প্রচেত গুপ্ত
ভাল আছি
আমরা ভাল আছি।
'ভাল আছি' বললে কম বলা হবে। বলা উচিত, অতিরিক্ত ভাল আছি। আমাদের সকলের মুখে এখন হাসি। কারও মুখে মিটমিটে হাসি, কারও দাঁত বের করা হাসি। কারও 'হি হি' হাসি। কারও 'হো হো' হাসি। কারও 'হ্যা হ্যা' হাসি। কারও 'হু হু' হাসি।
এত হাসির কারণ কী?
হাসির কারণ হল, আমাদের চিন্তা নেই। আমরা সকলেই 'জিরো জিরো' কিনে নিয়েছি।
নিশ্চয় মনে হচ্ছে, 'জিরো জিরো'টা আবার কী রে বাবা! দাঁতের মাজন নাকি? দাঁতের মাজনের বিজ্ঞাপনে যেমন সবাই দাঁত বের করে হাসে তেমন কিছু? না তেমন কিছু নয়। 'জিরো জিরো' হল একধরনের যন্ত্র। দেখতে একটুখানি। যাকে বলে মাইক্রোচিপস। সঙ্গে নিয়ে চলাফেরায় ঝামেলা নেই। 'জিরো জিরো'-র বিভিন্ন ধরনের মডেল বাজারে এসে গেছে। সবথেকে বেশি এসেছে চিনা মডেল। এখন যেকোনও জিনিসে চিন হই হই করে বাজার ধরে ফেলে। শোনা যাচ্ছে, আগামী কয়েকবছরের মধ্যে ওরা আমাদের কুমোরটুলির বাজার খেতে চলেছে। দুর্গাপুজোর সময় ওরা ফোল্ডিং দুর্গাঠাকুর পাঠাবে। খুবই কম দাম হবে। ভাসানের দিন জলে না ফেলে সেই প্রতিমা ফোল্ড করে, বাক্সে রেখে দেওয়া যাবে। পরেরবার আবার বের করে পুজো হবে। শেন জেনের কোন এক গোপন ওয়ার্কশপে কাজ চলছে। যদি সফল হয় তাহলে দুর্গা প্রতিমার সঙ্গে ঢাক, ধুনুচি, চাঁদমালাও বানাবে। যাই হোক, চিনা 'জিরো-জিরো' যন্ত্র মজার। নানা ধরনের খেলনার মত। যেমন মেয়েদের জন্য ওরা মাথার ক্লিপ বানিয়েছে। মনে হবে, চুলে একটা প্রজাপতি বসে আছে। আসলে ওটা ক্লিপ নয়, 'জিরো-জিরো' যন্ত্র। প্রজাপতির মাথার মধ্যে চিপস রাখা। বাইরে থেকে কেউ ধরতে পারবে না। ছেলেদের জন্য বানিয়েছে জামার বোতাম। কায়দা করা বোতাম। ক্লিপ সিস্টেম। যেকোনও জামার সঙ্গে চট করে লাগিয়ে নেওয়া যাবে। ছোটোদের জন্য বানানো 'কিড জিরো জিরো' প্রথম দিকে ঝামেলায় ফেলেছিল। বাচ্চারা চকোলেট ভেবে মুখে দিয়ে ফেলেছিল। এখন সবাই সাবধান হয়েছে। বেল্ট, জুতো, ওয়াটার বটলের সঙ্গে গোপনে লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাবার সময় পরে নিচ্ছে। তবে কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে, চিন নাকি খেলনা টাইপ 'জিরো জিরো' বানাতে গিয়ে এমন সব মেটাল আর কেমিকাল ব্যবহার করছে যেগুলো মানুষের শরীরের জন্য ভাল নয়। বিষাক্ত। চোখ, ফুসফুস, হার্টের ক্ষতি করে। কী কাণ্ড! চিন এই 'অপবাদ' থেকে বেরোতে পারছে না। আগেও ওদের নামে কমপ্লেইন ছিল। বাজার ধরার জন্য ওরা নাকি কম খরচে খারাপ জিনিস ব্যবহার করে। অন্যের ক্ষতি হলে হবে, বাজার তো দখলে রইল।
( 1 )
যতই চিন বাজার দখলে এগিয়ে আসুক, যতই জাপান প্রযুক্তিতে পাকা হোক, আমেরিকার সঙ্গে টেক্কা দেওয়া খুব কঠিন। সাধে কি হারামজাদারা গোটা দুনিয়ার মাথা পয়সা দিয়ে কিনে নিজেদের খাঁচায় পুরে রেখেছে? তুই বল একবার।'
আমার এক বন্ধু সব ব্যাপারে বিগ টক ঝাড়ে। পাকা টাইপ ছেলে। সে বলেছে, 'দূর তা কখনও হয়? ওরা না কমিউনিস্ট? ওরা কেন বাজার দখল নিয়ে ভাববে? এসব আমেরিকার অপপ্রচার।'
সে যাই হোক, অল্প হলেও বদনামের কারণে চিনা 'জিরো-জিরো'-র বিক্রি কমছে। জাপানিরাও জিরো-জিরো-র মডেল ছেড়েছে। তবে তাদের মডেল ৩৩ জনপ্রিয় হয়নি। শুধু সুজুকি আর মিত্সুবিসি কম্পানির কয়েকটা চলে। তার মধ্যে যেটা হেডফোনের সঙ্গে লাগিয়ে দিয়েছে সেটা বেশি চলে। যদিও 'জিরো-জিরো' তৈরির ব্যাপারে আমরা চিরকাল জাপানের কাছে ঋণী থাকব। ওরাই প্রথম ইনডাকশন চিপস তৈরি করেছে। সেই চিপস মানুষের শরীরের স্পর্শে কয়েক ঘণ্টা থাকলেই হয়। তারপর খুলে রাখো। চার্জ হওয়া ব্যাটারির মতো বেশ খানিকটা সময় ধরে কাজ দেয়। এতবছর হয়ে গেল প্রযুক্তিতে আজও জাপানকে কেউ ছাড়াতে পারল না।
আমার পাকা বন্ধু বলে, 'বুর্জোয়া ক্যাপিটালকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয় ওরা দেখিয়ে দিয়েছে। বাজার দখলের থেকে কোয়ালিটি প্রোডাক্টে ওদের নজর বেশি। ওরা চিনের থিওরি মানে না। ওরা মনে করে, সব জিনিসই সবাইকে কিনতে হবে এমন কোনও মানে নেই। যার পকেটে রেস্ত আছে শুধু সে কিনবে।''
আমি বলি, 'চুপ কর। বেশি পাকামি করবি না।'
এই ফাঁকে বলে নিই, আমেরিকাও জোর কদমে নেমেছে। তারা চেষ্টা করছে যাতে 'জিরো-জিরো' যন্ত্রটাকে মানুষের শরীরে পাকাপাকি লাগিয়ে দেওয়া যায়। হার্টে পেসমেকার লাগানোর মত। এটা হলে সবথেকে সুবিধা হবে। সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে হবে না, চার্জ দিতে হবে না। কাজ নাকি অনেকটা এগিয়ে গেছে। সমস্যা হচ্ছে, যন্ত্রটা শরীরের কোথায় লাগাবে সেটা এখনও ঠিক করতে পারছে না। আমেরিকায় তো সব দেশের লোকই একসঙ্গে কাজ করে। এই নিয়ে স্পেনের চিকিত্সকদের সঙ্গে সুইডেনের প্রযুক্তিবিদদের ঝগড়া লেগেছে। কেউ বলছে কানে লাগানো হোক, কেউ বলছে নাকে। বোঝো কাণ্ড! এই ঝগড়া যে কবে থামবে।
আমার পাকা বন্ধু বলছে, 'চিন্তা করিস না। ঝগড়া মিটে যাবে। যতই চিন বাজার দখলে এগিয়ে আসুক, যতই জাপান প্রযুক্তিতে পাকা হোক, আমেরিকার সঙ্গে টেক্কা দেওয়া খুব কঠিন। সাধে কি হারামজাদারা গোটা দুনিয়ার মাথা পয়সা দিয়ে কিনে নিজেদের খাঁচায় পুরে রেখেছে? তুই বল একবার।'
আমি আবার কড়া গলায় বলি, 'তুই থামবি?'
আচ্ছা, এসব তো চিন, জাপান, আমেরিকার কথা হল, 'জিরো-জিরো' যন্ত্রের ব্যাপারে আমাদের কী অবদান? বাঙালিদের?
কিস্যু না। বিগ জিরো। হা হা হা...। আমরা শুধু ছবি আঁকছি, কবিতা লিখছি, গান গাইছি, গল্প বলছি আর হা-হুতাশ করছি। বলছি, "আহারে! সেই সুন্দর মন খারাপের দিনগুলো সব কোথায় গেল। 'জিরো-জিরো' সব কেড়ে নিল!"
ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গিয়েছি। 'জিরো-জিরো' হল সেই যন্ত্র, যা সঙ্গে রাখলে মন খারাপ হয় না। সবসময় হাসি পায়। কখনও মিটিমিটি, কখনও কখনও দাঁত বের করে।
( 2 )