চৈতালী চট্টোপাধ্যায়
সর্বভূতেষু
ছোটবেলায় জানতাম কালী মা-র ভাণ্ডারে অনেকরকম ভূত প্রেত, ডাকিনী যোগিনী আছেন। আর, ভূতচতুর্দশী ব্যাপারটাই তো একটা গা-ছমছমে রহস্য। কালীঠাকুরের ভূত তৈরির যে ফ্যাক্টরি আছে, কালীপুজোর আগের দিনটা হল গিয়ে তার সেকেন্ডস আউটলেটের মতো একটা দোকানবাজার, নানা নড়বড়ে, একটু খুঁতওয়ালা ভূত নড়েচড়ে বেড়ায়, যেখানে! এমনটাই মনে হত তখন। ভাবতাম চোদ্দ প্রদীপের চেয়ে আরও বেশি-বেশি করে আলো জ্বালিয়ে দি, বরং!
সে যাকগে। কথা হচ্ছে, দেবীপক্ষ নিয়ে। তা, যখন ব্রাহ্মমুহূর্তে, রেডিওতে গমগম করে বাজছে, ইয়া দেবি সর্বভূতেষু, মাকে জিগ্যেস করলাম, 'সবরকমের ভূত টুতও নামে বুঝি, পুজোর পাঁচদিন ঘিরে?' মা, ভক্তি-আচ্ছন্ন গলায় বুঝিয়ে দিলেন, 'না না, এর মানে দেবী সর্বভূতে, অর্থাৎ সবেতেই বিরাজমান।' বুঝলাম বটে, কিন্তু খুব একটা যে স্বস্তি পেলাম তা তো নয়! তার মানে, এই দেবীপুজো জুড়ে দুর্গামা সবকিছুই দেখছেন, স্বয়ং মর্তধামে এসে। আমি কী কী দুষ্টুমি করছি, পুজো অবকাশের কাজ পরে করব বলে, খাতা বেমালুম লোপাট করে দিচ্ছি, কৃষ্ণা, মধুশ্রীদের চেয়ে আমার জামার সংখ্যা কম হয়েছে এবার, বলে হিংসেয় জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছি, পারলে ওদের নতুন জামায় ফাউন্টেন পেন ছিটিয়ে কালি ছড়িয়ে দিই আর কী, এই সব অসভ্যতামোই তো মা প্রত্যক্ষ করছেন! এমনিতেই, কথিত আছে, মীনগণ হীন হয়ে থাকে সরোবরে, আর আমি এতটা 'মিন' হয়েও দিব্যি সেজেগুজে অষ্টমীপুজোর অঞ্জলি দিতে পুজো প্যান্ডেলের লাইনে দাঁড়াচ্ছি! বাপরে! ক্লাস টু-থ্রি-র সেই আমি, ভয়ে একটু কুঁকড়ে যেতাম বই কী।
কিশোরীকালে, দুর্গাপুজো-কনসেপ্ট একটু অন্যরকম-ব্যক্তিগত হয়ে উঠল যখন, যখন বুঝলাম মা দুর্গা তাঁর চালচিত্র আঁকা মণ্ডপ ছেড়ে সত্যি-সত্যি আমার কানমলা দিতে আসবেন না, তখন অস্বস্তিটা তৈরি হল আমার রক্তমাংসের মাকে ঘিরে। তিনিও সর্বভূতে বিরাজ করেন না যে, এই কথাটা হলফ করে বলা যেত না বিশেষ, কোন দৈববলে, সবই টের পেতেন তিনি। আমি অষ্টমী-নবমীর সন্ধেয়, মাকে বলেছি, ইন্দিরা, দেবারতিদের সঙ্গে প্যান্ডেল ঘুরে, রোল খেয়ে বাড়ি ফিরব, কিন্তু আসলে যে ইন্দ্রাশিস কিংবা দেবজ্যোতির সঙ্গে ঘুরতে গেছি, আমার মা নিজস্ব ত্রিনয়নবলে দিব্যি দেখতে পেয়ে যেতেন! ফলে দুর্গাপুজোর পাঁচদিন মার সঙ্গে লুকোচুরি খেলা চলত আমার।
সর্বভূতেষু
ছোটবেলায় জানতাম কালী মা-র ভাণ্ডারে অনেকরকম ভূত প্রেত, ডাকিনী যোগিনী আছেন। আর, ভূতচতুর্দশী ব্যাপারটাই তো একটা গা-ছমছমে রহস্য। কালীঠাকুরের ভূত তৈরির যে ফ্যাক্টরি আছে, কালীপুজোর আগের দিনটা হল গিয়ে তার সেকেন্ডস আউটলেটের মতো একটা দোকানবাজার, নানা নড়বড়ে, একটু খুঁতওয়ালা ভূত নড়েচড়ে বেড়ায়, যেখানে! এমনটাই মনে হত তখন। ভাবতাম চোদ্দ প্রদীপের চেয়ে আরও বেশি-বেশি করে আলো জ্বালিয়ে দি, বরং!
সে যাকগে। কথা হচ্ছে, দেবীপক্ষ নিয়ে। তা, যখন ব্রাহ্মমুহূর্তে, রেডিওতে গমগম করে বাজছে, ইয়া দেবি সর্বভূতেষু, মাকে জিগ্যেস করলাম, 'সবরকমের ভূত টুতও নামে বুঝি, পুজোর পাঁচদিন ঘিরে?' মা, ভক্তি-আচ্ছন্ন গলায় বুঝিয়ে দিলেন, 'না না, এর মানে দেবী সর্বভূতে, অর্থাৎ সবেতেই বিরাজমান।' বুঝলাম বটে, কিন্তু খুব একটা যে স্বস্তি পেলাম তা তো নয়! তার মানে, এই দেবীপুজো জুড়ে দুর্গামা সবকিছুই দেখছেন, স্বয়ং মর্তধামে এসে। আমি কী কী দুষ্টুমি করছি, পুজো অবকাশের কাজ পরে করব বলে, খাতা বেমালুম লোপাট করে দিচ্ছি, কৃষ্ণা, মধুশ্রীদের চেয়ে আমার জামার সংখ্যা কম হয়েছে এবার, বলে হিংসেয় জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছি, পারলে ওদের নতুন জামায় ফাউন্টেন পেন ছিটিয়ে কালি ছড়িয়ে দিই আর কী, এই সব অসভ্যতামোই তো মা প্রত্যক্ষ করছেন! এমনিতেই, কথিত আছে, মীনগণ হীন হয়ে থাকে সরোবরে, আর আমি এতটা 'মিন' হয়েও দিব্যি সেজেগুজে অষ্টমীপুজোর অঞ্জলি দিতে পুজো প্যান্ডেলের লাইনে দাঁড়াচ্ছি! বাপরে! ক্লাস টু-থ্রি-র সেই আমি, ভয়ে একটু কুঁকড়ে যেতাম বই কী।
কিশোরীকালে, দুর্গাপুজো-কনসেপ্ট একটু অন্যরকম-ব্যক্তিগত হয়ে উঠল যখন, যখন বুঝলাম মা দুর্গা তাঁর চালচিত্র আঁকা মণ্ডপ ছেড়ে সত্যি-সত্যি আমার কানমলা দিতে আসবেন না, তখন অস্বস্তিটা তৈরি হল আমার রক্তমাংসের মাকে ঘিরে। তিনিও সর্বভূতে বিরাজ করেন না যে, এই কথাটা হলফ করে বলা যেত না বিশেষ, কোন দৈববলে, সবই টের পেতেন তিনি। আমি অষ্টমী-নবমীর সন্ধেয়, মাকে বলেছি, ইন্দিরা, দেবারতিদের সঙ্গে প্যান্ডেল ঘুরে, রোল খেয়ে বাড়ি ফিরব, কিন্তু আসলে যে ইন্দ্রাশিস কিংবা দেবজ্যোতির সঙ্গে ঘুরতে গেছি, আমার মা নিজস্ব ত্রিনয়নবলে দিব্যি দেখতে পেয়ে যেতেন! ফলে দুর্গাপুজোর পাঁচদিন মার সঙ্গে লুকোচুরি খেলা চলত আমার।
ব্যাস! বইয়ের পাতা উল্টোতে-উল্টোতে, আশাপূর্ণা দেবী, শিবরাম চক্রবর্তীর গল্পের ঢেউয়ে দুলে উঠত প্যান্ডেলের চাঁদমালা, শুরু হয়ে যেত আমার দুর্গোৎসব।
তবু, দেবীপক্ষে বোধহয় একধরণের মন্ত্রশক্তি চলে বেড়াত, আবহে। নরম রৌদ্রের মতো, বড়রা সকলেই কোমল মেজাজে হাসিখুশি থাকতেন। ফলে, আমাদের দোষও ধরতেন না বিশেষ। যেহেতু, একটা সময়, আমার দেশের বাড়িতে, মহা ধূমধাম সহকারে দুর্গাপুজো হয়েছে, বাবা-কাকারা খুব নস্ট্যালজিক মনে, মাঝেমাঝেই আমাদের ধরে শোনাতেন সেসব পুজোর গল্প। আমার ছোটবেলায়, প্রায়-সারাবছর জুড়ে পুজোসংখ্যা বেরোনোর চল ছিল না। এখন হয় যেমন! পুজোর ঠিক আগে আগে-আগে, দেবসাহিত্য কুটিরের থান ইট সাইজের বই, চলে আসত বাড়িতে। বড়দের পুজোসংখ্যাও আসত, সেই একই তালে। তারপর যে সেগুলো কোন আলমারির তাকে লোপাট করে দেয়া হত, মা মহামায়াই জানেন! আমি হাতে পেতাম, কলা বউ স্নান সেরে আসার পর, সেই মহাষষ্ঠির শুভদিনটিতে। ব্যাস! বইয়ের পাতা উল্টোতে-উল্টোতে, আশাপূর্ণা দেবী, শিবরাম চক্রবর্তীর গল্পের ঢেউয়ে দুলে উঠত প্যান্ডেলের চাঁদমালা, শুরু হয়ে যেত আমার দুর্গোৎসব।
লিখছি যখন এ-লেখা, নানা সেন্সরশিপ কানে আসছে, লালবাতির সংকেত জানিয়ে। মেয়েরা, পুজোয় খোলামেলা জামা পরবে না! মেয়েরা, রাত করে, পুজোয় ঠাকুর দেখে বাড়ি ফিরবে না! আরে! ভয়ংকর সব ভূত-প্রেত নেমে এল তবে! মাতৃশক্তির আরাধনায়, লড়াই করার শক্তি চেয়ে নিই, এবার?