সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
ফটিকের ফ্যাতাড়ু পদপ্রাপ্তি

এমনিতে রবীন্দ্রনাথের 'ছুটি' গল্পের নায়ক 'বালকদিগের সর্দার' ফটিক চক্রবর্তীর মাথায় আশ্বিনের হলদে রোদ পড়লেই দুষ্টু বুদ্ধি খেলে যায়; লেখাপড়া বাহুল্য মনে হয় ও সে দূর পল্লীতে মার কাছে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কিন্তু এবার ওয়াকিবহাল মহলের মতে পরিস্থিতি চাঞ্চল্যকর। সুতরাং, কি জানি কেন, সে দেশের বাড়ির জন্য রওনা হয়েও ফিরে আসে। আসলে গোপন সূত্র থেকে জানা যায় যে ফটিক সেলিব্রিটি হওয়ার দিকে পা বাড়িয়েছে।

উৎস সেই খুঁটি পুজো। ফটিকের কোনও খুঁটি ছিল না তবু মামার বন্ধু কনসালট্যান্ট রমারঞ্জন মালাকারকে তুষ্ট করে সে অনুষ্ঠানে নজরুলের সুরে স্বরচিত একটি কীর্ত্তন গায়, কচিকাঁচাদের মধ্যে অবিরাম জিলিপি ভক্ষণ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে; পরিশেষে জয়ীদের হাতে কৃষ্ণনগরের পুতুল হিসেবে ডি.এল. রায়ের একটি আবক্ষ মূর্ত্তি তুলে দেয়। কালীঘাটে কেউই ডি.এল. রায় বিষয়ে তেমন কিছু জানে না। ওদের ধারণা হয় ডি.এল. রায় সম্ভবত বিধান রায়ের খুল্লতাত। ফলে সভাপতি তাকে তচ্যাঙ্কররত্ন উপাধি দেন। এরপর পুজোর উদ্বোধনে যুব সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ত্ব হিসেবে তার প্রতিভা আরও বিকশিত হওয়ার কথা।

এখন তো মহালয়ার পরের দিন থেকেই উদ্বোধন। কিন্তু ফটিক-দরদী সভাপতি বিনা নোটিশে অম্লশূলের বেদনায় শয্যাগত হওয়ায় প্রসিদ্ধ ত্রিপল ও পিচচট ব্যবসায়ী বিরোধী গোষ্ঠীর জনহিতৈষী শ্রী সুবল চন্দ্র ঘরামিকে দীপ প্রজ্জ্বলনের দায়িত্ব নিতে হয়।

প্রতিমা উদ্বোধনের সন্ধ্যা। 'যাদের না হলে চলবে না' সেই বুবু, টুপাই, ঝুলন, টুসকিরা চন্দনের ফোটা পরে ঘোরাঘুরি করে। মঞ্চে টিপু সুলতান ও নেতাজীর ব্যাকড্রপ। ভারতমাতা তাদের আশীর্বাদ করছেন। সভাপতি ও মন্ত্রীর নাম থার্মোকল কেটে লেখা রয়েছে। পাড়ার গৌরব রক্ষার্থে ইংরেজি অক্ষরে তাদের নাম জ্বলজ্বল করে। পুলিস জানায় মাননীয় পশুপালন মন্ত্রীর স্করপিও দেশপ্রিয় পার্ক পার হয়ে রাসবিহারী অভিমুখে। ফটিক চট করে এদিক ওদিক দেখে সভাপতির পদবী থেকে 'G' অক্ষরটি সরিয়ে দেয়। নানা হৈ-হট্টগোলে প্রেসিডেন্ট তো বটেই ভলিন্টিয়াররাও খেয়াল করে না যে অক্ষরলুপ্তি আরও বড় সাংস্কৃতিক সংকট ডেকে আনতে চলেছে।

( 1 )


'আমরা বেঁধেছি কালের গুচ্ছ আমরা বেঁধেছি শেফালি মালা'-র বদলে শেষ ক্যাসেটের 'ধূম মচা দে' বাজতে থাকে।

মন্ত্রীর তাড়া আছে। সভা শুরু হয়। অ্যাঙ্কর রত্ন বলেন দেশগৌরব মাননীয় শ্রী সুবল (এখানে ঈষৎ তোতলায়) হারামির সুযোগ্য নেতৃত্ত্বে 'কালীঘাট জ্যোতি'-র মঞ্চ অধিকতর জ্যোতির্ময় হয়ে উঠবে। জনতার মধ্যে চাঞ্চল্য- মন্ত্রী গলা খাকারি দেন। কিন্তু ইতিমধ্যে ফুলদানি সরিয়ে 'G' বসাতে গিয়ে জনৈক স্বেচ্ছাসেবী হোচট খেয়েছে। সিচুয়েশন, যাকে বলে, গুরুচরণ।

সুতরাং আইনশৃঙ্খলার অবনতি রুখতে প্রতিমার দ্রুত আবরণ উন্মোচনের ব্যবস্থা করা হয় সভাপতির নেতৃত্ত্বে। পরে বরং একসঙ্গে ভাষণ ও রবীন্দ্রসংগীত হবে। পর্দা সরে যায়। দশভূজার পদতলে দুটি অসুর। দর্শকবৃন্দ ভাবাবেগে আলোড়িত বাকরহিত স্থিরচিত্রের মত। হয়েছিল কি ক্লাবের বডিবিল্ডার নকুল মান্নাকে একটা 'চান্স' দেওয়ার কথা দিয়েছিল ফটিক। তাঁর হাতে গোড়ে মালাও দেওয়া হয়েছিল বিশিষ্ট অতিথিদের বরণের জন্য। চমক আর কি! সে তৈলাক্ত দেহে ও রোমশ বুকে দুটি মালা সভাপতি ও পশুপালন মন্ত্রীর কণ্ঠে ঝুলিয়ে দেয়। অনুষ্ঠানের সিকোয়েন্স নষ্ট যাওয়ায় হালদার সাউন্ড ঘাবড়ে যায়। 'আমরা বেঁধেছি কালের গুচ্ছ আমরা বেঁধেছি শেফালি মালা'-র বদলে শেষ ক্যাসেটের 'ধূম মচা দে' বাজতে থাকে।

অতঃপর সুবলবাবুর মূর্চ্ছা ও পতন। ফটিকের নাটকীয় অন্তর্ধান। এরপরে কি হইল তা জানার কথা ছিল শ্যামলালের। তবে মিডিয়া জানায় সূচনার ছোটখাটো ত্রুটি সত্ত্বেও এলাকার প্রতিটি ফ্ল্যাট 'বেড সাইড সাউথ ওপেন উইথ বেডসাইড সুইমিং পুল' হওয়ায় দেবী আরও কিছুকাল কৈলাসে যাওয়া মুলতুবি রেখে, সানন্দে ও সপরিবারে মণ্ডপে অধিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেন। স্পনসরের অভাব হয়নি। ফ্যাতাড়ু সমাজে ফটিকের স্থায়ী সদস্যপদ প্রাপ্তিতে আর কোনও অন্তরায় থাকে না।



( 2 )

Table of Contents