নলিনীকান্ত সরকার
পূজামন্দির হয়ে উঠলো সমগ্র কলকাতা শহর
কলকাতা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম জনপ্রিয় অনুষ্ঠান "মহিষাসুরমর্দিনী"। মহিষাসুরমর্দিনী প্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৩৩৯(১৯৩২) সালের আশ্বিন মাসের দুর্গাপূজার ষষ্ঠী তিথিতে প্রভাতী প্রোগ্রামে। কিন্তু প্রকারান্তরে এই দুর্গাপূজার প্রভাতী প্রোগ্রাম সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত হয় তার আগের বছর বসন্তকালে। এই সময়ের দুর্গাপূজা-বাসন্তী পূজা। বাসন্তী পূজার পরদিন অন্নপূর্ণা পূজা। এই দুই পূজার সন্ধিক্ষণে কলকাতা বেতারকেন্দ্রে ভোরবেলায় অনুষ্ঠিত হলো "বসন্তেশ্বরী" প্রোগ্রাম। বসন্তেশ্বরীরও রচয়িতা বাণীকুমার। বাণীকুমারের এই চম্পূকাব্যে সুরসংযোগে গদ্যাংশের আবৃত্তি করেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, চণ্ডীর সংস্কৃত শ্লোকগুলি স্বয়ং বাণীকুমার আবৃত্তি করেছিলেন। গানগুলিতে সুরারোপ করেছিলেন হরিশচন্দ্র বালী এবং পঙ্কজকুমার মল্লিক। বসন্ত, দেবগিরি, বরাটী, টৌড়ী ও হিন্দোলী-এই কয়টি রাগে ছয়টি গানকে প্রমূর্ত ও প্রাণবন্ত করে তুলেছিলেন হরিশচন্দ্র বালী। বাকী গানগুলিতে সুরসংযোজন পঙ্কজকুমারের। পঙ্কজকুমারের রচিত সুরের গানগুলিও খুবই উপভোগ্য হয়েছিল।
মহিষারসুরমর্দিনী যখন স্টুডিও থেকে লাইভ হত, তখন একবার আমার মনে আছে বীরেনদা খুব ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলেন। তখন আমাদের একটিই মাইক্রোফোনে গাওয়া হত। বীরেনদার বলার পর পঙ্কজদা আমাকে এগিয়ে দিলেন, কিন্তু বীরেনদা এতটাই পুরো ব্যাপারটার সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন যে ওনাকে সরানো যাচ্ছিল না। হঠাত্ই তখন বুদ্ধি এল মাথায়। আমি দূরে দাঁড়িয়েই ধরলাম, "জাগো....", পঙ্কজদা থখন আমাকে আস্তে আস্তে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গিয়ে বীরেনদাকে সরিয়ে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিলেন...তখন গানটা আস্তে আস্তে ফেড ইন হল। আর এতে একটা অন্য মাত্রা এসে গেল। পঙ্কজদা খুব খুশি হয়েছিলেন। আমরা যারা অংশগ্রহণ করেছিলাম সবাই কেমন যেন এক সুরে বাঁধা হয়ে গিয়েছিলাম। পঙ্কজদা বলতেন হাতটা জোর করে মা'কে ডাকো। আমরা ডুবে যেতাম...
- দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়
এই বসন্তেশ্বরীর রূপান্তর মহিষাসুরমর্দিনী। মহিষাসুরমর্দিনীও বাণীকুমারের রচনা। মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানের সঙ্গে একালের বেতার শ্রোতাদের সম্যক পরিচয় আছে।
( 1 )
প্রথম দিনের অনুষ্ঠানটির কথা বলি। প্রায় পক্ষকাল আগে থেকে প্রোগ্রামটির প্রস্তুতি চলেছে। রাইচাঁদ বড়াল কলকাতা শহরের কলাকুশলী, যন্ত্রীদের এনে এক প্রকাণ্ড অর্কেস্ট্রা পার্টি গ্রহণ করলেন। বৈচিত্র্যাপূর্ণ নানা সুরের সমন্বয়ে তিনি রচনা করলেন একটি ঐকতান সঙ্গীতবিগ্রহ। গানগুলিতে সুরযোজনা করলেন হরিশচন্দ্র বালী ও পঙ্কজকুমার মল্লিক। হরিশচন্দ্র বালী একাধারে সঙ্গীতকোবিদ ও সঙ্গীতশিল্পী। পঙ্কজকুমার তখন উদীয়মান হলেও সঙ্গীত প্রতিভার প্রভাস্বর তিনি। সুর রচনাতেও তিনি যেমন দক্ষ, সুরেলা উদাত্ত কণ্ঠে সে গানের রূপবিকাশ করতেও তিনি তেমনি সুনিপুণ। একটি গানে রাইচাঁদ বড়ালও সুন্দর সুর-সংযোজন করেছিলেন। রাইচাঁদবাবু কলকাতার সুকণ্ঠ গায়ক-গায়িকাদের নির্বাচিত করেছিলেন এই মহিষাসুরমর্দিনীর অনুষ্ঠানে।
আমরা তখন সকলে প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। কিন্তু তাও আমারা একমাস ধরে অনুশীলন করতাম। এখন এটা কল্পনাই করা যায় না। পঙ্কজদার গান শেখানোর ধরনই ছিল অন্যরকম। সকলকে এক স্কেলে সা রে গা মা ধরাতেন উনি। আমরা প্রত্যেকেই অকুণ্ঠ শ্রদ্ধার সঙ্গে সেটা করতাম। মনে হত যেন একটাই গলা সব করছে...আর সেই অনুষ্ঠান চিরস্থায়ী করে রাখার জন্যই হয়তো একসময় অনুষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছিল।
- সুমিত্রা সেন
দুদিন আগে থেকেই বেতারে প্রচারিত হচ্ছে এই অনুষ্ঠানটির কথা। ষষ্ঠীর দিন ভোরে উঠে শ্রোতারা অপেক্ষা করে আছে বেতারগ্রাহক যন্ত্রটি নিয়ে। নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠানের ঘোষণা হওয়া মাত্র শাঁখ বেজে উঠলো। সারা কলকাতা শহর মন্দ্রিত হয়ে উঠলো শঙ্খধ্বনিতে। পূজামন্দির হয়ে উঠলো সমগ্র কলকাতা শহর। যবে থেকে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে, তবে থেকেই দেখেছি একমাস আগে থেকে অনুশীলন চলত। ভোর চারটের সময় সরাসরি সম্প্রচার হত। তার আগের রাতে সকলে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তেন। রাত দুটো-আড়াইটে নাগাদ একটি ভ্যান আসতো। সব শিল্পীরা একসঙ্গে সেই ভ্যানে তিনটের মধ্যে স্টুডিওয় পৌঁছে যেতেন।
- অরুণলেখা মল্লিক(পঙ্কজ মল্লিকের মেয়ে)
( 2 )