গানওলার গান


আমার জন্ম হয়েছিল উনপঞ্চাশ সালে, কটকে। পাঁচ বছর বয়স অবধি আমি কটকেই ছিলাম। ওখানে পুজোর গান তো আর বাংলায় ছিল না, কাজেই পুজোর গান জিনিসটা কী সেটা আমি প্রথম জানতে পারি পাঁচ-সাড়ে পাঁচ বছর বয়সে কলকাতায় এসে। খুব সত্যি বলতে, যখন আমি ছোট ছিলাম, তখন গান শুনতাম। সেটা পুজোর গান না কীসের গান, ওসব ভাবতাম না। আমি গান শুনছি মায়ের পেট থেকেই প্রায়। শুধু গান নয়, বাজনা। ফলে কলকাতায় এসে প্রথম যখন বাংলা গান রেডিও মারফত আমার কাছে পৌছনোর সুযোগ পেল, তখন আলাদাভাবে পুজোর গান বলে কিছু বুঝতাম না। রেডিওতে গান হচ্ছে, পাগলের মতো শুনতাম। এই ছিল তখন গান বাজনা শোনা। তারপর দু'এক বছরের মধ্যে এখানে ওখানে লোকের কথা শুনে বুঝলাম যে, পুজোর সময় শিল্পীদের গান বেরোয়। তখন আমার বয়স ছয়-সাত হবে। সেইসময় পুজোর গান মানেই নতুন গান। তখন একটা গ্রামাফোন ডিস্ক ছিল, সেভেন্টি এইট আরপিএম। দুটো গান থাকত। একপিঠে একটা, অন্যপিঠে আরেকটা। তখন তো দম দিয়ে গান শোনার যুগ।

১৯৬১ সালে প্রথম বৈদ্যুতিক রেকর্ড প্লেয়ার বাজারে বেরলো। তখন আমার বারো বছর বয়স। তার আগে গ্রামাফোনই ছিল প্রধান। এই গ্রামাফোনের যে রেকর্ডগুলো রেডিওতে বাজত। রেডিওতে বাজলে আমরা বুঝতে পারতাম সেগুলো পুজোর গান। তবে রেডিওতে কিন্তু পুজোর গান হিসেবে বাজতো না। অনুরোধের আসরে গানগুলো বাজতো। আমরা যারা গানবাজনার পোকা, তাদের সব গান প্রিয় ছিল। কোনও বিশেষ শিল্পীর গান আমার প্রিয় ছিল না। যে গান শুনতে ভালো লাগত, সে যারই গাওয়া হোক, সেটাই আমার কাছে প্রিয় ছিল। আমি, আমার বড় ভাই রেকর্ড শুনতে শুনতে গানটাকে খাতায় লিখতে চেষ্টা করতাম। আমি পরে জেনেছি আরও অনেকে এরকম করতেন। যেখানে একটা শব্দ বাদ পড়ে যেত, অপেক্ষা করতাম আবার কবে গানটা বাজবে। আমার কোনও প্রিয় শিল্পী ছিলেন না, সকলেরই গান ভালো লাগত। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের গান আমার খুব ভালো লাগত। মৃণাল চক্রবর্তীর গান অসম্ভব ভালো লাগত। হেমন্তবাবুর গান ভালো লাগত, তবে একবারও বলব না যে ওর গানই সবথেকে ভালো লাগত। মান্না দে তখনও আমার কাছে পরিচিত নন। খুব ছোটবেলায় মান্না দে-র দু'একটি গান শুনেছি, তবে আহামরি আমার লাগেনি। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্য, পান্নালাল ভট্টাচার্য্য এদের সকলেরই গান ভালো লাগত। মহিলাদের মধ্যে আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় আমার কাছে বিস্ময়কর শিল্পী। পাঁচের দশকে গায়ত্রী বসু, বাণী ঘোষাল। মহালয়ার আশেপাশে থেকে, ধরা যাক পুজোর মাসখানেক আগে থেকে রেডিওতে একটা নতুন গান বাজছে, যেটা আমরা আগে শুনিনি, তখনই ধরে নেওয়া যেত যে ওটা পুজোর গান। ওই মর্মে যদিও কোনও ঘোষনা ছিল না। তখন তো আর আজকের মতো খোলামকুচির যুগ না, তখন সবকিছুর একটা দাম ছিল। এখন তো সবাই সবকিছু পারে। নেমে পড়লাম, 'আমি সকালবেলা ভেবে দেখলাম আলপনাকে আমি ভালবাসি, ইন্দুর বাবা আমাকে জুতো মারল', এরকম যুগ ছিল না। বাঙালির এতটা কুতসিত্‍ কদাকার, হীন অবস্থা ছিল না। কোনও ক্ষেত্রেই না। তখন বাঙালি ফুটবল খেলত, ব্যাটবল খেলত না। তখন খেলোয়াড় ছিল, প্রাণবন্ত লোক ছিল। দেখলে মনে হত পুরুষ, এখন পুরুষ পাওয়া যায় না। তখন একটা গান, ধরা যাক সলিল চৌধুরী, একটা পুজোয় তাঁর সুরে কথায় হয়তো দেখা যাবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গাইছেন, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গাইছেন, আর হয়তো শ্যামল মিত্র। একজন গীতিকার, সুরকার সারা বছরে হয়তো একজন শিল্পীর জন্য চারটে গান তৈরি করছেন। বা দুটো। ফলে তাঁর সেরা কাজটা পেতাম আমরা। তখন ওই গ্রামাফোন রেকর্ডের এপিঠে একটা, ওপিঠে একটা পুজোর গান শুনতে পেতাম আমরা।

( 1 )


নচিকেতা ঘোষ বা রবীন চক্রবর্তী, অনুপম ঘটক, দীলিপ সরকার, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যারা আমার কাছে সুরের দেবতা, তাঁরা খুব কম গান তৈরি করতেন।

এরপর কালক্রমে বসন্ত বন্দনা বলে একটা জিনিস এল। বছরের মাঝে কোথাও রিলিজ হতো। তবে পুজোর গানগুলো ছিল ফাইনাল খেলার মতো। ফলে আমরা অনেক উত্‍কৃষ্ট সৃষ্টি শুনতে পেতাম। নচিকেতা ঘোষ বা রবীন চক্রবর্তী, অনুপম ঘটক, দীলিপ সরকার, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যারা আমার কাছে সুরের দেবতা, তাঁরা খুব কম গান তৈরি করতেন। তখন পুজোর জামা ঈদের জামার মতোই পুজোর গান, ঈদের গান নিয়ে একটা উত্তেজনা থাকত। এইসময়ের গান ছিল একদম নতুন আর নির্বাচিত। কোনও কোনও পুজোর মণ্ডপে পুজোর গান বাজত। ছোটবেলায় আমার মুদিয়ালির পাড়ার পুজো মণ্ডপে 'দুরন্ত ঘূর্ণি এই লেগেছে পাক', গানটা প্রথম শুনলাম। প্রিলিউড মিউজিকটা শুনে অসম্ভব আনন্দ হয়েছিল। একে পুজোর আনন্দ হচ্ছে, তারপর গানটাও অসামান্য, বাজনাটাও অসামান্য, পুরোটা মিলিয়ে একটা দারণ ব্যাপার তৈরি হল। তখন মধ্যবিত্ত বাঙালির অর্থনৈতিক ক্ষমতা খুবই সীমিত ছিল। গ্রামাফোন কেনার টাকাও আমার বাবার ছিল না। খুব শখ করে রেকর্ড কিনতেন হয়তো। সকলের বাড়িতে রেডিও ছিল না। যাদের বাড়িতে ছিল অন্যরা এসে তাদের বাড়িতে শুনতেন। এতো উপকরণও ছিল না, এতো স্বঘোষিত পণ্ডিতও ছিল না। একজন লোকের রেকর্ডিং হচ্ছে মানে তাকে অন্তত আকাশবানীর বি-হাই গ্রেডের শিল্পী হতে হতো। সমাজের একটা অভিভাবক ছিলেন। আজ সবই অভিভাবকহীন। এখনকার মতো হঠাত্‍ করে নেমে পড়লাম মাঠে, ওভাবে হতো না। গানটা শিখতে হতো আগে।

এখন তো দেখি সকলেই সুর করতে জানে। সেইসব সুর শুনে মনে হয়, এ যদি সুর হয় তবে আরশোলাও পাখি। যোগ্য লোক এখন প্রায় নেই বলা যেতে পারে। তখনও কম ছিলেন, কিন্তু ছিলেন। সে সময়টাই আসলে বড় অদ্ভুত সময়। অতজন চমত্‍কার সুরকার ছিলেন, তবে সে তুলনায় গীতিকার কিন্তু দুর্বল ছিলেন। আধুনিক গানের সব কথা যে খুব উত্‍কৃ্ষ্ট ছিল তা বলা যাবে না। অতুলপ্রসাদ, কাজী নজরুল ইসলাম, এমনকী রবীন্দ্রনাথেরও অনেক গানের কথা আমার ভালো লাগে না। তখন সমালোচনাটাও ছিল না। এখন যদি কেউ দুর্বল গান লিখে থাকে তখন সবাই তার পিছনে লাগবে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, ডি এল রায়, অতুলপ্রসাদ বা রজনীকান্তের দুর্বলতা সম্পর্কে একটা কথাও কেউ বলে না। ইংরেজি গানেরও কথা যে খুব ভালো ছিল তা নয়, কিন্তু সুরগুলো ভালো ছিল। আমরা আধুনিক গান শুনতাম সুরের জন্য। সুরই ছিল আসল। আজ সেটা নেই। তাই গান আর মনে থাকছে না।

গান শোনার আনন্দেই আমাদের দিন কাটত। আমাদের বাড়িতে বড়জোড় একটা রেডিও ছিল। টেলিফোন কোনওদিন আসবে বলে ভাবতেও পারিনি। সকলে মিলে খুব সাধারণ ভাবে থাকতাম। গাড়ি ছিল না। সে যুগে কারও বাড়িতে যদি একটা গাড়ি এসে দাঁড়াত তা নিয়ে আলোচনা শুরু হতো। গাড়ি থেকে যে নামছে সে সাহেব। নেমন্তন্ন বাড়িতে সাহেব আসবে। সাহেব? সেই সাহেব হয়তো ইন্ডিয়ান টেলিফোনের মতো কালো। সাহেব কেন? না তিনি গাড়িতে এসেছেন! ধুতি-পঞ্জাবি বা পাজামা ছেড়ে প্যান্ট-শার্ট পরলে সাহেব। সেই ছিল যুগ। ভারী মিষ্টি, মজার যুগ। যেটুকু ছিল, তার মধ্যে পাঞ্চ খুব বেশি ছিল। আজ সেই পাঞ্চটাই আর নেই। চৈত্র মাসের রোদ্দুরের মতো সভ্যতার যে চিড়বিড়ানিটা ছিল, যা জানান দিত আমি বেঁচে আছি, সেটা হারিয়ে গেছে।

( 2 )





গানওলার গান


একবার পুজোর গান হয়ে গেলে আর তো সেটাকে পুজোর গান হিসেবে কেউ জানতাম না, সেটা গান হয়ে থেকে যেত। পুজোয় খুব বোরিং, ঝুল গানও হয়েছে। সেগুলো মনমরা হয়ে শুনতাম। কিন্তু, সলিল চৌধুরীর সুরে যখন শ্যামল মিত্রর যা যারে যা, যা পাখি গানটা শুনছি, সে কী আনন্দ! সে আনন্দর মধ্যে একটা সর্বজনীনতা ছিল। গানের ভূমিকার মধ্যে রেডিওর ভূমিকাই ছিল প্রধান। তখন লোকে রেডিওয় খবর শুনে ঘড়ি মেলাত। যে গান রেডিওয় প্রচারিত হচ্ছে না, সে গান জনপ্রিয় হয় না। এই ধারাকে প্রথম ভাঙল তোমাকে চাই নামের একটি অ্যালবাম। সেটা ক্যাসেট। রেডিওতে বাজানো সম্ভব না কখনও। অথচ গানগুলো মানুষের মুখে মুখে ফিরে ফিরে ঘরে ঘরে ঢুকে গেল। একটা রেখা অতিক্রম করে গেল তোমাকে চাই। এই অ্যালবামটার আগে ছিল রেডিওর যুগ, পরে আর রেডিওর যুগ না। নতুন যুগ শুরু হল ১৯৯২ সালে। তখন ডিস্ক নেই, গ্রামাফোন কোম্পানির সঙ্গে সেই চুক্তিও নেই। বাজানোর উপায়ও নেই। এইভাবেই পুজোর গানের অবসান হয়ে গেল। এখনও পুজোর গান বেরোয়, কিন্তু আগে একজন শিল্পী পুজোর গানের জন্য ট্রেনিংয়ে থাকতেন। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কেও ট্রেনারের কাছে গিয়ে গান তুলতে হতো। আমি যখন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জন্য বারোটা গান তৈরি করেছি, উনি বলতেন, "ভাই শেখাবে কবে?" এই 'শেখাবে' কথাটা গত কুড়ি বছরে আর কারও কাছে শুনিনি।

এখন যখন কেউ কেউ আমাকে ভুল করে গান তৈরি করার জন্য ডেকে ফেলে, গানও তৈরিও করেছি, তবে তারা কিন্তু কেউ বাড়িতে বসে শেখেননি। কেউ বলেনি, "সুমনদা, গানটা আগে শেখাও"। কিন্তু আমি হেমন্তবাবুকেও বলতে শুনেছি, আগে শেখাও, দেখি পারি কি না, তারপর গাইবো। প্রত্যেকটা কোম্পানির একজন ট্রেনার ছিলেন। তাদের কাছে গ্রীষ্মকালের আগে থেকে শিল্পীরা পুজোর গানের প্রস্তুতি নিতেন। এটা একটা লম্বা প্রক্রিয়া ছিল। এখন লোকের কাছে গান নিয়ে পৌছনো খুব সহজ হয়ে গেছে। যে কেউ গান গেয়ে ইন্টারনেটে আপলোড করে দিতে পারে। তবে এর দুটো দিক আছে। এর ভালো দিকটা হল গণতন্ত্রায়ন। কে বলতে পারে কার মধ্যে কোন প্রতিভা লুকিয়ে আছে? হয়তো এই প্রক্রিয়াটা আছে বলে কেউ ছোট্ট একটা গান বা কবিতা, অথবা মোবাইলে ছোট্ট একটা ছবি করে আপলোড করে দিল। সেখান থেকেই হয়তো তাকে আমরা আবিষ্কার করলাম। এটা হল ভালো দিক। আর সব ভালো দিকেরই খারাপ দিক থাকে। তবে একটা মানুষের বোঝা উচিত্‍ যে কোনটা তার দ্বারা হচ্ছে না। আগে আকাশবানীর অডিশন রুমটা দেখার মতো ছিল। গরমকালেও লোকে গলায় মাফলার বেঁধে যেত। লাইনে বসে অপেক্ষা করার মধ্যে একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার ছিল। সতীনাথ মুখোপাধ্যায় অডিশনে ছ'বার ফেল করেছিলেন। উনি সেটা সগর্বে বলতেন। এবং ছ'বারই নাকি আমার পিতৃদেব ছিলেন জুরিতে। আমাকে বলতেন, "তোমার বাবার কাছে আমি ছ'বার ফেল করেছি জানো? এতটা আমার কৃতিত্ব। সাত বারের বার কিন্তু পাশ করেছি।"

এখন সবাই মনে করে 'আমি পারি'। কী কুক্ষণে যে আমি গিটার নিয়ে এসেছিলাম। সবাই এখন গিটার কেনে, আর গিটার বাজিয়ে অদ্ভুত সব গান! ভালো দিকটা হল, আরে করছে তো। খুন তো করছে না, মেয়েদের পিছনে আওয়াজ দিয়ে সময় তো নষ্ট করছে না, একটা মেয়েকে গান শুনিয়ে মন ভোলাচ্ছে। চাঁটি তো মারছে না বা পাশের বাড়িতে গিয়ে ইঁট তো মারছে না। এটা আনন্দের দিক। আর দুঃখের দিক হল কিছুই হচ্ছে না! কারণ কেউ শিখছে না। আগে ছিল শিক্ষাটা আগে। অডিশন দেওয়ার সময় ফরমে লিখতে হতো কে কার কাছে গান শিখেছে। এখন সে সবের বালাই নেই। এখন ব্যক্তিগত পরিচিতি আর টাকার জোরেই সুযোগ হয়ে যাচ্ছে। যথন তেতাল্লিশ বছর বয়সে আমি ময়দানে এলাম, একটা লোক জিনস-শার্ট-জুতো পরে গিটার হাতে গাইছে এ দৃশ্য তো লোকে তার আগে দেখেনি, ফলে অনেকেই ভাবল গানটা শোনার দরকার নেই। এইভাবেই হয়ে যায় ব্যাপারটা। একটা নতুন দরজা খুলে গেল। ফলে একটা বাজার তৈরি হল। বাজার তৈরি হলে তার খাই মেটাতে হবে। সেই খাই মেটাতে গিয়ে যে সে মাঠে নেমে পড়লেন। মিডিয়া প্রথম থেকেই আমার পেছনে লাগা শুরু করল। পরে অবশ্য আমার হাত ধরেছে। আর এখন তো আমার হাত চেটে খায়। পাও চাটে।

( 3 )



শুধু এ তুমি কেমন তুমি-র সঙ্গে ওই দীর্ঘ অর্কেস্ট্রেশন আমি রাখতে চাইনি। গানের সুরটা একটা সহজ পল্লিগীতি নির্ভর সুর।

আমি খুব ভালো কমার্শিয়াল মিউজিক করি। ইলেকট্রনিক মিউজিক আমি শিখেছি। আটের দশকে ভাবতাম, আমি কিছু অল্প কাজ করবো, হাজার দুই তিন টাকা পাবো, তাতে আমার সংসার চলে যাবে। এই গান গেয়ে বিলিতি সিগারেট খাবো বাপের জন্মে ভাবিনি। কিন্তু, এরপরে ব্যাপারটা অভিভাবকহীন হয়ে গেল। পরিচালকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ার সুবাদে কোনও ফর্মাল ট্রেনিং ছাড়াই লোকে সঙ্গীত পরিচালক হয়ে যাচ্ছে। যিনি ডাক্তার নন এমন কাউকে কি আপনি বলবেন চিকিত্‍সা করতে? বা এমন কাউকে বলবেন বাড়ি বানাতে যিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়র নন? আমাকে কি কেউ বিরিয়ানি রান্না করতে বলবেন? আসলে উপযুক্ত লোককে আমরা সব জায়গায় খুঁজছি, সঙ্গীতে ছাড়া। সেইজন্যই এখন আর হচ্ছে না। আমার অবাক লাগে এদের মা, বাবা, প্রেমিকা, বউ কেউ নেই যে বলবে, এটা করিস না, বোকা বোকা লাগছে? এখন বাঙালি নিজের ভাষাটা ছাড়া সব ভাষার প্রতি উদার। উচ্চারণ শুনে বাংলা বোঝা যায় না। আমি সাংসদ থাকার সময় মাঝেমাঝেই দিল্লি যেতে হতো। সেখানে গাড়িতে এফএম রেডিও চলতো। কোনওদিন শুনিনি বাঙালি ছাড়া কেউ নিজের ভাষাটাকে ভেঙে ভেঙে বলছে। বাঙালি একটা অদ্ভুত হীনমন্যতায় ভোগে। তবে বাঙালি হিসেবে আমার কোনও গর্ব নেই। দৈবক্রমে আমি বাংলায় জন্মেছি। তিব্বতেও জন্মাতে পারতাম। তেমনই বাংলায় গান কেন গাই, অন্য কোনও ভাষা জানি না বলে। যদি হিন্দিটা এতটা ভালো জানতাম তাহলে হিন্দিতে গাইতাম। কারণ ওরা অনেক বেশি অ্যাপ্রিশিয়েট করে। প্রথম থেকেই পিছনে লাগে না। বলিউডে কুড়ি বছর আগে পর্যন্ত একজনও ফালতু লোক ঢুকেছে দেখাতে পারবেন? কিন্তু এখানে সেটা অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে। প্রযোজকরা জানিয়ে দেন, টার্ডেট আঠেরো থেকে কুড়ি বছর বয়সী। ছবি, গান সবই হবে এদের জন্য। ফলে আমাদের দেশে যেই কণ্ঠগুলো প্রি-মেন্সট্রুয়াল ভয়েস তারাই স্থান পায়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে অন্তত যারা গাইতেন, উত্‍পলা সেন, বাণী ঘোষাল, গায়ত্রী বসু, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, সুপ্রীতি ঘোষ প্রত্যেকের কণ্ঠ আলাদা আলাদা করে চেনা যেত।

রক এসেছিল প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা হিসেবে। আমাদের এখানে রক মানে মাথা ঝাঁকানো। হাবেভাবে কোনও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা নেই। সবকিছু ভীষণ জোরে। পাশ্চাত্যেও তাই হচ্ছে। আমেরিকার রক অ্যান্ড রোল, ইংল্যান্ডে রক, হল্যান্ড, সুইডেনে রক...এই রক আর রক অ্যান্ড রোল এক জিনিস নয়। এখানে সেটা কেউ বোঝেই না। কিন্তু তাও একটা জায়গা হচ্ছে। কেন? কারণ, আনক্রিটিকাল অডিয়্যান্স সেটা পছন্দ করছে। অডিয়্যান্স যদি আনক্রিটিক্যাল হয় শাসকশ্রেণির তাতে সুবিধা হয়। সে কারণেই বলিষ্ঠ কণ্ঠও এখানে স্থান পায় না। আমার শুভা মুদগলের গলা খুব ভালো লাগে। ওনাকে দিয়ে কি ফিল্মের গান গাওয়ানো যায় না? শ্রোতাকে মাইন্ডলেস করে রাখার একটা প্রবণতা রয়েছে। পপুলার সংস্কৃতির মাধ্যমে জনগণকে যেভাবে স্লেভ করা যায়, আর কিছুর মাধ্যমে যায় না। তবে আমি বিশ্বাস করি না সব্বাই এমন হয়ে গেছে। আমি নিজে শুনেছি একজন লোক ক্ষেতের ধারে বসে বাঁশি বাজাচ্ছেন, চমত্‍কার! তাদের কেউ ডাকবে না।

এখন যে আমি ফিল্মের মিউজিক করলাম, দেখছি এটা একটা নতুন যুগ। যেখানে ঢুকলে তোমাকে সেটা অ্যাকসেপ্ট করতে হবে। এখন সঙ্গীত পরিচালক কিছু ঠিক করে না, পরিচালক ঠিক করে। কিন্তু আমি যখন প্রভাত রায়, মাধবী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করেছি তখন মিউজিক ছিল সম্পূর্ণভাবে আমার ওপর। সেদিন চৈত্রমাসে যখন কাজ করলাম তখন ঠিক ছিল কবিতা কৃষ্ণমূর্তি গাইবেন। আমি চেয়েছিলাম বাংলার কেউ গান গাক। আমি প্রযোজককে বলেছিলাম প্রথম গানটা লোপামূদ্রাকে দিয়ে গাওয়াতে চাই। উনি গাইবেন, যদি আপনার পছন্দ হয় আপনি রাখবেন, অপছন্দ হলে আপনি রাখবেন না। লোপামূদ্রার ফার্স্ট রেকর্ডিং শুনে সেই প্রযোজক আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। তবে সৃজিত্‍ পুরো ব্যাপারটাই আমার ওপর ছেড়ে দিয়েছিল। শুধু এ তুমি কেমন তুমি-র সঙ্গে ওই দীর্ঘ অর্কেস্ট্রেশন আমি রাখতে চাইনি। গানের সুরটা একটা সহজ পল্লিগীতি নির্ভর সুর। ওই বিপুল অর্কেস্ট্রেশনের চোটে আমার মনে হল রূপঙ্করের গানটা হারিয়ে গেল। শুধু একটা গিটার বা তানপুরা বা যদি একতারা বাজত, আর কিচ্ছু লাগতো না! দীর্ঘকাল পর সেরা সঙ্গীত পরিচালকের রচিত একটা গান শ্রেষ্ঠ গান হিসেবেও বিবেচিত হল। কিন্তু বাকি গানগুলোর ক্ষেত্রে আমি পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়েছি। ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত অসাধারণ কাজ করেছেন আমার সঙ্গে। কবিয়ালদের পূর্ণাঙ্গ গানগুলোতে সুর করে বড় সুখ পেয়েছি। এর জন্য সৃজিতের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থেকে যাবো আমি। এই ছবিটা করতে গিয়ে যারা কোরাস গাইতে এলেন, তাদের মধ্যে তিন, চারজন অসাধারণ। একটি ছেলের গলা শুনে চোখে জল এসে গিয়েছিল। আর শ্রমণার গান শুনে, অনন্যার অভিনয় দেখে তো আমি মারা গেছি...

এখন সবার মিউজিকেই একটা বিপুল অর্কেস্ট্রেশন চলে আসছে। এ আর রহমানের সেই মিষ্টি দিল হ্যায় ছোটা সা এখন আর তৈরি হচ্ছে না। ওর মিউজিকেও এখন প্রচুর কিছু এসে গেছে। তেমনই বিশাল ভরদ্বাজের পানি রে পানি। সেই সরল মিউজিক আর তৈরি হচ্ছে না। ফলে গান আর স্মরণযোগ্য হচ্ছে না। কিন্তু এখনও পঞ্চাশ দশকের শচীনদেব বর্মণের সুর শুনলে মরে যেতে ইচ্ছা করে। তবে আমি নিজেকে সুরকার মনে করি না। আমি হলাম গান বানানেওয়ালা। গান আমি কোথা থেকে বানাই তা আমার অজানা। হঠাত্‍ই কেমন যেন একেকটা গান এসে যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি করছি না, অন্য কেউ আমাকে দিয়ে করাচ্ছে। মনে হয় ভূতে করে দিয়ে যায়। হঠাত্‍ হয়তো একটা লাইন মাথায় এল, মাঝের লাইন, ওটা ঘিরে একটা গোটা গানই তৈরি হয়ে গেল। এখন কম্পিউটারে লিখি, তবে কলমটা নিয়ে না বসলে গান বেরোয় না।

( 4 )

Table of Contents