বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র
প্রোগ্রাম করবে তার আবার বামুন কায়েত কী হে?


হঠাত্‍ একদিন বুড়োদা (প্রেমাঙ্কুর আতর্থী) বলে উঠলেন, দেখ, রোজ রোজ গান, বাজনা, বক্তৃতা, থিয়েটার, গল্পদাদুর আসর, মহিলা মজলিস এসব তো চলছে-কিন্তু আরও ধাক্কা দিতে হবে শ্রোতাদের। নৃপেনবাবু হেসে বলে উঠলেন, আর কতো ধাক্কা দেওয়া যায় ভাই, সকাল থেকে রাত অবধি তো এই কটা লোক প্রোগ্রাম চালাচ্ছে-এর ওপর আবার কী করা যাবে বল? বুড়োদা (প্রেমাঙ্কুর আতর্থী) বললেন, করা যাবে না কেন? ধর, আমরা একদিন রাত দশটা থেকে রাত চারটে পর্যন্ত বড় বড় গাইয়ে বাজিয়েদের নিয়ে একটা জলসা বসালুম। রাত্তিরে যে সব রাগ গাইলে বা বাজালে জমে, সেইগুলি চালানো হল-তখনই শ্রোতাদের কাছে একটা চমকপ্রদ প্রোগ্রাম বলে মনে হবে। কোনোদিন হয়ত ভোর চারটে থেকে প্রোগ্রাম শুরু করে দিলুম, সেটাও একটা নতুনত্ব হবে। নৃপেনবাবু(নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার) বললেন, সেই রকম একটা কী প্রোগ্রাম করা যায় ভাব দেখি-বুড়োর এক্সপেরিমেন্টটাই করে দেখা যাক।

আড্ডা দিতে গিয়ে, খেলার ছলে এর সূচনা। প্রথম যেদিন এটা লেখা হল সেদিন বাঙালির জয়জয়কার। তখন গান গেয়েছিলেন রাধারানী দেবী, শৈল দেবী, সত্য চৌধুরী, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, উত্‍পলা সেন, সুপ্রভা সরকার, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, জগন্ময় মিত্রের মতো সব কিংবদন্তীরা। বাণীকুমার অসাধারণ সংস্কৃত লিখতেন। প্রচুর কাহিনি জোগাড় করে তিনি সাজিয়েছিলেন। কণ্ঠে নিয়ে এলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে। সুরকারদের মধ্যে ছিলেন মহম্মদ সগিরুদ্দিন খাঁ।
- পার্থ ঘোষ

বুড়োদা বললেন, এই তো বাণী রয়েছে, সংস্কৃতের তো আদ্যশ্রাদ্ধ করেছে-ও কতকগুলো বৈদিক শ্লোক যোগাড় করে ফেলুক, আর গান লিখুক, রাই সুর দিক, বীরেন শ্লোক আওড়াক-ভোরবেলায় লাগিয়ে দাও, লোকের লাগবে ভাল। দু-একজন বললেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই লোকে নিশ্চিন্তে সে সময় ঘুমুবে।

নৃপেনবাবু বিরুদ্ধবাদীদের বাধা দিয়ে বললেন, ঘুমুক গে-নয় আমরাই প্রোগ্রাম শুনব। ওহে বাণী, একটা কিছু লিখে ফেল। একটু সহজ কিছু লিখ বাপু, নইলে আমরাও প্রোগ্রাম করতে করতে হয়তো ঘুমিয়ে পড়বো। বাণীকুমার তখনই ভাবতে শুরু করলেন। তখন আমি বললাম, নৃপেনদা, পুজো আসছে আর মাসখানেক বাদে, প্রতি পুজোর সময় আমি এক জায়গায় ঠাকুরের সামনে বসে বসে চণ্ডীপাঠ করি-খানিকটা সড়গড় আছে। শ্রীশ্রীচণ্ডীর কাহিনী নিয়ে যদি বেশ গান টান, শ্লোক লাগিয়ে একটা প্রোগ্রাম করা যায় তাহলে প্রোগ্রাম লোকে পছন্দ করুন না করুন দু-চার জন যারা ঘুম থেকে ভোরবেলায় উঠে আমাদের প্রোগ্রাম শুনবে তখন তাদের তা ভাল লাগতে পারে হয়তো।
বীরেনদা, পঙ্কজদার কথা অনেকেই বলেন, কিন্তু বাণীকুমার যেন কাব্যে উপেক্ষিত। ওনার মতো বিদগ্ধ মানুষের কল্পনা ছাড়া এ সৃষ্টি সম্ভব হত না। কিন্তু তিনি নিজেকে বেশি প্রকাশ করতে পারতেন না। দোল, জন্মষ্টমী বিভিন্ন উত্‍সবের স্ক্রিপ্ট উনি লিখেছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে সেসব সংরক্ষিত হয়নি। দিলীপ কুমার সেনগুপ্ত বলেছিলেন, বানীকুমার একটি হাওয়ার তাজমহল তৈরি করে গেছেন। হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে হয়তো, কিন্তু সংস্কৃতির দিক থেকে এ এক তাজমহল।
- জগন্নাথ বসু

( 1 )










সকলে বলে উঠলেন, হ্যাঁ, বীরেন যা বলেছে, বেশ ভাল প্রস্তাব, পুজোর সময় চণ্ডীপাঠ লাগিয়ে দাও। এর মধ্যে আবার একজন খুঁত ধরলেন, বললেন, কায়েতের ছেলে চণ্ডীপাঠ করলে লোকে কিছু বলবে নাতো? নৃপেনবাবু বললেন, প্রোগ্রাম করবে তার আবার বামুন কায়েত কী হে? আমরা কি হিন্দুর মন্দিরে গিয়ে পুজো করছি? তা হলে এই প্রোগ্রামে যারা বাজাবেন তারা তো অর্ধেক মুসলমান, খুশী মহম্মদ, আলি, মুন্সী, সবাই তো বাজাবে। তাহলে তো তাদের বাদ দিয়ে ব্রাহ্মণদের ডেকে আনতে হয়। তা ছাড়া আমরা একটা বিরাট উত্‍সবের আগে ভূমিকা হিসেবে এই প্রোগ্রাম করবো-এতে কার কী বলার আছে? প্রোগ্রামটা আসলে লিখবে এক বামুন-কী বল হে বাণী? বাণীকুমার হেসে বললেন, বটেই তো। এসব কথা ছেড়ে দিন না-আমি বীরেন ছাড়া কাউকে চণ্ডীপাঠ করতেই দেব না।

বাবা সকালবেলা ধোপদুরস্ত ধুতি-পাঞ্জাবি পরে, শাঁখ হাতে, চণ্ডী হাতে, ধূপ, ধুনো নিয়ে স্টুডিওয় যেতেন। সেদিন সারারাত আমাদের ঘুম হত না। সেই আবেগ ব্যক্ত করতে পারব না। শুধু স্ক্রিপ্ট রচনা নয়, সঙ্গীত রচনা, গায়ক-গায়িকাদের সংস্কৃত উচ্চারনের তালিমও দিয়েছিলেন বাবা।
- নৃসিংহকুমার ভট্টাচার্য্য(বাণীকুমারের ছেলে)

প্রস্তাব পাশ হয়ে গেল। হপ্তাখানেকের মধ্য বাণীকুমার কতকগুলো গান লিখে ফেললেন ও হরিশচন্দ্র বালী, রাইচাঁদ বড়াল ও পঙ্কজকুমার মল্লিক সে গুলিতে সুরসংযোগ করতে লাগলেন। 'অখিল বিমানে', 'বিমানে বিমানে আলোকের গানে' প্রভৃতি সুর হরিশ বালীর দেওয়া। সাগির খাঁর সুর-'শান্তি দিলে ভরি'। অবশ্য এ ছাড়া, 'মাগো তব বিনে সঙ্গীত প্রেম ললিত' প্রভৃতি অধিকাংশ সুর পঙ্কজের দেওয়া, এবং রাইচাঁদ বড়াল 'নিখিল আজি সকল ভোলে'-গানটির সুর দেন। * ১৯৩১ সালে শ্রী শ্রী মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর বিষয়বস্ত নিয়ে বসন্তেশ্বরী নামে একটি চম্পূ রচনা করেন বাণীকুমার। সেই বছরই অন্নপূর্ণা পুজোর সন্ধিক্ষণের সকালে বসন্তেশ্বরী প্রচারিত হয়। ভাল সাড়া দেখে ঠিক করা হয় মহালয়ার ভোরে এই অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হবে। তখনই বাণীকুমার বীথি নাট্যরচনাশৈলীর অবলম্বনে লিখে ফেলেন মহিষাসুরমর্দিনীর স্ক্রিপ্ট। তাঁকে সাহায্য করেছিলেন পণ্ডিত অশোকনাথ শাস্ত্রী।
* ১৯৩২ সালে মহালয়ার সকালে প্রথম মহিষাসুরমর্দিনী সম্প্রচারিত হয়।
* ১৯৬৫ সালে সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ হয়ে রেকর্ড চালানো শুরু হয়।
* ১৯৭৮ সালে প্রথম এইচএমভি-র পক্ষ থেকে রেকর্ড বেরোয়।
* বাংলা ভাষায় সর্বাধিক বিক্রিত অ্যালবাম মহিষাসুরমর্দিনী। রেকর্ড, ক্যাসেট, সিডি, ভিসিডি সবকিছুই সবার্ধিক বিক্রীত।

( 2 )

Table of Contents