সন্ত্রাসের জন্য ইসলামকে দায়ী করা 'বোকার স্বর্গে মুর্খের বাস'

Updated By: Jul 5, 2016, 02:30 PM IST
সন্ত্রাসের জন্য ইসলামকে দায়ী করা 'বোকার স্বর্গে মুর্খের বাস'

সৌরভ পাল 

২০১৩- ১৫-ফেব্রুয়ারি-কুপিয়ে খুন ব্লগার রাজীব হালদার। 
২০১৫-২৭-ফেব্রুয়ারি-একুশে আন্তর্জাতিক বইমেলায় ঢাকার রাজপথে খুন ব্লগার অভিজিৎ রায়। 
২০১৫-৩০-মার্চ-ঢাকার রাস্তায় খুন ২৬ বছ বয়সী ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান
২০১৫-১২-মে-সিলেটে খুন মুক্তমনা ব্লগার বিজয় দাস। 
২০১৫-৮-আগস্ট-ঢাকায় খুন ব্লগার নিলয় চট্টোপাধ্যায়। 
২০১৫-২৮-সেপ্টেম্বর-ঢাকায় খুন ইতালীয় নাগরিক সিজার ট্যাভোলা।  
২০১৫-৩১-অক্টোবর-ঢাকায় খুন প্রকাশক ফয়জল আরফিন দীপন। 
২০১৬-২১-ফেব্রুয়ারি-হিন্দু পুরোহিতকে গলা কেটে খুন। 
২০১৬-৬-এপ্রিল-খুন ছাত্রনেতা নাজিমউদ্দিন।
২০১৬-২৩-এপ্রিল-খুন অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকি। 
২০১৬-২৫-এপ্রিল-সমকামী পত্রিকার সম্পাদক জুলহাজ মান্নানকে খুন। 
২০১৬-১-জুলাই-মন্দিরের সেবায়ত শ্যমানন্দ দাস সহ খুন এক বৌদ্ধ ভিক্ষুক।
২০১৬-১-জুলাই-গুলশানের হোলি আর্টিসন রেস্তোরাঁয় ৯ বন্দুকবাজের হানায় নিহত, ২০। 

আমি অপেক্ষা করতে শুরু করেছি। আরও একটা অঘটনের। বোমার শব্দ। অঝোরে ঝড়বে গুলি। মাথার ওপর দিয়ে প্লেন যাওয়ার বদলে আমি দেখব বুলেটের প্রতিযোগিতা। এক একটা বুলেট আমার শরীর ভিজিয়ে দেবে, রক্তে লাল হবে আমার সাদা পাঞ্জাবী। আকাশের কালো রঙ আর বাতাসে বারুদের গন্ধ। রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনিশ্চয়তা, জীবনের অনিশ্চয়তা।

আমি খুব চিন্তিত, আমি খুব হতাশ, আমি খুব মর্মাহত! না একটাও নয়। বাংলাদেশের হোলি আর্টিসন রেস্তরাঁর ঘটনা আমাকে একটুও নাড়া দেয়নি। বাংলাদেশের গুলশানে এখন শ্মশানের শান্তি। পড়ে থাকা মৃতদেহগুলোর শেষ আর্তনাদ একটুও কষ্ট দেয়নি। ২০টি তাজা প্রাণ গোলাপের পাপড়ির মত ঝড়ে পড়ল, আমি একটুও বিচলিত নই। লাশকাটা ঘরের সেই ডোম অথবা শ্মশানের সেই চণ্ডাল আর আমি 'আজ' সমগোত্রীয়। হাহাকার আর হতাশার আবদ্ধ ঘর থেকে আমি মুক্ত বিহঙ্গ, ডানা ঝাঁপটানো সেই চিল, আরও মৃত্যুর খবরের অপেক্ষা করছি। খবরের কাগজের বড় বড় শিরোনাম, গোগ্রাসে গিলব, আমি সেই চিল। আমি আরও আরও মৃত্যু দেখব বলে আজও জেগে আছি। আমার রক্ত চক্ষু লাল টক টকে। আমার চোখে তাকাও। তোমাকে বলছি, হে নর পিশাচ। বুদ্ধি বেঁচে খাওয়াদের দল আমার দিকে তাকাও। 'এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়', না, আমি সে কথা বলব না। অস্বীকার করব না, তোমাদের মধুচন্দ্রিমা আর তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে থাকা। আমি আয়না, আমার মুখোমুখি দাঁড়াও, হে শান্তি মানব। হে জেগে ওঠা মহামানব আমার সম্মুখে দাঁড়াও।  

হঠাৎ কোনও এক শনিবারে ঘটে যাওয়া অঘটন গুলশানের নাম বদল করে 'গুলিশান' করে দিয়ে চলে গেল! শনির রাতের কালো মেঘ রবিবারের সকালে কেটে গিয়েছে। 'থান্ডারবোল্ট অপারেশনে সব ঠাণ্ডা'। আয়োজন হবে সারি সারি মোমবাতির, কখনও বাড়বে হাতের সংখ্যা, কখনও কমবে। একজন বাঙ্গালিও মরেনি। কলমা পড়েই জীবন জিতে নিয়ে এসেছে একজন। কেউ বেঁচে ফিরছে স্রেফ মোবাইলে বাঙালি বাবার ছবি দেখিয়েই! এক ভারতীয় তরুণীসহ আরও ১৯ বিদেশি বেলারুশের রেস্তোরাঁ, 'হোলি আর্টিসন'-এ হঠাৎ লাশ হয়ে যাওয়ার কাব্য লিখল 'ওরা' কয়েকজন। 'লাশগুলো আমরা রাখবো কোথায়?' লাশকাটা ঘরে উপচে পড়া ভিড়ে ঠাই নেই ওদের। মৃতদের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে কান্না। হেরে যাচ্ছে বার বার শান্তি, সন্ত্রাসের কাছে। এটাই কি প্রথম? 

শনিবার রাত পর্যন্ত সেটাই ছিল শেষ! সন্ত্রাসের বাক্য গঠন এখনও চলছে, দাড়ি নেই, অবিশ্রান্ত 'কমা'র কোনও ক্লান্তি নেই। হামলার দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট। গোটা বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় আর মুখে মুখে ইসলামিক মৌলবাদের বিরুদ্ধে চোয়াল চাপা রাগ। জোয়ারে নদীর ফুঁসে ওঠার মতই বেড়ে চলেছে বিদ্রোহ। কার বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ? ইসলামের বিরুদ্ধে? ধর্মের বিরুদ্ধে? জাতির বিরুদ্ধে? গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে? যদি এই সবকটির একটিও হয়ে থাকে, চূড়ান্ত ভুল হবে। কেন? সামনে রাখছি কয়েকটা প্রশ্ন-

গুলশানের ঘটনা কি এই প্রথম?
সাম্প্রাদায়িক মৌলবাদ আর ইসলামিক সন্ত্রাস-এই দুটি কি একই?
সন্ত্রাস বা উগ্রবাদ, সারা বিশ্বজুড়ে এদের কি কোনও 'ধর্ম' (রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ধর্ম) নেই? 

কোথাও একটা ভুল হচ্ছে! সন্ত্রাসের ওপর ধর্মীয় চাদর চাপিয়ে শ্রেণী বৈষম্যকে অস্বীকার করার চক্রান্ত হচ্ছে না তো? আচ্ছা, গোটা বিশ্বকে যদি ভয় দেখাতেই হয়, তাহলে মূলত মুসলিম প্রধান দেশ বাংলাদেশকেই কেন বেছে নেওয়া হল? প্যারিসের শার্লি এবদো, তুরস্ক, ইস্তানবুলের বিমানবন্দর, রক্তাক্ত ফুটবল সবই তো ঘটছিল! হঠাৎ তৃতীয় বিশ্বেই অসুখ ছড়িয়ে দেবে বলে ঠিক করল আইসিস! বাংলাদেশই যখন তাহলে, কেন ধানমন্ডির মত জনবহুল এলাকা নয় কেন? গুলশানের মত শুনশান এক 'শ্মশান'কে আরও একবার শ্মশান বানিয়ে দেওয়ার পিছনে মোটিভ কী? চোখ মুছুন, কান্না ভুলে ভাবতে শুরু করেন! এখনই। গোড়ায় গণ্ডগোলটা বেঁধে রয়েছে। বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত বলে কিছু আছে? বিশ্বাস করেন? এক দিকে উচ্চবিত্ত আর অন্যদিকে রিক্সওয়ালা, অটোওয়ায়াল, শ্রমিক-চাষীদের ভিড়ে শ্রেণী বিভাজন একেবারে স্পষ্ট। বাংলাদেশের গুলশানে যতবার পা পড়েছে, দেখেছি আকাশভেদ করা উঁচু উঁচু বিল্ডিং। বিদেশের নামকরা ব্র্যান্ডের গাড়ির শোরুম থেকে শুরু করে কী নেই? অডি, ফেরারি, মিতসুবিসি, মার্সিডিজ চোখের পলকেই দেখা যায়। কেউ রিক্সা চাপে না। গাছে মোড়া রাস্তা। শুন-শান ফাঁকা বাইপাস। একটাও লোক নেই। রাস্তাগুলোর পাশেই একের পর এক চেক পোস্ট। ভিভিআইপি রিজিওন। সবার প্রবেশ অলিখিত ভাবে লেখা নিষেধ। ধানমন্ডিও তো বড়লোকের জায়গা, কিন্তু সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। গুলশান বরাবরের হোয়াইট কলারদের বাসভবন। ঢাকার শীততাপ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল। প্রাণকেন্দ্র নয়। এমন এক স্থান বেছে নেওয়ার কারণটা, 'উচ্চবিত্তদের টার্গেট' নয় কি? ভুলে গেলে চলবে না, রাষ্ট্রবঞ্চনার ইতিহাসও। ব্লগার খুন ছিল 'স্পেসিফিক টার্গেট', হোলি আর্টিসন 'প্ল্যান্ড মাস কিলিং'।   

ঢাকায় যখন বিডিআর রাইফেলস স্কোয়ারের মধ্যে গৃহযুদ্ধ, সেবার আমি ঢাকায়। কার্ফু দেখেছিলাম। যুদ্ধ ট্যাঙ্কের রাস্তার ওপর সাপের মত গড়িয়ে চলা দেখেছিলাম। আমার এক দাদার বাড়িতে দেখেছিলাম মাটির ওপর পড়ে থাকা কার্তুজ। যুদ্ধের ক্ষত চিহ্ন আজ নেই, তবে ইতিহাস রয়ে গিয়েছে নাম বদলে। রাতারাতি এক শপিং মলের নাম রাইফেল স্কোয়ার থেকে হয়ে গিয়েছিল সীমান্ত স্কোয়ার। সেদিন যুদ্ধ থামিয়ে 'বুদ্ধ'কে হাসানো গিয়েছিল, আজও কি তাই হবে?   
 
'আমি বিশ্ব নাগরিক', চার্লি চ্যাপলিনের এই কথটা ক্ষয়িষ্ণু হওয়ার পথে। যেখানেই যাই যেন এক অনিশ্চয়তা! এটাই শেষ নয়ত... উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে কোন অস্ত্রে শান দিলে হবে জয়? 'টু কমব্যাট কমিউনালিসম দেয়ার ইজ অনলি ওয়ান ওয়ে-ইন্টেলেকচুয়াল রেজিসটেন্স'। হ্যাঁ, 'প্রোগ্রেসিভ অল্টারনেটিভ অ্যালায়েন্স' পারে এই সমস্যার মোকাবিলা করতে। তবে, সেটা অবশ্যই হতে হবে কালেক্টিভ অর্থাৎ সমষ্টিগত উপায়ে। যতক্ষণ সৃষ্টিশীল মানুষ স্বাধীন হবেন না, ততদিন কেবল সেনাবাহিনী দিয়ে সন্ত্রাসকে হারানো যায় না। আগেও সম্ভব হয়নি, এখনও হয়নি, আগামীতেও সম্ভব নয়!   

(উল্লেখ্য, ২০ বছর বয়সী এক বাঙালিকেও হত্যা করে জঙ্গিরা। তারিশি জৈনের বন্ধু ফারাজ আয়াজ হুসেনকে ছেড়ে দেওয়া হলেও বন্ধুদের ছেড়ে জীবন বাঁচাতে অস্বীকার করেন তিনি। বন্ধুত্বের নজির স্থাপন করে মৃত্যুকেই আলিঙ্গন করেন আয়াজ হুসেন। এই তথ্য পাওয়া যায় ওই স্থান থেকে দেহ উদ্ধার হওয়ার পর। লেখা অপরিবর্ততই রাখা হল)

.