বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে...

আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। বাঙালির পক্ষে বড় শ্লাঘার দিন। ৬০ বছর আগের এই দিনটিতেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার সমঅধিকার (উর্দুর পাশাপাশি) চেয়ে ঢাকার রাজপথে নেমেছিল বাঙালি ছাত্রসমাজ। আর তার জবাবে জুটেছিল বুলেট। রফিকউদ্দিন আহমেদ, আবদুস সালাম, আবুল বরকত, আবদুল জব্বারের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর।

Updated By: Feb 20, 2012, 11:54 PM IST

সায়ন ত্রিপাঠী
আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। বাঙালির পক্ষে বড় শ্লাঘার দিন। ৬০ বছর আগের এই দিনটিতেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার সমঅধিকার (উর্দুর পাশাপাশি) চেয়ে ঢাকার রাজপথে নেমেছিল বাঙালি ছাত্রসমাজ। আর তার জবাবে জুটেছিল বুলেট। রফিকউদ্দিন আহমেদ, আবদুস সালাম, আবুল বরকত, আবদুল জব্বারের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। শুধু তাই নয়, ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে যে স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলা হয়েছিল, ২৬ ফেব্রুয়ারি গুঁড়িয়ে পূর্ব-পাকিস্তানি সশস্ত্র পুলিসবাহিনী। পাকিস্তানের তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী ফজলুর রহমানের সদম্ভ ঘোষণা ছিল, "বাংলাকে যারা রাষ্ট্রভাষা করতে চায় তারা দেশদ্রোহী। আর দেশদ্রোহিতার উপযুক্ত জবাবই তাদের দেওয়া হবে"।
পশ্চিম পাকিস্তানের বাঙালি বিদ্বেষী শাসকবর্গের বশংবদ গভর্নর খাজা নিজিমুদ্দিনের নির্দেশে এই নির্মম পুলিসি দমনপীড়নেরও কিন্তু বন্ধ হয়নি মাতৃভাষায় অধিকার রক্ষার জন্য বাঙালির মরণপণ লড়াই। আর তারই পরিণতিতে এসেছিল সাফল্য। ১৯৫৪ সালে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা`র দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন রওয়ালপিন্ডির নীতি নির্ধারকরা। এরও দু`বছর পর ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারী পাক সংবিধানের ২১৪(১) অধ্যায়টি সংশোধন করে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে লেখা হয় "The state language of Pakistan shall be Urdu and Bengali"। ভাষা আন্দোলনের এই উজ্জ্বল অধ্যায়ের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অবশ্য এসেছিল আরও সাড়ে চার দশক পর। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসঙ্ঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলিতে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এর পর ২০১০-এর ২১ অক্টোবর রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করার জন্য একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়। অবশ্য তার অনেক আগেই, ১৯৭১ সালে একমাত্র বাংলাভাষী রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে বাংলাদেশের।
কিন্তু বাত্‍সরিক এই ভাষা মহোত্‍সবের অনুষঙ্গে বাংলা ভাষায় ভবিষ্যত্‍ পর্যালোচনা করলে যে ছবিটা চোখের সামনে ফুটে ওঠে, তা বোধহয় আশাব্যঞ্জক নয় তেমন। বিশ্বের ষষ্ঠ স্থানাধিকারী পৌনে তিন কোটি মানুষের মাতৃভাষার পরিসর উত্তরোত্তর বিবর্ধিত হচ্ছে, না কি সঙ্কুচিত, তা নিয়েও যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, নতুন প্রজন্মের `গ্লোবাল` বাঙালিদের মধ্যে বাংলা ভাষায় মর্যাদা, গরিমা আরা গুরুত্ব নিয়েও। কারণটা তেমন দুর্বোধ্য নয় আদপেই। আসলে বিশ্বায়ন আর মুক্ত অর্থনীতির এই বাজারে ভাষা এখন অর্থোপার্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর জীবনধারণের অনিবার্যতার সেই কানাগলিতে ক্রমশ যেন পথ হারাচ্ছে মাতৃভাষায় প্রতি বাঙালির চিরায়ত আকর্ষণ। সন্তানের ভবিষ্যতের ভাবনা থেকে এ যুগের বাঙালি অভিভাবকেরা আজ পড়াশোনার মাধ্যমে হিসেবে মাতৃভাষার প্রতি ভরসা রাখতে পারছেন কি তেমন করে? ভাষা আন্দোলনের হীরক জয়ন্তীর সমারোহের উল্টোপিঠে থাকা এই উদ্বেগের এই ছবিটাও কিন্তু একইভাবে প্রাসঙ্গিক। মাতৃভাষা বিপদাপন্ন হলে কিন্তু জাতির অস্তিত্ব-সঙ্কটও অনিবার্য হয়ে পড়ে।

.