অভিজিত্ সেন
সমাপতন
পঞ্চাশ বছর আগের সেই অসহনীয় দিনগুলো হয়তো সে সব মানুষের আর অত তীব্র নেই। বেশিরভাগ পরিবারই আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।
প্লেনে ঢাকা যাচ্ছে অনিমেষ। ঢাকা থেকে জাহাজে বরিশাল যাবে। বিগত পঞ্চাশ বছরের ইচ্ছা এতদিনে সফল করতে পারল সে। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর পাঁচ বছর কেটে গেছে। এই পাঁচ বছর সে একটা সরকারি প্রকল্পে উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছে। সারা জীবন অবশ্য বে-সরকারি নামী কারখানায় সে জবরদস্ত ইঞ্জিনিয়র ছিল। ভালো মাইনে, অন্যান্য আনুসঙ্গিক ভাতা ইত্যাদিও ভালো ছিল। সুতরাং জীবনটা অনিমেষের মন্দ কাটেনি। অসুবিধা যতটুকু ছিল, তা হল, তাদের প্রজন্মের অসংখ্য মানুষজন, যার মধ্যে তার নিজের আত্মীয় স্বজনই বেশি, তাদের সাহায্য করা।
এ ব্যাপারটা সে স্বেচ্ছায়ই নিয়েছিল। পুববাংলার গ্রাম ছেড়ে যারা এদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিল, তাদের মধ্যে অনিমেষের পরিবারও ছিল। সেই অবর্ণনীয় দুঃখকষ্টের দিনের যারা সহযাত্রী, অনিমেষ তাদের দায়িত্ব কিছুটা নিয়েছিল। পঞ্চাশ বছর আগের সেই অসহনীয় দিনগুলো হয়তো সে সব মানুষের আর অত তীব্র নেই। বেশিরভাগ পরিবারই আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। অনিমেষের আর তাদের দায়িত্ব, যতটুকুই হোক, পালন করার প্রয়োজন হয় না।
ফলে এখন তার অখণ্ড অবসর। অখণ্ড অবসরের সঙ্গে সঙ্গে টের পাচ্ছে ক্রমশ নিঃসঙ্গ হবার পালা। শরীর এমন কিছু ভেঙে পড়েনি যাতে ঘরেই শুয়ে বসে টিভি দেখে দিন কাটাবে সে। এই সময় মানুষ স্মৃতিমেদুরতায় বড় আক্রান্ত হয়। স্মৃতি ভারাক্রান্ত অনিমেষ একদিন ঠিক করল পুববাংলার যে গ্রামটিতে তার জন্ম, যে গ্রামে জীবনের প্রথম পনেরো বছর সে কাটিয়েছে, সেই গ্রামটিতে সে আর একবার যাবে। সারা জীবনে অসংখ্যবার তার মনে পড়েছে সেই গ্রামখানার কথা। তাদের অত্যন্ত জীর্ণ মাটির বাড়িখানার কথা। পনেরো বছরের পনেরো বর্ষা ঋতুর কথা, যখন খড়ের চালার ফাঁকা দিয়ে বৃষ্টির জল গড়িয়ে নামত। সে আর তার দু'ভাই বোন ঘটিবাটি যথাযথ জায়গায় বসিয়ে সেই জলের হাত থেকে ঘরখানা, বিছানা, বাক্স বাঁচাতে চেষ্টা করত। পরদিন সকালে উঠে দেখত উঠোনে জল এবং সবার উপরে, ঘরে চাল নেই। তখন মা বলত, 'চল আইজকা ভাইগনার বাড়িতে বেড়াইতে যাই আমরা, অ্যাঁ?' ছোট দুভাইবোন সঙ্গে সঙ্গে আনন্দে লাফালাফি করতে থাকত। তাদের পিসেমশাইয়ের বাড়ি তাদের গ্রাম থেকে খুব কম হলেও, দু'মাইল দূরে। জলকাদা ভেঙে সেখানে যাওয়াও খুব সহজ নয়। তবুও সেখানে গেলে, সমাদর তেমন পাওয়া না গেলেও খাওয়া পাওয়া যেত। ভাইবোনেরা সেই সম্ভাবনাতেই নাচানাচি করত।
কিন্তু অনিমেষের ব্যাপারটা মোটেই ভালো লাগত না। পিসেমশাইদের বাড়িতে অনেক লোক। অনেক শরিক সেই বড় দালান বাড়িটায়। তাদের মধ্যে অনেক আশ্রিতও ছিল। তারা নানারকম চক্রান্ত করত। এ ঘরের কথা ও ঘরে গিয়ে লাগাত। এদের সঙ্গে ওদের মনোমালিন্য লাগিয়ে দিত। তাতে নানারকম অশান্তি হত। অনিমেষের তখন এসব বুঝবার মতো বয়স হয়েছে। সে যেতে চাইত না। কিন্তু না গেলে বর্ষার সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে অনিবার্য উপোসের হাত থেকে রেহাই ছিল না। তাদের বাবার কোনও বাঁধাধরা রোজগার ছিল না। কোনও চাকরি-বাকরি করার যোগ্যতাও ছিল না তার। সোজা কথায় উঞ্ছবৃত্তি করেই সংসার চলত তাদের। তার বাবার একটা বড় আশ্রয় ছিল ওই বড়লোক ভাগ্নে। কিন্তু যে সম্পর্কে সেই আশ্রয় অনিমেষের পাঁচ-ছ বছর বয়সেই সেই পিসেমশাই মরে গিয়েছিল। পিসি মারা গিয়েছিল তার জন্মেরও আগে। সেই বড় বাড়ির কর্তা ছিল তার পিসতুতো দাদা। সে মানুষটা তার বাবার বয়সের কাছাকাছি বয়সের।
অনিমেষ এই লোকটির কাছ থেকে একটা বিচিত্র সমর্থন পেত। সেই শৈশবে ওই হতদরিদ্র অবস্থার মধ্যেও সে স্কুলে যেত এবং সবাইকে বছরের পর বছর ধরে বিস্মিত করে সে প্রতিবছরই ক্লাসে প্রথম হত। পিসতুতো দাদা বড়বাবু মন্মথনাথের অসম্ভব রাশভারী কর্তৃত্বের আড়ালে তার জন্য একটা অত্যন্ত গোপন আশ্রয়স্থল ছিল। ও বাড়ির ছেলেমেয়েরা প্রায় সবাই পড়াশোনায় গবেট। অত সহায়-সম্পত্তি থাকতেও দাদা একারণে প্রবল মনোকষ্টে থাকত। অনিমেষ ও বাড়িতে যখন যেত বৈঠকখানা ঘরেই তাকে ধরত দাদা।
'এবার অঙ্কে যেন কত পাইছ তুই?' শরিকদের কেউ হয়তো তখন পাশেই বসা। তাকে শোনানোর গরজই প্রধান।
অনিমেষ মিনমিন করে বলত, 'বিরানব্বই।'
'ফার্স্টক্লাস! পজিশন?' দাদা জিজ্ঞেস করত। সবই জানত। এর আগেই অন্তত দু'-তিনবার এসব জিজ্ঞেস করা হয়ে গেছে।
'ফার্স্ট', বলত অনিমেষ। অহংকার নয়, সেই মুহূর্তে লজ্জাই লাগত তার।
'তোগা ক্লাসে সেকেন্ড হয় সেই শ্যাখের পোলাডার নাম কী যেন?'
'শেখ শামীম হোসেন।' শামীম শুধু সহপাঠী নয়। অনিমেষের বন্ধু।
'আগে শ্যাখ, না পরে শ্যাখ?'
'আগে শেখ, পরে হোসেন।'
অনিমেষ মম্মথনাথের এসব অনুসন্ধানের কারণ বুঝতে পারে। সংখ্যলঘু ঘরের সন্তান হিসেবে এই মানসিকতার ভাগীদার সে নিজেও যে একেবারে নয়, একথা জোর দিয়ে বলতে পারে না। আবার উল্টোদিকের অভিযোগও শুনেছে সে। শামীমের বাড়িতে একদিন শামীমের এক নানার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাকে।
'তুমি কেলাসে ফাস্ট হও?'
'জে হ্যাঁ।'
'শামীমতো একবারও ফাস্ট হইতে পারে নাই।'
'জে?'
'আসলে ইস্কুলের মাস্টেররা তো বেবাকে পেরায় হিন্দু। তেনারা যদ্দিন আছেন, তদ্দিন শামীমরা ফাস্ট হইতে পারবে না। কি কও?'
শামীম সেবার বাংলা এবং ইংরেজিতে অনিমেষের থেকে অন্তত প্রতি পেপারে দশ-বারো নম্বর করে বেশি পেয়েছিল। কিন্তু অঙ্কে সে ছিল ভারী কাঁচা। শামীম কিছুতেই এই প্রতিকূলতা পূরণ করতে পারত না। কিন্তু নানার কথার মধ্যে যে ইঙ্গিত ছিল, অনিমেষ জানত, শামীম, রশিদ, নাসিমেরও সে রকম ধারণাই ছিল মনের মধ্যে।
সমাপতন
পঞ্চাশ বছর আগের সেই অসহনীয় দিনগুলো হয়তো সে সব মানুষের আর অত তীব্র নেই। বেশিরভাগ পরিবারই আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।
প্লেনে ঢাকা যাচ্ছে অনিমেষ। ঢাকা থেকে জাহাজে বরিশাল যাবে। বিগত পঞ্চাশ বছরের ইচ্ছা এতদিনে সফল করতে পারল সে। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর পাঁচ বছর কেটে গেছে। এই পাঁচ বছর সে একটা সরকারি প্রকল্পে উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছে। সারা জীবন অবশ্য বে-সরকারি নামী কারখানায় সে জবরদস্ত ইঞ্জিনিয়র ছিল। ভালো মাইনে, অন্যান্য আনুসঙ্গিক ভাতা ইত্যাদিও ভালো ছিল। সুতরাং জীবনটা অনিমেষের মন্দ কাটেনি। অসুবিধা যতটুকু ছিল, তা হল, তাদের প্রজন্মের অসংখ্য মানুষজন, যার মধ্যে তার নিজের আত্মীয় স্বজনই বেশি, তাদের সাহায্য করা।
এ ব্যাপারটা সে স্বেচ্ছায়ই নিয়েছিল। পুববাংলার গ্রাম ছেড়ে যারা এদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিল, তাদের মধ্যে অনিমেষের পরিবারও ছিল। সেই অবর্ণনীয় দুঃখকষ্টের দিনের যারা সহযাত্রী, অনিমেষ তাদের দায়িত্ব কিছুটা নিয়েছিল। পঞ্চাশ বছর আগের সেই অসহনীয় দিনগুলো হয়তো সে সব মানুষের আর অত তীব্র নেই। বেশিরভাগ পরিবারই আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। অনিমেষের আর তাদের দায়িত্ব, যতটুকুই হোক, পালন করার প্রয়োজন হয় না।
ফলে এখন তার অখণ্ড অবসর। অখণ্ড অবসরের সঙ্গে সঙ্গে টের পাচ্ছে ক্রমশ নিঃসঙ্গ হবার পালা। শরীর এমন কিছু ভেঙে পড়েনি যাতে ঘরেই শুয়ে বসে টিভি দেখে দিন কাটাবে সে। এই সময় মানুষ স্মৃতিমেদুরতায় বড় আক্রান্ত হয়। স্মৃতি ভারাক্রান্ত অনিমেষ একদিন ঠিক করল পুববাংলার যে গ্রামটিতে তার জন্ম, যে গ্রামে জীবনের প্রথম পনেরো বছর সে কাটিয়েছে, সেই গ্রামটিতে সে আর একবার যাবে। সারা জীবনে অসংখ্যবার তার মনে পড়েছে সেই গ্রামখানার কথা। তাদের অত্যন্ত জীর্ণ মাটির বাড়িখানার কথা। পনেরো বছরের পনেরো বর্ষা ঋতুর কথা, যখন খড়ের চালার ফাঁকা দিয়ে বৃষ্টির জল গড়িয়ে নামত। সে আর তার দু'ভাই বোন ঘটিবাটি যথাযথ জায়গায় বসিয়ে সেই জলের হাত থেকে ঘরখানা, বিছানা, বাক্স বাঁচাতে চেষ্টা করত। পরদিন সকালে উঠে দেখত উঠোনে জল এবং সবার উপরে, ঘরে চাল নেই। তখন মা বলত, 'চল আইজকা ভাইগনার বাড়িতে বেড়াইতে যাই আমরা, অ্যাঁ?' ছোট দুভাইবোন সঙ্গে সঙ্গে আনন্দে লাফালাফি করতে থাকত। তাদের পিসেমশাইয়ের বাড়ি তাদের গ্রাম থেকে খুব কম হলেও, দু'মাইল দূরে। জলকাদা ভেঙে সেখানে যাওয়াও খুব সহজ নয়। তবুও সেখানে গেলে, সমাদর তেমন পাওয়া না গেলেও খাওয়া পাওয়া যেত। ভাইবোনেরা সেই সম্ভাবনাতেই নাচানাচি করত।
কিন্তু অনিমেষের ব্যাপারটা মোটেই ভালো লাগত না। পিসেমশাইদের বাড়িতে অনেক লোক। অনেক শরিক সেই বড় দালান বাড়িটায়। তাদের মধ্যে অনেক আশ্রিতও ছিল। তারা নানারকম চক্রান্ত করত। এ ঘরের কথা ও ঘরে গিয়ে লাগাত। এদের সঙ্গে ওদের মনোমালিন্য লাগিয়ে দিত। তাতে নানারকম অশান্তি হত। অনিমেষের তখন এসব বুঝবার মতো বয়স হয়েছে। সে যেতে চাইত না। কিন্তু না গেলে বর্ষার সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে অনিবার্য উপোসের হাত থেকে রেহাই ছিল না। তাদের বাবার কোনও বাঁধাধরা রোজগার ছিল না। কোনও চাকরি-বাকরি করার যোগ্যতাও ছিল না তার। সোজা কথায় উঞ্ছবৃত্তি করেই সংসার চলত তাদের। তার বাবার একটা বড় আশ্রয় ছিল ওই বড়লোক ভাগ্নে। কিন্তু যে সম্পর্কে সেই আশ্রয় অনিমেষের পাঁচ-ছ বছর বয়সেই সেই পিসেমশাই মরে গিয়েছিল। পিসি মারা গিয়েছিল তার জন্মেরও আগে। সেই বড় বাড়ির কর্তা ছিল তার পিসতুতো দাদা। সে মানুষটা তার বাবার বয়সের কাছাকাছি বয়সের।
অনিমেষ এই লোকটির কাছ থেকে একটা বিচিত্র সমর্থন পেত। সেই শৈশবে ওই হতদরিদ্র অবস্থার মধ্যেও সে স্কুলে যেত এবং সবাইকে বছরের পর বছর ধরে বিস্মিত করে সে প্রতিবছরই ক্লাসে প্রথম হত। পিসতুতো দাদা বড়বাবু মন্মথনাথের অসম্ভব রাশভারী কর্তৃত্বের আড়ালে তার জন্য একটা অত্যন্ত গোপন আশ্রয়স্থল ছিল। ও বাড়ির ছেলেমেয়েরা প্রায় সবাই পড়াশোনায় গবেট। অত সহায়-সম্পত্তি থাকতেও দাদা একারণে প্রবল মনোকষ্টে থাকত। অনিমেষ ও বাড়িতে যখন যেত বৈঠকখানা ঘরেই তাকে ধরত দাদা।
'এবার অঙ্কে যেন কত পাইছ তুই?' শরিকদের কেউ হয়তো তখন পাশেই বসা। তাকে শোনানোর গরজই প্রধান।
অনিমেষ মিনমিন করে বলত, 'বিরানব্বই।'
'ফার্স্টক্লাস! পজিশন?' দাদা জিজ্ঞেস করত। সবই জানত। এর আগেই অন্তত দু'-তিনবার এসব জিজ্ঞেস করা হয়ে গেছে।
'ফার্স্ট', বলত অনিমেষ। অহংকার নয়, সেই মুহূর্তে লজ্জাই লাগত তার।
'তোগা ক্লাসে সেকেন্ড হয় সেই শ্যাখের পোলাডার নাম কী যেন?'
'শেখ শামীম হোসেন।' শামীম শুধু সহপাঠী নয়। অনিমেষের বন্ধু।
'আগে শ্যাখ, না পরে শ্যাখ?'
'আগে শেখ, পরে হোসেন।'
অনিমেষ মম্মথনাথের এসব অনুসন্ধানের কারণ বুঝতে পারে। সংখ্যলঘু ঘরের সন্তান হিসেবে এই মানসিকতার ভাগীদার সে নিজেও যে একেবারে নয়, একথা জোর দিয়ে বলতে পারে না। আবার উল্টোদিকের অভিযোগও শুনেছে সে। শামীমের বাড়িতে একদিন শামীমের এক নানার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাকে।
'তুমি কেলাসে ফাস্ট হও?'
'জে হ্যাঁ।'
'শামীমতো একবারও ফাস্ট হইতে পারে নাই।'
'জে?'
'আসলে ইস্কুলের মাস্টেররা তো বেবাকে পেরায় হিন্দু। তেনারা যদ্দিন আছেন, তদ্দিন শামীমরা ফাস্ট হইতে পারবে না। কি কও?'
শামীম সেবার বাংলা এবং ইংরেজিতে অনিমেষের থেকে অন্তত প্রতি পেপারে দশ-বারো নম্বর করে বেশি পেয়েছিল। কিন্তু অঙ্কে সে ছিল ভারী কাঁচা। শামীম কিছুতেই এই প্রতিকূলতা পূরণ করতে পারত না। কিন্তু নানার কথার মধ্যে যে ইঙ্গিত ছিল, অনিমেষ জানত, শামীম, রশিদ, নাসিমেরও সে রকম ধারণাই ছিল মনের মধ্যে।
সংখ্যালঘুর নিরুপায় ক্রোধ। এখন জানে যে ব্যাপারটা সর্বত্রই এ রকম হয়। সংখ্যালঘুর ভবিতব্যই সাম্প্রদায়িক হওয়া।
প্লেনের ঘোষক সিটবেল্ট আটকে নিতে বলল। ছোট প্লেন, মাত্র পয়তাল্লিশ কী খুব বেশি হলে পঞ্চাশ জন যাত্রী। চল্লিশ-পয়তাল্লিশ মিনিটের উড়ান মাত্র। এখনই ঢাকা নামবে প্লেন। নামছে। মাটি ছুঁয়েছে। ঠিক তখনই মনে হল, শামীমের নানা যেটা বলেছিল, সেটার ভিতরে সত্যতা থাকতে পারে। হয়তো ছিলই। সেই সময় তার ভারী অপমান বোধ হয়েছিল। সংখ্যালঘুর নিরুপায় ক্রোধ। এখন জানে যে ব্যাপারটা সর্বত্রই এ রকম হয়। সংখ্যালঘুর ভবিতব্যই সাম্প্রদায়িক হওয়া। সে তখন এ ব্যাপারটা জানত। মন্মথদাদা ওই কথার লেজপর হিসেবে জুড়ে দিয়েছিল, 'খবরদার! কোনও শ্যাখের বাচ্চারে ফার্স্ট হইতে দিবি না!'
প্লেনের দরজাটাই বোধহয় জোরালো স্প্রিংয়ের চাপে খুলে গিয়ে নিচে নামার সিঁড়ি হয়ে গেছে। সামনের যাত্রীরা নামছে একজন-দু'জন করে। অধিকাংশ যাত্রীই অত্যন্ত সাধারণ চেহারার। দু'জন আরবি জোব্বা পরা বিদেশি, তিনজন বোরখা পরা মহিলা, দাড়ি-গোঁফের বিশিষ্ট ভঙ্গিতে নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস প্রকটিত, এইরকম পাঁচ-ছ'জন এবং একজন সম্ভবত রামকৃষ্ণ মিশনের সাধু, এদের মোট সংখ্যা জনা দশেক হবে। এরা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশিষ্ট। এছাড়া বাকি জনা পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ স্ত্রী-পুরুষ নির্ভেজাল বাঙালি। চেহারা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণে কতটুকু আর তফাত! অথচ কত কিছুই যে হয়ে গেছে, এখনও হচ্ছে!
এয়ার পোর্ট থেকে বেরোবার শেষ বাধা ইমিগ্রেশন। ইমিগ্রেশনের ছেলেটি দেখেই তাকে যেন চিনল।
বলল, 'কাকা, দ্যাশের বাড়ি দ্যাখতে আইছেন?'
অনিমেষ আশ্চর্য হয়ে খাঁটি বাঙাল উচ্চারণেই উত্তর দিল, 'বোঝেন ক্যামনে?'
'হা-হা, বইশশাল?'
'হ।'
'কী আছে সেখানে?'
'কিছুই নাই শুনছি।'
'বাড়িঘর? ভিটা?'
'বাড়িঘর না থাকারই কথা। ভিটেখান তো আর উড়িয়া যাইতে পারে না। সেইখানই দ্যাখতে যাব।' দুজনের ভাষাতেই মিশ্রণ এসে গেছে।
'কেডা কইল উড়িয়া যাইতে পারে না? আপনে সুকুমার রায়ের লেখা পড়ছেন? ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল!'
'হাঃ-হা-হা-'
'আপনে হাসতাছেন! ভিটাজমি ধানীজমি হইয়া যাইতে পারে। কেউ যদি পুকুর কাটাইয়া সেইখানে মাছের চাষ করে, হইবে জলা। আর যদি কোনও বুদ্ধিমান মন্দির, কী মসজিদ বানাইয়া ফেলে, হেইলে তো কাম সারা। তখন আপনের জমি হইবে দেবস্থান, দেবত্তোর, আল্লার মোকাম।'
'তা ঠিকই কইছেন, হা-হা-হা-হা-'
'এখন শোনেন, এই কাগজখানা ফিলআপ করেন। এত কথা কইলাম যে কারণ এই যে কলমটা দেখতাছেন, এখানে লিখবেন ট্যুর। আপনি ট্যুরিস্ট মনে রাখবেন। অন্যকিছু লিখতে গেলে অকারণ ঝামেলায় পড়বেন, বোঝলেন?'
'ঠিক আছে, ঠিক আছে, ধন্যবাদ আপনারে।'
একপাশে সরে অনিমেষ একটা বন্ধ কাউন্টারের সামনের সংকীর্ণ পরিসরে কাগজখানা রেখে নানা অনুসন্ধানের জবাব লিখতে লাগল। ইমিগ্রেশনের ছেলেটি পরের লোকটিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
ফরম পূরণ করে দপ্তরের সামনে এসে আবার দাঁড়াল সে। প্লেন আসতে প্রায় চারঘণ্টা দেরি করেছে। প্লেন ছাড়ার সময় দমদমে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল। ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল ঢাকাতেও। সে সব মিটে যেতে তবেই প্লেন ছেড়েছিল। ক্ষীণ জানাশোনার সূত্রে বিমানবন্দরে যে ব্যক্তির আসার কথা ছিল, সে বোধহয় এসে ফিরে গেছে। এ দিকে রাত বারোটা পার হয়ে গেছে ঘড়িতে। উঁচু ঘেরার বাইরে ঘাড় তুলে অনিমেষ দেখতে চেষ্টা করল কোনও উত্সুখ মুখ এ দিকে তাকিয়ে আছে কি না। না, তেমন কেউ নেই।
'কাকা, দেন।' কাগজখানা টেবিলে রাখল অনিমেষ।
'কার আসার কথা ছিল? আসে নাই?'
অনিমেষ চিন্তিত মুখে বলল, 'একটি ছেলের আসার কথা ছিল, আমাকে সে একটা হোটেলে তুলে দেবে, এরকম কথা ছিল। এই দুর্যোগে সে বোধহয় ফিরে গেছে।'
'ক্যান যে আসেন এই পোড়া দ্যাশে!' কাগজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল কাউন্টারের ছেলেটি। কাজ শেষ হয়ে গেলে সে বলল, 'ব্যাস, আমার কামও শ্যাষ, আপনার কামও শ্যাষ। চলেন এখন।'
পাশের টেবিলের দ্বিতীয় ব্যক্তি সতর্কবার্তা জানানোর ভঙ্গিতে বলে উঠল, 'সাবির, আবার!' বোঝা গেল ছেলেটির নাম সাবির।
সে বলল, 'কী করুম? যাইবে কোথায় মানুষটা? এই এত রাত্তিরে রাস্তায় বাইর হইলে-একলা মানুষ, তার উপর ইনডিয়াথিকা আইছে। আর সবার উপরে, বইশশালের মানুষ। এখনও তো গেরামের নাম জিগাই নাই! কাকা, কোন গেরামে-কোন থানায় বাড়ি আপনার?'
অনিমেষ বলল, 'জলাভিটা, গৌরনদী থানা।'
সাবির সোল্লাসে তার পাশের সহকর্মীকে বলল, 'দেখলিতো? আরে আমি চোখমুখ দেইখ্যাই আন্দাজ করতে পারি। কাকা, আমার বাড়ি মানিকপুর, জলাভিটার উত্তর পাশে। চেনেন তো?'
অনিমেষ আশ্চর্য হল। এমন সমাপতন বরিশাল জেলার মানুষের মধ্যেই সম্ভব, এমন মনে হল তার। সে বলল, 'মানিকপুর চিনি না, কয়েন কী? আমার স্কুলের বন্ধু শামীম হোসেনদের বাড়ি কত গেছি।'
সাবির বিস্মিত হয়ে বলল, 'কোন শামীম হোসেন? আগে শ্যাখ, না পরে শ্যাখ?'
অনিমেষ সহসা ঘটনাযুগ্মের যুগপত্ সংঘটনে এবার আর আশ্চর্য হল না। পঞ্চাশ-বাহান্ন বছর আগে রাশভারী পিসতুতো দাদা একেবারে ভিন্ন অর্থে এই প্রশ্নটাই করেছিল তাকে। সে আগের বারের মতো একই উত্তর দিল। বলল, 'আগে শ্যাখ।'
সাবির লাফ দিয়ে উঠে তার সহকর্মীকে বলল, 'দেখলিরে শুয়ার? এরে কয় বইশশাল! কাকায় কিন্তু তোর কাউন্টারে দাঁড়ালেই পারতেন। কিন্তু দাঁড়াইলেন আমার কাউন্টারেই! চলেন, কাকা। একি তগো ঢাকাই কুটুম্বিতা যে নৌকায় ঠেলা দিয়া কবি "আইজ আপনারে আটকামু না বেয়াই, তবে পরের বারে কিন্তু না-খাওয়াইয়া ছাড়ুম না," চলেন, কাকা।'
বেয়াইয়ের রসিকতাটা বহু প্রাচীন আর ঢাকাই কুটুম্বিতা সম্পর্কেই শুধুমাত্র প্রযোজ্য নয়। এই রসিকতা অনিমেষ শুনেছে অন্তত পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর আগে। বিদায় দিতে ঘাটে এসে বেয়াইয়ের নৌকো গভীর জলের দিকে ঠেলে দিয়ে বলা যে, আজ আপনাকে আটকাব না, আপনি কাজের মানুষ। কাজের ক্ষতি করব না। কিন্তু এর পর যে দিন আসবেন, সেদিন কিন্তু ছাড়ব না। খাওয়া তো খাওয়া, রাত্রিবাসও করতে হবে।