গানওলার গান
আমার জন্ম হয়েছিল উনপঞ্চাশ সালে, কটকে। পাঁচ বছর বয়স অবধি আমি কটকেই ছিলাম। ওখানে পুজোর গান তো আর বাংলায় ছিল না, কাজেই পুজোর গান জিনিসটা কী সেটা আমি প্রথম জানতে পারি পাঁচ-সাড়ে পাঁচ বছর বয়সে কলকাতায় এসে। খুব সত্যি বলতে, যখন আমি ছোট ছিলাম, তখন গান শুনতাম। সেটা পুজোর গান না কীসের গান, ওসব ভাবতাম না। আমি গান শুনছি মায়ের পেট থেকেই প্রায়। শুধু গান নয়, বাজনা। ফলে কলকাতায় এসে প্রথম যখন বাংলা গান রেডিও মারফত আমার কাছে পৌছনোর সুযোগ পেল, তখন আলাদাভাবে পুজোর গান বলে কিছু বুঝতাম না। রেডিওতে গান হচ্ছে, পাগলের মতো শুনতাম। এই ছিল তখন গান বাজনা শোনা। তারপর দু'এক বছরের মধ্যে এখানে ওখানে লোকের কথা শুনে বুঝলাম যে, পুজোর সময় শিল্পীদের গান বেরোয়। তখন আমার বয়স ছয়-সাত হবে। সেইসময় পুজোর গান মানেই নতুন গান। তখন একটা গ্রামাফোন ডিস্ক ছিল, সেভেন্টি এইট আরপিএম। দুটো গান থাকত। একপিঠে একটা, অন্যপিঠে আরেকটা। তখন তো দম দিয়ে গান শোনার যুগ।
১৯৬১ সালে প্রথম বৈদ্যুতিক রেকর্ড প্লেয়ার বাজারে বেরলো। তখন আমার বারো বছর বয়স। তার আগে গ্রামাফোনই ছিল প্রধান। এই গ্রামাফোনের যে রেকর্ডগুলো রেডিওতে বাজত। রেডিওতে বাজলে আমরা বুঝতে পারতাম সেগুলো পুজোর গান। তবে রেডিওতে কিন্তু পুজোর গান হিসেবে বাজতো না। অনুরোধের আসরে গানগুলো বাজতো। আমরা যারা গানবাজনার পোকা, তাদের সব গান প্রিয় ছিল। কোনও বিশেষ শিল্পীর গান আমার প্রিয় ছিল না। যে গান শুনতে ভালো লাগত, সে যারই গাওয়া হোক, সেটাই আমার কাছে প্রিয় ছিল। আমি, আমার বড় ভাই রেকর্ড শুনতে শুনতে গানটাকে খাতায় লিখতে চেষ্টা করতাম। আমি পরে জেনেছি আরও অনেকে এরকম করতেন। যেখানে একটা শব্দ বাদ পড়ে যেত, অপেক্ষা করতাম আবার কবে গানটা বাজবে। আমার কোনও প্রিয় শিল্পী ছিলেন না, সকলেরই গান ভালো লাগত। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের গান আমার খুব ভালো লাগত। মৃণাল চক্রবর্তীর গান অসম্ভব ভালো লাগত। হেমন্তবাবুর গান ভালো লাগত, তবে একবারও বলব না যে ওর গানই সবথেকে ভালো লাগত। মান্না দে তখনও আমার কাছে পরিচিত নন। খুব ছোটবেলায় মান্না দে-র দু'একটি গান শুনেছি, তবে আহামরি আমার লাগেনি। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্য, পান্নালাল ভট্টাচার্য্য এদের সকলেরই গান ভালো লাগত। মহিলাদের মধ্যে আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় আমার কাছে বিস্ময়কর শিল্পী। পাঁচের দশকে গায়ত্রী বসু, বাণী ঘোষাল। মহালয়ার আশেপাশে থেকে, ধরা যাক পুজোর মাসখানেক আগে থেকে রেডিওতে একটা নতুন গান বাজছে, যেটা আমরা আগে শুনিনি, তখনই ধরে নেওয়া যেত যে ওটা পুজোর গান। ওই মর্মে যদিও কোনও ঘোষনা ছিল না। তখন তো আর আজকের মতো খোলামকুচির যুগ না, তখন সবকিছুর একটা দাম ছিল। এখন তো সবাই সবকিছু পারে। নেমে পড়লাম, 'আমি সকালবেলা ভেবে দেখলাম আলপনাকে আমি ভালবাসি, ইন্দুর বাবা আমাকে জুতো মারল', এরকম যুগ ছিল না। বাঙালির এতটা কুতসিত্ কদাকার, হীন অবস্থা ছিল না। কোনও ক্ষেত্রেই না। তখন বাঙালি ফুটবল খেলত, ব্যাটবল খেলত না। তখন খেলোয়াড় ছিল, প্রাণবন্ত লোক ছিল। দেখলে মনে হত পুরুষ, এখন পুরুষ পাওয়া যায় না। তখন একটা গান, ধরা যাক সলিল চৌধুরী, একটা পুজোয় তাঁর সুরে কথায় হয়তো দেখা যাবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গাইছেন, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গাইছেন, আর হয়তো শ্যামল মিত্র। একজন গীতিকার, সুরকার সারা বছরে হয়তো একজন শিল্পীর জন্য চারটে গান তৈরি করছেন। বা দুটো। ফলে তাঁর সেরা কাজটা পেতাম আমরা। তখন ওই গ্রামাফোন রেকর্ডের এপিঠে একটা, ওপিঠে একটা পুজোর গান শুনতে পেতাম আমরা।
( 1 )
নচিকেতা ঘোষ বা রবীন চক্রবর্তী, অনুপম ঘটক, দীলিপ সরকার, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যারা আমার কাছে সুরের দেবতা, তাঁরা খুব কম গান তৈরি করতেন।
এরপর কালক্রমে বসন্ত বন্দনা বলে একটা জিনিস এল। বছরের মাঝে কোথাও রিলিজ হতো। তবে পুজোর গানগুলো ছিল ফাইনাল খেলার মতো। ফলে আমরা অনেক উত্কৃষ্ট সৃষ্টি শুনতে পেতাম। নচিকেতা ঘোষ বা রবীন চক্রবর্তী, অনুপম ঘটক, দীলিপ সরকার, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যারা আমার কাছে সুরের দেবতা, তাঁরা খুব কম গান তৈরি করতেন। তখন পুজোর জামা ঈদের জামার মতোই পুজোর গান, ঈদের গান নিয়ে একটা উত্তেজনা থাকত। এইসময়ের গান ছিল একদম নতুন আর নির্বাচিত। কোনও কোনও পুজোর মণ্ডপে পুজোর গান বাজত। ছোটবেলায় আমার মুদিয়ালির পাড়ার পুজো মণ্ডপে 'দুরন্ত ঘূর্ণি এই লেগেছে পাক', গানটা প্রথম শুনলাম। প্রিলিউড মিউজিকটা শুনে অসম্ভব আনন্দ হয়েছিল। একে পুজোর আনন্দ হচ্ছে, তারপর গানটাও অসামান্য, বাজনাটাও অসামান্য, পুরোটা মিলিয়ে একটা দারণ ব্যাপার তৈরি হল। তখন মধ্যবিত্ত বাঙালির অর্থনৈতিক ক্ষমতা খুবই সীমিত ছিল। গ্রামাফোন কেনার টাকাও আমার বাবার ছিল না। খুব শখ করে রেকর্ড কিনতেন হয়তো। সকলের বাড়িতে রেডিও ছিল না। যাদের বাড়িতে ছিল অন্যরা এসে তাদের বাড়িতে শুনতেন। এতো উপকরণও ছিল না, এতো স্বঘোষিত পণ্ডিতও ছিল না। একজন লোকের রেকর্ডিং হচ্ছে মানে তাকে অন্তত আকাশবানীর বি-হাই গ্রেডের শিল্পী হতে হতো। সমাজের একটা অভিভাবক ছিলেন। আজ সবই অভিভাবকহীন। এখনকার মতো হঠাত্ করে নেমে পড়লাম মাঠে, ওভাবে হতো না। গানটা শিখতে হতো আগে।
এখন তো দেখি সকলেই সুর করতে জানে। সেইসব সুর শুনে মনে হয়, এ যদি সুর হয় তবে আরশোলাও পাখি। যোগ্য লোক এখন প্রায় নেই বলা যেতে পারে। তখনও কম ছিলেন, কিন্তু ছিলেন। সে সময়টাই আসলে বড় অদ্ভুত সময়। অতজন চমত্কার সুরকার ছিলেন, তবে সে তুলনায় গীতিকার কিন্তু দুর্বল ছিলেন। আধুনিক গানের সব কথা যে খুব উত্কৃ্ষ্ট ছিল তা বলা যাবে না। অতুলপ্রসাদ, কাজী নজরুল ইসলাম, এমনকী রবীন্দ্রনাথেরও অনেক গানের কথা আমার ভালো লাগে না। তখন সমালোচনাটাও ছিল না। এখন যদি কেউ দুর্বল গান লিখে থাকে তখন সবাই তার পিছনে লাগবে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, ডি এল রায়, অতুলপ্রসাদ বা রজনীকান্তের দুর্বলতা সম্পর্কে একটা কথাও কেউ বলে না। ইংরেজি গানেরও কথা যে খুব ভালো ছিল তা নয়, কিন্তু সুরগুলো ভালো ছিল। আমরা আধুনিক গান শুনতাম সুরের জন্য। সুরই ছিল আসল। আজ সেটা নেই। তাই গান আর মনে থাকছে না।
গান শোনার আনন্দেই আমাদের দিন কাটত। আমাদের বাড়িতে বড়জোড় একটা রেডিও ছিল। টেলিফোন কোনওদিন আসবে বলে ভাবতেও পারিনি। সকলে মিলে খুব সাধারণ ভাবে থাকতাম। গাড়ি ছিল না। সে যুগে কারও বাড়িতে যদি একটা গাড়ি এসে দাঁড়াত তা নিয়ে আলোচনা শুরু হতো। গাড়ি থেকে যে নামছে সে সাহেব। নেমন্তন্ন বাড়িতে সাহেব আসবে। সাহেব? সেই সাহেব হয়তো ইন্ডিয়ান টেলিফোনের মতো কালো। সাহেব কেন? না তিনি গাড়িতে এসেছেন! ধুতি-পঞ্জাবি বা পাজামা ছেড়ে প্যান্ট-শার্ট পরলে সাহেব। সেই ছিল যুগ। ভারী মিষ্টি, মজার যুগ। যেটুকু ছিল, তার মধ্যে পাঞ্চ খুব বেশি ছিল। আজ সেই পাঞ্চটাই আর নেই। চৈত্র মাসের রোদ্দুরের মতো সভ্যতার যে চিড়বিড়ানিটা ছিল, যা জানান দিত আমি বেঁচে আছি, সেটা হারিয়ে গেছে।
( 2 )