কীভাবে পৌঁছলেন নিঃসঙ্গতার একশো বছর-এ? প্লিনিও আপুলেও মেনদোসাকে সেই দিনগুলির কথা বলেছিলেন গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। সেই সাক্ষাত্‍কারের তর্জমা করেছেন সুদীপ বসু। তারই কিছু নির্বাচিত অংশ।
আমার মনে হয়, মেয়েরা পৃথিবীকে ধরে রাখে


মেনদোসা: যখন 'নিঃসঙ্গতার একশো বছর' লিখতে বসলেন তখন আসলে আপনি কী করতে চাইছিলেন?

মার্কেস: আসলে আমি রূপ দিতে চাইছিলাম সেইসব অভিজ্ঞতা আর অনুভূতিগুলোকে, শৈশবে যারা আমাকে তোলপাড় করেছিল - আমি তাদের সাহিত্যে তুলে ধরতে চাইছিলাম।

মেনদোসা: অনেকে তো এই উপন্যাসকে মানব সভ্যতার ইতিহাসের প্রতীক বা নীতিগল্পমালা বলে মনে করে।

মার্কেস: না না নীতিকথাটথা নয়। আমি আসলে সাহিত্যের ফ্রেমে ধরতে চাইছিলাম আমার ছোটবেলাকে। আপনি জানেন আমার ছোটবেলাটা কেটেছিল সেই বিরাট বাড়িটাতে যেখানে আমার বোন মাটি খেত, আমার ঠাকুমা অনর্গল ভবিষ্যৎবাণী করে যেত আর অসংখ্য আত্মীয়স্বজন ঘুরে বেড়াত ছায়ার মতো-একই নামের- যাদের কাছে আনন্দ আর উন্মাদনার মধ্যে কোনও ফারাক ছিল না।

মেনদোসা: সমালোচকরা কিন্তু আরও জটিল সব ব্যাপারস্যাপারের খোঁজ পেয়েছেন।

মার্কেস: তেমন যদি কিছু পাওয়া যায় তো যেতে পারে- তবে সেটা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত, আমার দিক থেকে। আসলে সমালোচকরা সেইসব কিছুই খুঁজে পেতে চান, যা হয়তো আদতে নেই।

মেনদোসা: আমি ধরেই নিচ্ছি আপনি যখন উপন্যাসটা লিখছিলেন তখন কয়েকটি চরিত্র আপনার ইচ্ছের তোয়াক্কা না করে অন্যদিকে হেঁটেছিল। এরকম কয়েকটা উদাহরণ দেবেন?

মার্কেস: হ্যাঁ, যেমন সান্তা সফিয়া দ্য লা পিয়েদাদ। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, যেমন বাস্তবেও ঘটেছিল, যে মুহূর্তে সে তার শরীরে কুষ্ঠের আক্রমণ টের পাবে সে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু পরে ব্যাপারটা পাল্টে গেল। ভালই হয়েছে নয়তো বড় বেশি নির্দয় কাজ হয়ে যেত। যদিও চরিত্রটার ধাতই ছিল নিজের সুখসুবিধে অস্বীকার করে স্বার্থ দেখা।

( 1 )







মেনদোসা: আচ্ছা কোন চরিত্র কি একেবারেই হাতের বাইরে চলে গিয়েছিল?

মার্কেস: হ্যাঁ, তিনিটে চরিত্র তো একেবারেই হাতের বাইরে চলে গেল। মানে তাদের চরিত্র ব্যক্রিত্ব আর কাজকর্ম আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে চলে গেল। এক নম্বর হল অরেলিয়ানো হোসে, আমারানতার প্রতি তার তীব্র টান আমাকে অবাক করে দিয়েছিল। তারপর হোসে আর্কাদিয়ো সেগান্দো কলা শ্রমিক ইউনিয়নের তেমন মাপের নেতা ছিল না যেমনটা আমি চেয়েছিলাম। আর শেষে হোসে আর্কাদিয়ো, সেই শিক্ষানবিশ পোপ, এমন এক অধঃপতিত আদোনিসের চরিত্র নিল যা এই লেখার সঙ্গে যায় না।

মেনদোসা: এই উপন্যাসে আপনার সবচেয়ে কঠিন মুহূর্ত কোনটি?

মার্কেস: আমার মনে পড়ে সেই দিনটার কথা, সবচেয়ে কঠিন দিন, যখন বহু পরিশ্রম করে আমি উপন্যাসের প্রথম বাক্যটি লিখেছিলাম। তারপর নিজেকে প্রশ্ন করলাম দিশেহারার মতো, এরপর কী হবে? কী হবে? সত্যি বলতে কি যতদিন পর্যন্ত ওই বিরাট নৌকোটা জঙ্গলের ভিতর না আবিষ্কার হল, ততদিন পর্যন্ত আমি জানতামই না উপন্যাসটার কী নিয়তি! কিন্তু ওই নৌকোটা পাওয়ার পরে থেকেই সবকিছুই একটা ঘোরের মধ্যে ঘটে চলল। একটা মজার মধ্যে।

মেনদোসা: সমালোচকদের কথা ছাড়ুন, আমার কিন্তু মনে হয় 'নিঃসঙ্গতার একশো বছর' কেবল মাত্র আপনার শৈশবের কাব্যিক স্মৃতিচারণার থেকে কিছু বেশি। আপনি তো একবার বলেছিলেন বুয়েন্দিয়া পরিবারের ইতিহাস খুব সহজেই হয়ে যেতে পারে তাবৎ লাতিন আমেরিকার ইতিহাস।

মার্কেস: হ্যাঁ ঠিক তাই। লাতিন আমেরিকার ইতিহাসের ভিতরেও অনেক ব্যর্থ প্রচেষ্টা রয়েছে, অনেক নাটকীয়তা আছে যা আমরা ভুলে গিয়েছি। আমরা তো ওই রোগটায় ভুগি। তাই না? ওই যে বিস্মরণের মহামারী...সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই আমরা ভুলে গিয়েছি কলা কোম্পানির শ্রমিকদের ওপর নামিয়ে আনা অকথ্য অত্যাচারের কথা। শুধু একটাই নাম জেগে আছে- কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া।

মেনদোসা: আর যে তেত্রিশটা যুদ্ধে কর্নেল বুয়েন্দিয়া গোহারা হেরেছিলেন তা তো আমাদেরই রাজনৈতিক নৈরাশ্যের প্রতীক, তাই না? আচ্ছা যদি কর্নেল জিতে যেতেন কী হত তাহলে?

মার্কেস: তাহলে তিনি ওই প্যাট্রিয়ার্কের মতো হতেন। উপন্যাসটা লেখার সময় আমার একসময় লোভ হয়েছিল কর্নেলকে জিতিয়ে দিই। তা যদি তখন করতাম তবে হয়তো 'নিঃসঙ্গতার একশো বছর'-এর বদলে 'কুলপতির হেমন্তকাল' লেখা হয়ে যেত। ( 2 )



মেনদোসা: তবে কি আমরা ধরে নিতে পারি যে ইতিহাসের এমনই নিয়তিলিখন যে একজন স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে নিজেই নিকৃষ্টতম স্বৈরতন্ত্রী হয়ে যেতে পারে, যদি সে ক্ষমতার দখলদারি পায়।

মার্কেস: 'নিঃসঙ্গতার একশো বছর'-এ দেখবেন অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া-র হাতে বন্দি একজন বলছে, 'আমার অবাক লাগে যে মিলিটারির প্রতি ঘৃণা নিয়েও, এতবছর ধরে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা আর তাদের নিয়ে ভাবা সত্ত্বেও তুমি তাদের মতো নিকৃষ্ট হয়ে গেছ। এভাবে চলতে থাকলে তুমি হবে এদেশের সবচেয়ে কুখ্যাত আর রক্তলোলুপ স্বৈরশাসক'।

মেনদোসা: কাহিনিটা কি অনেকদিন ধরে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল?

মার্কেস: অবশ্যই। পনেরো বছর ধরে। আমি আমার কণ্ঠস্বরটা খুঁজে পেতে চাইছিলাম। একদিন যখন আমি আর মেরসেদেস (স্ত্রী) ছেলেদের নিয়ে আকাপুল্কোর দিকে যাচ্ছি, গোটা উপন্যাসটা বিদ্যুৎচমকের মতো আমার মাথায় খেলে যায়। আমি ঠিক করি গল্পটা বলব ঠিক যে ঢঙে দিদিমা আমাকে গল্প বলত সেই ঢঙে। শুরু করব সেই বিকেলবেলাটা দিয়ে যখন বাচ্চা ছেলেটিকে তার ঠাকুরদা তুষার আবিষ্কার করতে নিয়ে যাচ্ছেন।

মেনদোসা: একটা সরলরৈখিক ইতিহাস।

মার্কেস: সরলরৈখিক ইতিহাস। যেখানে দৈনন্দিনের সঙ্গে, সাধারণের সঙ্গে অসাধারণ আকস্মিকভাবে মিলেমিশে যাচ্ছে।

marquz মেনদোসা: তা এটা কি সত্যি যে সেদিন আপনি গাড়ি ঘুরিয়ে নেন আর বাড়ি ফিরে এসে লিখতে বসেন?

মার্কেস: হ্যাঁ সত্যি। আমার আর কোনওদিন আকাপুল্কো যাওয়া হয়নি।

মেনদোসা: আর মেরসেদেস?

মার্কেস: আপনি তো জানেন আমার কতরকমের পাগলামি ওকে সারা জীবন সহ্য করতে হয়েছে। এই বইটা আমি লিখতেই পারতাম না ও না থাকলে। ও সব কিছুর দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছিল। আমি তখন সবে একটা নতুন গাড়ি কিনেছি। সেটা আমি বন্ধক রেখে ওকে কিছু টাকা দিলাম। সে টাকায় বড়জোর ছ'মাস চলত। কিন্তু উপন্যাসটা লিখতে আমার প্রায় দেড়বছর লেগেছিল। যখন টাকা ফুরিয়ে গেল ও টুঁ শব্দটি করেনি। আমার কাছে অসম্ভব মনে হলেও ও ধার করে সব নিয়ে আসত। মাংসের দোকানে ধার, বেকারিতে ধার, বাড়িওলাকে বলল ভাড়ার জন্য ন'মাস অপেক্ষা করতে। আমায় কিচ্ছু জানায়নি। সময়ে সময়ে শুধু পাঁচশো শিট কাগজ দিয়ে যেত। বইটা যখন লেখা শেষ হয়ে গেল মেরসেদেসই পাণ্ডুলিপিটা 'এডিটোরিয়াল সুদ-আমেরিকানা'-র অফিসে পাঠিয়ে দেয়। ( 3 )







মেনদোসা: এবার বইটা নিয়ে কথা বলি। বুয়েন্দিয়া পরিবারের এই নিঃসঙ্গতার উৎস কী?

মার্কেস: ভালবাসার অভাব। অপ্রেম। আমার মনে হয়, আপনি লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন, গোটা শতাব্দী জুড়ে শুয়োরের লেজওলা অরলিয়ানো-ই একমাত্র বুয়েন্দিয়া যে নাকি ভালবাসা থেকে জন্মেছিল। বুয়েন্দিয়ারা কখনও কাউকে ভালবাসতে পারত না। আর তাই তারা এত নিঃসঙ্গ, এত নিরাশ। আমার বিশ্বাস নিঃসঙ্গতা সংহতির বিপরীত শব্দ।

মেনদোসা: এই উপন্যাসে পুরুষচরিত্রগুলো মূর্খতা, খামখেয়ালিপনা আর বোকামিতে ভরা (আবিষ্কার, অ্যালকেমি, যুদ্ধ, হই-হুল্লোড়)। নারীচরিত্রগুলো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন। এভাবেই কি আপনি নারী-পুরুষকে দেখেন?

মার্কেস: আমার মনে হয়, মেয়েরা পৃথিবীকে ধরে রাখে, সবকিছুকে ছিটকে বেরিয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচায়। আর পুরুষরা ইতিহাসকে ঠেলে এগিয়ে নিয়ে চলে। শেষ পর্যন্ত ধন্দ একটা থেকেই যায়। কারা বেশি উন্মাদ?

মেনদোসা: মেয়েরা যে শুধু বংশগতিকেই এগিয়ে নিয়ে চলে তা নয় উপন্যাসটাকেও এগিয়ে নিয়ে যায়। এই কারণেই কি উর্সুলা ইগুয়ারান অতবছর বেঁচে থাকে?

মার্কেস: হ্যাঁ, ওর তো গৃহযুদ্ধের আগেই মারা যাওয়ার কথা। তখনই সে একশো ছুঁই ছুঁই। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম উর্সুলা যদি মারা যায় তবে উপন্যাসটা মুখ থুবড়ে পড়বে। যতদিনে সে সত্যি মারা গেল ততদিনে লেখাটা এমন গতি পেয়ে গিয়েছে যে কোনও মৃত্যুরই আর সে রেয়াত করে না।

মেনদোসা: যেদিন উপন্যাসটা শেষ হল সেদিনটার কথা মনে পড়ে? তখন ক'টা বাজে? আপনার কী মনে হচ্ছিল?

মার্কেস: টানা আঠারো মাস ধরে প্রতিদিন সকাল ন'টা থেকে বিকেল তিনটে অবধি আমি লিখতাম। শেষ দিনটা আমি জানতাম যে এটাই হবে অন্তিম প্রহর। কিন্তু লেখাটা হঠাৎ করে নিজে থেকেই একটা বেখাপ্পা সময়ে, সকাল এগারোটায় শেষ হয়ে গেল। মেরসেদেস বাড়িতে ছিল না, আর খবরটা দেওয়ার জন্য আমি কাউকে ফোনেও পেলাম না। সেদিনকার সেই দিশেহারা অবস্থা আমার আজও স্পষ্ট মনে পড়ে। যেন গতকালের ঘটনা। আমি বুঝতে পারছিলাম না বাকি সময়টা আমি কী করব। তাই নানা রকম কাজের অছিলা খুঁজছিলাম যাতে করে বিকেল তিনটে অবধি আমি বেঁচে থাকতে পারি।

মেনদোসা: কাকে আপনার এই উপন্যাসের সবচেয়ে বড় পাঠক বলে মনে হয়?

মার্কেস: একবার আমার এক রুশ বন্ধুর সঙ্গে একজন মহিলার দেখা হয়েছিল, সেই বৃদ্ধা পুরো উপন্যাসটা শেষ লাইন অবধি নিজের হাতে টুকেছিলেন। কেন এ কাজ করছেন জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান 'আমি দেখতে চাই কে বেশি পাগল, লেখক না আমি - আর তা দেখতে গেলে পুরো উপন্যাসটা আবার না লিখে উপায় কী।' এর থেকে বড় পাঠক কেউ পাবে কোনদিন?

মেনদোসা: 'নিঃসঙ্গতার একশো বছর'-এর সাফল্য কি আপনাকে একটু ঘাবড়ে দিয়েছে?

মার্কেস: হ্যাঁ। ঘাবড়ে তো গেছিই। খুব ঘাবড়ে গেছি।

মেনদোসা: এই সাফল্যের রহস্যটা বুঝতে চাননি কখনও?

মার্কেস: কক্ষনো না। বুঝতে চাই না। যে উপন্যাস মাত্র কয়েকজন বন্ধুর কথা মাথায় রেখে এত ব্যক্তিগতস্তরে লেখা, তা যখন হঠাৎ বাজার গরম করে দেয়, সেই সাফল্যের রহস্য জানতে চাওয়া লেখকের পক্ষে বিপজ্জনক।

( 4 )

Table of Contents