চিরঞ্জীব বসু
ডিপ্রেশনের কুড়ি মিনিট

উল্টোডাঙার মোড় থেকে একটা রোল কিনে খেল তুলসী, এগ-চিকেন। ভালো, পেট ভরার মতো সাইজ। জল খেল, সিগারেট। তারপর একটা ম্যাগাজিন স্টলে গিয়ে প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার ছবি দেখলো ও একটা বাচ্চা সমেত ভিখিরি মহিলাকে দু'টো দিল। এবার খানিখক্ষণ ও কিছু ভাবলো না। পেট ভরে গেলে তুলসী কিছুক্ষণ কিছু ভাবতে পারে না। তারপর ভাবা শুরু হলো তখন যখন ও ভাবতে শুরু করলো যে এবারে সত্যি সত্যি কিছু একটা সিরিয়াস ভাবনার প্রয়োজন। মানে জীবন নামক যন্ত্রণা এবং মুক্তির সহজ উপায়, আমরা আনিব রাঙা প্রভাত, জীবিতকে মৃত বানাইবার চারখানা সহজ উপায় ইত্যাদি ইত্যাদি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা ও ভাবনাগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে তুলসী আর ওর পেছনে উল্টোডাঙা ফ্লাইওভার আর বিলবোর্ড, তুলসী দেখতে পায় একটা টুথপেস্টের বিজ্ঞাপণ, রাত ভর ঢিসুমঢিসুম। সেই বোর্ডের পাশে একটা হালকা সাদা দোতলা বাড়ি। সমাজসেবা মূলক সংস্থা বলে মনে হল তুলসীর। নীচতলায় সাইনবোর্ডে লেখা ''প্রাইভেটে মদ ছাড়ান'' আর ওপরতলায় ''গোপনে এমএ/বিএ পাশ করুন''। প্রাইভেটে মদ ছাড়ানোর কেসটা না হয় বোঝা গেল কিন্তু গোপনে এম এ, বি এ পাশ কেসটা কী? যে ছাত্রটি গোপনে ওইসব পাশ দেবে তার ভবিষ্যৎ কী হবে! ভেবে পায় না তুলসী। শব্দদুটো, মানে গোপন ও প্রাইভেট শব্দ দুটো নিশ্চই স্থান পরিবর্তন করেছে, তাই হবে। স্থান পরিবর্তন এই শব্দ দুটো হঠাৎ করে মনে পড়িয়ে দিল যে ওর, মানে তুলসীরও স্থান পরিবর্তনের সময় হয়ে এলো প্রায়। শেষ বারের অ্যাটেম্পটা তো যাচ্ছেতাই। বাড়িয়ালা তথা যুগের প্রতীক সংঘের ভাইস প্রেসিডেন্ট মদন ধর দু'হাত জোড় করেই বললেন, তুলসী বাবু, আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার ঘরটা ছেড়ে দিন, কী লজ্জার ব্যাপার বলুন তো? আমার বাড়িতে এমন ফেলিওর রেকর্ড একটাও নেই, আর সেখানে কী না দু'দু'বার। আরেকটা সুযোগ আমাকে দিন দয়া করে মিস্টার ধর। দেখবেন এবার আমি পারবো, পারতেই হবে, এবার আর কেরোসিন নয়, ডাইরেক্ট পেট্রল, বিশ্বাস করুন। আমার এই বাড়ি অবশেষ-এর নাম ডুবোলেন আপনি, কিং সাইজ সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলেছিলেন মদন ধর।

টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনে ঢোকার মুখটিতে, যেখানে লেখা ছিল, আপনি কি অবসাদগ্রস্ত, আত্মহত্যাপ্রবণ? তাহলে নীচের নাম্বারে যোগাযোগ করুন, ওই নীচের নাম্বারটি যখন ডায়েরিতে টুকছিল তুলসী ঠিক তখনই মহুয়া, হ্যালো আমার নাম মহুয়া, মহুয়া মৈত্র।

বেলেঘাটার অফিসে যাতায়াত শুরু হলো এরপর থেকেই। তারপর 'পাগলু টু', 'তারে জমিন পর', 'হেমলক সোসাইটি', এসব চলছিল, নিয়মিত। মহুয়া শাড়ি পরতো, পায়ে স্টিলেট্টো, প্রন কবিরাজি, ট্যাক্সিতে ডানদিকে বসা, কথায় কথায় 'আই মিন' না ব্যবহার করা---কমকথায় এই ছিল মহুয়া মৈত্র। মহুয়া তুলসী, তুলসী মহুয়া-এরকম। কোথায় কোথায় দেখা যেত ওদের, এর থেকে সহজ প্রশ্ন হল কোথায় কোথায় দেখা যেত না ওদের? বসন্ত, রূপা, দিলখুশা, মিত্র--- সব কেবিনে। ''আমি তোমাকে ভালোবাসি'', এই উচ্চারণের আগে তুলসী বলে ফেলেছিল, ''তুমি খুব টাইট মহুয়া''। মহুয়া ছিল ''সে ইয়েস টু লাইফ'' নামক একটি এনজিও সংস্থার মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ।

ভুলে গিয়েছিল, সত্যি বলতে কী মহুয়া আসার পর তুলসী একেবারেই ভুলে গিয়েছিল ওই আত্মহত্যার ব্যাপারটি। ডিপ্রেশন হতো না, নিঃসঙ্গতাও এনজয় করতে পারতো, কাজকর্মে মন বসতো সাঙ্ঘাতিক, নিজের জামাকাপড় কাচতে দারুণ লাগতো, ভিড় বাসে 'হামে তুমসে প্যায়ার কিতনা' গাইতে পারতো, মদের খরচ কমে গিয়েছিল মানে প্রেমে পড়লে তুলসীদের যা যা হয় আর কী।

এহেন মহুয়াও একদিন ছেড়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল, তুমি আমার একজন ক্লায়েন্ট মাত্র, জাস্ট ক্লায়েন্ট। এর বেশি কিছু না। তোমাকে মৃত্যুর থেকে জীবনের দিকে ফিরিয়ে আনাটাই আমার চাকরি, সেই জন্যই আমি মাইনে পাই তুলসী। এর ওপর আমার প্রমোশন, ইনক্রিমেন্ট ডিপেন্ড করে। আর কিছু নয়। মিনমিন করে তুলসী বলতে চেয়েছিল, তাহলে ওই যে রজত কিম্বা প্রেমাংশুদের নিয়েও যে তুমি সব জায়গায় যাচ্ছো, পার্কে, লেকে, কেবিনে। চুমু খাচ্ছ ভিক্টোরিয়ায়। ওগুলো? সামান্য হেসে মহুয়া জবাব দিয়েছিল, ওরা আমার নতুন ক্লায়েন্ট। তোমার সঙ্গে আমি যা যা করেছি, ঠিক তাই তাই ওদের সঙ্গেও করছি। তুমি এখন সুস্থ, আমাকে আর তোমার প্রয়োজন নেই তুলসী। বাই, এনজয় লাইফ।

( 1 )


ঘরের দেওয়ালের এক কোণে মাটিতে বসে পিঁপড়েদের লাইন দেখতো। দেখতো পুরুষ পিঁপড়েরা মাথায় পাগড়ি আর হাতে ছড়ি নিয়ে আগে আগে, তার পেছনে কাঁখে কলস নিয়ে কিছু রমণী পিঁপড়ে, তার পেছনে শৃঙ্গার বেশে ছল্লিময় মহুয়া পিঁপড়ে, তারপর পরপর সার্কাস, অন্ধ, খঞ্জ, অফিস, রেফারি বিভিন্ন রকম পিঁপড়েরা।

মহুলা চলে যায় এরপর। তুলসীকে একটি ব্লাইন্ড লেনের শেষ বসিয়ে মহুয়া উড়ে যায়। তুলসী মহুয়াকে বলতে পারেনি যে তুমি চলে গেলে যদি আমি আবার অসুস্থ হয়ে যাই! তুমি চলে গেলে যদি আবার সেইসব অসুখগুলো ফিরে ফিরে আসে যা তুমি আসার আগে আমার মধ্যে ছিল? তুমি চলে গেলে আমি আর কোথায় যাব মহুয়া।

মহুয়া চলে গেছে বহুদিন হল। মনে নেই। প্রথম প্রথম মহুয়া যে নেই তা বুঝতে বুঝতে ওই সময়টা, মানে আবার নতুন করে আত্মহত্যা করার ইচ্ছে বা বাসনা, তুলসী বুঝতেই পারেনি।

কলকাতা কর্পোরেশনের হাউজ বিল্ডিং ডিভিশনে একটা তালিকা পাওয়া যায়। শহরের কোন কোন বাড়িগুলো আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষদের পক্ষে আদর্শ। অনেক কষ্টে সেই আদর্শ লিস্ট যোগাড় করেছিল তুলসী। বাগুইআটির মদন ধরের 'অবশেষে' বাড়িটার ঠিকানা অবশেষে এভাবেই পায় তুলসী।

প্রথমে তুলসী নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে শুরু করে সমস্ত ইল্যুমিনেশন, সমস্ত প্রজ্জ্বলন, উদ্ভাসন থেকে। ইনিংস ডিক্লেয়ার করা ব্যাটসম্যানের মত ধীরে ধীরে প্যাভিলিয়নে ফিরে এসেছিল তুলসী। জেতা হারা বুঝতে না পারা একজন কনফিউজড মানুষের মত তুলসী ফিরে ফিরে যাচ্ছিল একটা টানেলের মধ্যে, যার অতীত বলে কিছু নেই, ভবিষ্যৎ বলে কিছু হবে না, শুধুই বর্তমান। প্রথম প্রথম ডিপ্রেশন শুরু হত ভোরবেলায়। ঘুম ভাঙার পর, পটিতে বসলেই ডিপ্রেশন মাথা ব্যাথার মত চেপে বসতো তুলসীর মাথায়। তারপর চা, জলখাবারের পর নিজেকে একবার নাড়া দিত তুলসী, নাড়িয়ে নিত নিজেকে। ঘরের দেওয়ালের এক কোণে মাটিতে বসে পিঁপড়েদের লাইন দেখতো। দেখতো পুরুষ পিঁপড়েরা মাথায় পাগড়ি আর হাতে ছড়ি নিয়ে আগে আগে, তার পেছনে কাঁখে কলস নিয়ে কিছু রমণী পিঁপড়ে, তার পেছনে শৃঙ্গার বেশে ছল্লিময় মহুয়া পিঁপড়ে, তারপর পরপর সার্কাস, অন্ধ, খঞ্জ, অফিস, রেফারি বিভিন্ন রকম পিঁপড়েরা। দেখতো পিঁপড়েদের যূথবদ্ধ হাঁটাচলা। দেখতো পিঁপড়ে সমাজে কোনো ধাক্কাধাক্কি কিম্বা ওভারটেক নেই। এইসব দেখটে দেখতে বেশ সময় কেটে যেত তুলসীর। ডিপ্রেশন কিছুটা কমতো। এফ এম শুনতো দেওয়ালের কোণায় বসে। তারপর একদিন সকালে দেখা গেল পিঁপড়েরা আর নেই। এফ এম বাজছে না। ঘর্ঘর শব্দ আসছে রেডিওতে। পিঁপড়ে আর রেডিও বন্ধ হয়ে যাওয়াতে আরো নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লো তুলসী। সকালের, ভোরভোরের ডিপ্রেশনের মেয়াদ বাড়তে লাগলো এরপর থেকে। আত্মহত্যা সারফেসে আসতে শুরু করলো তুলসীর।

মোটামুটি মিনিট কুড়ি আগে থেকেই তুলসী ডিপ্রেশন আগমনের ইঙ্গিত পেয়ে যায়। এই যেমন এখন। ঘড়িতে একটা দশ। একটা একত্রিশে উল্টোডাঙা স্টেশনে হাসনাবাদ লোকাল ঢুকবে, টাইম টেবিল রি-চেক করে স্টেশনের দিকে হাঁটতে শুরু করে তুলসী। স্থান পরিবর্তনটা আজই করে ফেলতে হবে।

হাসনাবাদ লোকালের অ্যানাউন্স হয়ে গেছে, দু'নম্বর প্ল্যাটফর্ম। প্ল্যাটফর্মের পেছনের দিকে লোকনাথ ঘুঘনি সেন্টারের সামনে দাঁড়ায় তুলসী। অ্যানাউন্সমেন্ট হয়ে গেছে।

ঠিক সে সময় এক অচেনা নাম্বার থেকে মোবাইলে ফোন আসে, তুলসী ফোন তোলে, শুনতে পায়, হ্যালো আপনি কি অবসাদগ্রস্ত, আত্মহত্যাপ্রবণ। তাহলে এই নাম্বারে যোগাযোগ করুন। আমি মহুয়া, মহুয়া মৈত্র। এরপর হাসনাবাদ লোকাল হুড়মুড় করে প্ল্যাটফর্মে ঢুকে যাওয়ায় আর কিছু শোনা হয় না তুলসীর।
( 2 )

Table of Contents