স্বপ্নময় চক্রবর্তী
মা


ভদ্রলোকের বীজ, ওর বউয়ের ডিম্বানু মিশিয়ে, হিসেব করে যুথিকার পেটে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল।

যুথিকা পেট ভাড়া দিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরল-নৈহাটি। এতদিন কলকাতার বালিগঞ্জে ছিল। আসলে ও ছিল সারোগেট মাদার। বউটা কি একটা গণ্ডগোল ছিল। ছোটচুল ওলা ফর্সা বউ। গরু ছাগলের হলে বলে পাল ছেড়ে দেওয়ার দোষ। বউটা গর্ভ রাখতে পারতোনা। ভদ্রলোকের বীজ, ওর বউয়ের ডিম্বানু মিশিয়ে, হিসেব করে যুথিকার পেটে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল। যুথিকা ছিল ও বাড়িতেই। ভালোমন্দ খেয়েছে। ওদের টাকায় দুধ ছানা ডিম। যুথিকা তো জানতো ও খাচ্ছে না, খাচ্ছে পেটেরটা। বাচ্চা হ'ল। খুব ফুটফুটে। তারপরও চারমাস ও বাড়িতে ছিল যুথিকা। বাচ্চাটাকে দুধ খাইয়েছে, বুকের দুধ।

এবার ওরা আমেরিকা চলে গেছে। স্বামী আগেই গিয়েছিল, এবার বউ আর বাচ্চা। যুথিকাকে অনেক টাকা দিয়েছে। শাড়িও।
ওদেশে নাকি পেটভাড়ার খরচ আরও অনেক বেশি। ওখনও যুথিকার বুক টনটন করে। বুকে এখনও দুধ রয়েছে। দুধের জন্য নয়! আরও ভিতরে কিছু আছে, ওখানেই কষ্টটা।
ওই বাচ্চাটার...



দেহদান



আমি পিসিমার বাড়িতে থেকে পড়াশুনো করতাম। পিসিমার বাড়ির একতলায় নতুন ভাড়াটে এল। একজন মহিলা আর্টিস্ট। আমি তখন ক্লাস ইলেভেন।
ভদ্রমহিলা বেশ সুন্দরী। ছোটচুল। হাতকাটা জামা। ছবি আঁকতেন। দেখতে যেতাম। সব ছবির মানে বুঝতাম না। কয়েকটা ছবিতে নগ্নতাও থাকতো। স্ত্রী পুরুষের মিলিত নগ্নতা ছাড়াও নগ্নপুরুষও দেখেছি। ওর কাছে অনেক পুরুষও আসতো। ভিতরে কী হ'ত জানি না। জানলা বন্ধ থাকতো।
আর্টিস্টদের তো মডেল থাকে তাই না? আমাকে মডেল করবে? তারপর....। কত কী ভাবতাম। বিচ্ছিরি ভাবনা। ওই বয়সে কি ভাবনা পোষ মানে?
ওই মহিলা একা থাকতেন। উঁকিঝুঁকি কম করিনি। ওর অন্তর্বাস শুকোতে দেখেছি রোদ্দুরে। কত কী কল্পনা। ওই বয়সে কল্পনার কি লাগাম থাকে?
ওই ভদ্রমহিলা বেশ যুবতী। দারুন শরীর। ওর একটা ছবি দেখলাম, নিজের শরীর। নিজেরই আকা। আমার খুব রক্তমাংসের শরীর দেখতে ইচ্ছে করতো, অন্তত কিছুটা।
হায়ার সেকেন্ডারির পর ডাক্তারিতে সুযোগ পেয়ে গেলাম। বাঁকুড়া চলে যেতে হল। যাবার আগে দিদির সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। কয়েকটা নিষিদ্ধ ইচ্ছে অপূর্ণই রইল।...না পাওয়াই থাক। হোস্টেলে চলে গেলাম।
ডাক্তারি পড়তে লাগলাম। আর্টিস্ট দিদিমনির কথা মনে পড়তো মাঝে মাঝে। বিশেষত অ্যানটমির ক্লাসে। স্বপ্নও দেখেছি কয়েকবার। কিছুদিন পর পিসিমার বাড়ি গিয়ে জানলাম আর্টিস্ট দিদিমনি বাড়িটা ছেড়ে দিয়েছে।
একদিন ডিসেকশন টেবিলে একটা বডি এল। শুনলাম যার বডি, উনি সেটা দান করেছেন। সুইসাইড করেছিলেন, সুইসাইড নোটে ছিল দেহটা যেন মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কাজে লাগে।
চাদর ওঠালেই দেখা গেল সেই আর্টিস্ট দিদিমনি।
নিরাবরণ।
চোখ বুঁজি।
পাথর



আমার বইয়ের আলমারিতে শরত্‍রচনাবলীর পিছনে একটা ইটের টুকরো আছে। চুনবালি মেশানো। বউ একদিন আলমারি পরিষ্কার করতে গিয়ে ফেলে দিল। বলল আজে বাজে জিনিস কেন যে আলমারির ভিতর...।
আমি ওটা কুড়িয়ে আমার একটা কোটের পকেটে পুরে রাখলাম। যে কোট কোনও দিন পরব না।
একদিন আলমারি পরিষ্কার করার সময় আবার ওটা বউ এর হাতে পড়ল।
এ কী? কোটের ভিতরে পাথর?
পকেট থেকে বার করে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
ওটা ১৯৬১ সালের সেনেট হল ভাঙা পাথর। সেনেট হলটা ভাঙা হচ্ছিল, আর পিছনে ভিয়েতনামের মানুষের সমর্থনে মিটিং হচ্ছিল। এই মিটিং থেকে বেরিয়ে পূরবী আর আমি।
পাথরটা পূরবী দিয়েছিল।
ওটা এখন বন্ধক।




আংটি




আমার হাতে কিছুই থাকে না বলে খুব বড় জ্যোতিষীর কাছ থেকে নিয়েছিলাম একটা গোমেদ বসানো আংটি। ছুচু করার সময় কমোডে পড়ে গেল। ফ্লাশও টানা হয়ে গেল। আমার হাতে যে কিছুতেই কিছু থাকে না।




প্রতিবাদ



একটি হোমের মূক ও বধির কিশোরী ধর্ষিতা হয়েছে।
ধর্ষক ওই হোমেরই রক্ষক।
মেয়েটা চিত্‍কার করতে পারেনি কারণ ওর মুখে পলিথিন প্যাকেট গুঁজে দেওয়া হয়েছিল।
ওকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরীক্ষার জন্য ওর স্কার্ট তোলা হল।
মেয়েটা দু'হাত দিয়ে ওর স্কার্ট নামিয়ে দিল। ডাক্তারবাবু বললেন-এটা একটা পরীক্ষা মা, অপরাধ প্রমাণ করতে হবে তো...। কিচ্ছু না, একটু দেখব। মেয়েটির মাথায় হাত বুলোলেন মধ্যবয়সী ডাক্তার। মেয়েটি শূন্য দৃষ্টিতে ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
ডাক্তার বাবুর সঙ্গে একজন নার্সও ছিল। এবার নার্সটি স্কার্টটা ওঠাতে গেল। মেয়েটা চিত্‍কার করল, এবং তীব্র, ওদের অবোধ্য ভাষায় কিছু বলছিল-আঁ-আঁ-মা-না-গোঁ-মা...
ওর মুখে তখন প্লাস্টিক পোরা নেই।
চিত্‍কার করতে পারছে।




রামকৃষ্ণ


এখন খুব মনীষী। বাসস্ট্যান্ডে মনীষীর ছবি, এখানে-ওখানে মনীষী। কলকাতার বড় রাস্তার মোড়ে মাইকে রবীন্দ্রসঙ্গীত। বড় রাস্তায় বোর্ডের ভিতরে আলোর বিন্দুতে রবীন্দ্রনাথ ফুটে ওঠে। আবার রবীন্দ্রনাথ মিলিয়ে গেলেই ওখানেই ফুটে ওঠে নবাবের গেঞ্জি ও জাঙ্গিয়া।
তো, পরান এখন মনীষী খাটে। ও আগে স্ট্যাচু-কাজটা খুব ভাল পারে। হাত পা না নেড়ে অনেক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থাকাটা একটা ক্ষমতা। বিয়ে বাড়িতে মাথায় পাগড়ি পরে, মুখে গোঁপ লাগিয়ে একটু ঝুঁকে মহারাজা হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে, হাতে বর্শা নিয়ে সান্ত্রী হয়ে থেকেছে গেটে, কথনও চার্লি চ্যাপলিনও হয়েছে। চার্লির স্ট্যাচু হতে হয় না। ও হাত নাড়ায়, হাঁটে, চোখ ঘোরায়।
আজকাল মনীষীও আর্ট। স্বামী বিবেকানন্দের সার্ধশতবর্ষে মাথায় পাগড়ি দিয়ে, বুকে আড়াআড়ি হাত রেখে বিবেকানন্দ হয়েছে, সাদা চুলদাড়ি, আলখাল্লা পরে রবীন্দ্রনাথও। মাথার সামনে টাক বানিয়ে বিদ্যাসাগর। চেতনা সঙ্ঘ বিবেকমেলা করেছে, ওখানে আজ রামকৃষ্ণ হবে পরান। ধুতি, ফতুয়া, আর কালো জহরকোট। মুখে দাড়ি। একটা দাঁতে কালো রং। পয়সার জন্যই তো এই মনীষী খাটা।
পরানের ঠাকুরমা জহরকোটের পকেটটা দেখে নেয়। পকেটে পয়সাকড়ি নেই তো? রামকৃষ্ণের তোষকের তলায় টাকা ছিল বলে রামকৃষ্ণের সর্বাঙ্গ জ্বালাপোড়া করেছিল। ওর কোটের পকেটটা দেখে নিন, কিছু নেই তো?
পণ্য



আমি একা থাকি। রেঁধে খাই। ছুটির দিনে মাংস করি। দুপুরে রবিবাসরীয় পড়তে পড়তে ঘুমোই। আমার একতলা বাড়ি। খুব মশা। আর হকার। ছুটির দিনে হকার খুব জ্বালাতন করে।
সাড়ে নটায় বেল বাজল। জ্যাম জেলি আচার।
না। ও সব লাগে না। দরজা বন্ধ করলাম।
দশটায় একটি অন্ধ। ধূপকাঠি।
না। ধূপকাঠি লাগে না।
এগারোটায় টাইপরা যুবক। এ্যাকোয়াগার্ড।
না। আমার দরকার নেই। আমার পেট কাকের মতো। সব হজম হয়। পেটখারাপ হয় না আমার।
এবার একটি মেয়ে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কোনও পণ্য বয়ে আনেনি ও। শুকনো ঠোঁটের উপর ব্যাণ্ডেজের মতো লিপস্টিক। চোখের ভিতরে পাখির বাসা। কিছু বলছে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।






































Table of Contents