার যখন ক্যানসার ধরা পড়ল, মনে হতো, তোমার কিস্যু হবে না। তুমি দেখিয়েও দিয়েছিলে। ক্যান্সারকে জয় করে মাঠে ফিরেছো।

এক বছর আট মাস দলের বাইরে থাকার পর ফের জাতীয় দলে ডাক পেলে। বুঝিয়ে দিয়েছো, ফিরে আসার উত্তেজক গল্প শুধু তোমার ক্যাপ্টেন মহারাজের একার নয়। ফিরে আসার এক ডজন (১২) রোমহর্ষক গল্পের আসলি ডালি তো রয়েছে যুবরাজের জীবনে। গুলজারও বোধহয় তাই যুবরাজের গানটা লেখার সময় তোমার কথাই ভেবেছিলেন। তাই লিখেছিলেন ওই লাইনগুলো। যা হয়তো এখন হেজেল তোমার জন্য গাইছে --আজা ম্যায় হাওয়া পে বিঠাকে লে চলু/ তুহি তো, তুহি তো মেরি দোস্ত হ্যায়... হ্যাঁ, যুবরাজ অস্ট্রেলিয়ায় নিজের জাতটা শেষবার আর একটু চিনিয়ে দিও। তারপর নতুন এই জীবনেই স্বেচ্ছায় হারিয়ে যেও।
(তোমায় ভোলার মতো প্রখর বুদ্ধি না থাকা এক অনুরাগী)

.