সৌমিতা মুখোপাধ্যায়: মায়ের মৃত্যুর পর মাত্র ১৫০০ টাকা হাতে নিয়ে দিল্লি থেকে মুম্বইয়ে পা রেখেছিলেন মধ্যবিত্ত পরিবারের এক ছেলে। কোনও তারকা হয়ে ওঠার স্বপ্ন নয়, শুধুমাত্র নিজেকে দেখতে চেয়েছিলেন পর্দায়। তবে অতই কী সহজ? তিনি যে অভিনেতা হতে পারেন পরিবারের কারোরই সেই ভরসা ছিল না। কিন্তু তিনি তো জেদি তাই স্কুল জীবন থেকেই অভিনয়ে হাতেখড়ি করে নিয়েছিলেন নিজেই। শুধুমাত্র তাঁর মা ভরসা রেখেছিলেন তাঁর উপর। গর্ব করে সকলকে বলতেন, 'ছেলে আমার দিলীপ কুমার হবে।' মুম্বইয়ে পৌঁছে যখন পোর্টফোলিও নিয়ে ঘুরছেন প্রযোজক পরিচালকদের দরজায় দরজায়, তখন অনেকেই তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন 'তোমায় খারাপ দেখতে'। হার মেনে ফিরে যাননি দিল্লিতে। কারণ রাজা হওয়াই তাঁর ভবিতব্য। তিনি কিং অফ বলিউড, শাহরুখ খান।
Add Zee News as a Preferred Source
আরও পড়ুন- Shah Rukh Khan's 60th Birthday: ভাঙবেন প্রথা নাকি জন্মদিনে মন্নতের বাইরেই দর্শন দেবেন? জানিয়ে দিলেন শাহরুখ...
টিনেজ কাটিয়ে এমন এক শহরে শাহরুখ এসে পড়লেন যেখানে আছে গ্ল্যামারের ঝলকানি, আবার সেই শহরের অলিতে গলিতেই লুকিয়ে আছে ব্যর্থতার, হারিয়ে যাওয়ার, স্ট্রাগলের এমন কাহিনী যা ডার্ক থ্রিলারের থেকে রহস্যময়। তবে যাঁর নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে তিনি এসবের তোয়াক্কা করেন না। নানা সাক্ষাত্কারে তিনি বলেন, 'মা বলতেন, তোমার চাহিদার থেকে বড় স্বপ্ন দেখো, তাহলেও বড় হতে পারবে।' তাই হয়তো একটা সামান্য নামকে নেমপ্লেট করে তোলার কঠিন যুদ্ধে বেশি কিছু না ভেবেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তিনি। কারণ তিনি জানতেন যে তিনি তো সেই ফিলগুড স্বপ্নের ফেরিওয়ালা, আশ্চর্য তাঁর খোয়াবনামা, অধিবাস্তব তাঁর জীবন কাহিনি।
ছোটপর্দা থেকেই কেরিয়ার শুরু হয় শাহরুখের। কিন্তু যিনি রাজা হতে এসেছেন, তাঁকে থামিয়ে রাখা কি এত সহজ! সেকেন্ড হিরো হিসাবে সিনেমার দুনিয়ায় পা রাখলেও, একের পর এক ব্লকবাস্টার ছবি উপহার দিয়ে তিনি প্রমাণ করেন তিনিই বক্স অফিসের 'কিং'। ধীরে ধীরে বিশ্বায়নের দুনিয়ায় সারা পৃথিবীতে ভারতীয় সিনেমার, সংস্কৃতির বাহক হয়ে উঠলেন তিনি। বিশ্বের দরবারে সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ভারতের অন্য নাম হয়ে উঠলেন তিনি। ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে তাঁর অতি সাধারণ নামকে স্বর্ণাক্ষরে লিখেছেন দিল্লির মধ্যবিত্ত পরিবারের এই ছেলে, যা এখন অস্বীকার করার ক্ষমতা ইতিহাসেরও নেই। নব্বইয়ের দশকের ভারতীয় দর্শক যখন রুপোলি পর্দায় পৌরুষের ধারণাকে নতুন মোড়কে দেখতে চাইছিলেন, ঠিক সেই সময়েই বলিউডে আবির্ভাব হল এই নতুন 'নায়ক'-এর। তিনি ব্যর্থ প্রেমিক দিলীপ কুমারও নন, আবার সমাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো 'অ্যাংরি ইয়ং ম্যান' অমিতাভ বচ্চনও নন। তিনি হয়ে উঠলেন এমন এক ধারণা, যিনি বিশ্বায়নের চাকচিক্য এবং ভারতীয় সংস্কৃতির সংমিশ্রণ।
শাহরুখ একই সঙ্গে এমন এক চরিত্র হয়ে উঠলেন, যে আরিয়ান হয়ে গুরুকুলকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে, আবার সেই দিওয়ানা বা বাজিগর-ও হতে পারেন যিনি তাঁর স্বদেশ গড়তে বদ্ধপরিকর। তিনি পর্দায় ধরা দিলেন এক 'সুখস্বপ্ন' হয়ে। শুধুমাত্র সাফল্য নয়, ব্যর্থতাও এসেছে তাঁর জীবনে। কিন্তু সেই ব্যর্থতাকেই পাথেয় করে তিনি অপ্রতিরোধ্য 'বাদশাহ' হয়ে এগিয়ে চলেছেন তিনি। যখন টানা দশ বছর তাঁর ছবি ব্যর্থতার মুখ দেখেছে, বাথরুমে লুকিয়ে কান্নার কথা নিজেই বলেছেন সাক্ষাত্কারে, কারণ তাঁর কাছ থেকেই ভারতীয় পুরুষ বুঝেছে 'মর্দ কো ভি দরদ হোতা হ্যায়'। তিনিই পর্দায় ভারতীয় পুরুষদের শিখিয়েছেন, নারীকে সম্মান করাই আসল পৌরুষত্ব। আপামর ভারতীয় নারীর কাছে তিনি হয়ে উঠেছেন স্বপ্নের পুরুষ। আপামর ভারতীয় কাছে তিনি সেই উদাহরণ, যে জীবনে কাজের প্রতি নিষ্ঠা থাকলে যেকোনও উচ্চতা ছোঁয়া যায়।
আরও পড়ুন- Tv actor Riju Biswas: একাধিক মহিলাকে চ্যাটে 'কুপ্রস্তাব' ঋজুর! 'শাড়ি পরে ভালো লাগে, কথাটা অশ্লীল?' প্রশ্ন অভিনেতার...
ব্যক্তিগত জীবনেও এসেছে ঝড়। সামলে উঠেছেন, সামলাতে তো হবেই, কারণ তাঁর পাশে ছিল গোটা ভারত। তিনি ভরসা রেখেছেন তাঁর দর্শকের উপর। তিনি জানতেন, একদিন তিনি সব ফিরে পাবেন। ২০২৩ বদলে দিল সব সমীকরণ। একবছরে তিনটে ব্লকবাস্টার, রাজা হয়ে ফের জ্বলে উঠলেন পর্দায়। সেদিন তাঁর চোখের জল মুছেছিল গোটা ভারত কারণ 'ভারত মানেই শাহরুখ খান'। একাধিক সাক্ষাত্কারে জাভেদ আখতার, অনুরাগ কাশ্যপ থেকে শ্রেয়া ঘোষাল বলেছেন, ভারতের বাইরে সবাই বোঝেন ভারত মানেই শাহরুখ। তাই তো মেটগালায় তাঁর একঝলক পেতে ভীড় জমা হয় ভোর রাত থেকে, বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তিনি আসবেন এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই সকাল থেকে লাইন পড়ে। দুয়া লিপা, এড শিরান থেকে এনরিকে, জন সেনা- ভারতে পা রেখেই দেখা করতে চান একজনের সঙ্গেই, তিনি শাহরুখ খান, এমনই তাঁর করিশ্মা।
বলিউডে তিন দশক কাটিয়ে তিনি আজ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারেন— "আপনি খুব ভালো হতে পারেন, আপনি সেরা হতে পারেন কিন্তু আমি তার থেকে আরেকটু ভালো।" দীর্ঘ ৩০ বছর ইন্ডাস্ট্রিতে কাটিয়েও তিনি যখন বলেন, "এখন আর নিজেকে সেরা আমি বলি না কারণ সারা পৃথিবী সেটা মানে", তখন তা বিনয় নয়, বরং তাঁর বিশ্বব্যাপী স্টারডম-কেই তুলে ধরে। শাহরুখ খান তাই শুধু একজন অভিনেতা নন, তিনি ভারতীয় সিনেমার এক সাংস্কৃতিক আইকন, যিনি বাস্তবের চেয়েও বড় এক স্বপ্ন হয়ে বিরাজ করছেন দর্শকের হৃদয়ে। কিং খানকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
(দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির টাটকা খবর, আপডেট এবং ভিডিয়ো পেতে ডাউনলোড-লাইক-ফলো-সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের App, Facebook, Whatsapp Channel, X (Twitter), Youtube, Instagram পেজ-চ্যানেল)