ভূমেন্দ্র গুহ
আকাট কালা বেঠোফেন
ভয়াবহ সব জিনিস ঘ'টে যেতে থাকবে
আমাদের সর্বাঙ্গ ঘিরে, চার-দিক ঘিরে, তা হলেও
পরস্পরকে আমরা জড়িয়ে ধ'রে থাকব শক্ত ক'রে
সে-সব জিনিস এড়িয়ে যেতে চেয়ে, তা হলেও
অন্য কোথাও অণু-পরমাণু বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে ব'লে
নক্ষত্রেরা দুমদাম দূরে কোথাও ফেটে যাচ্ছে ব'লে
আমাদের নিশ্চিন্ত থাকতে আটকাচ্ছে না, কোনও
ফলাফল আমাদের জানতে হয় না, বাস্তবিকই তারা
ঘটছে কী না, ঘটলে কী ভাবে-যে ঘটছে, জানি না
ব'লেই বাস্তবিক নির্ভেজাল এবং কালা হয়ে থাকি
আকাট কালা বেঠোফেন যা শুনেছিলেন, শুনি না





দেবারতি মিত্র
লুকোনো জানলা
ঐ সাদা বাড়িটার জানলার কাচ রোদ পড়ে
অশ্রুর মতন অল্প চকচক করছে বিকেলে।
আমার দুঃখ আমি বলি না কারোকে,
আমার সুখও আমি বলি না কারোকে।

ছেলেবেলাকার ঢিমে উনুনে বসানো দুধ ঘন হচ্ছে
এমন আলগা রঙ মেঘেদের।
না, অত বাস্তব নয়,
ফেলে আসা স্বপ্ন, হাসি, দীর্ঘশ্বাস, ভয়।

তোমারও কি কথা নেই, আপনার নেই?
ঐ যে মহিলা চুপিসাড়ে চলে গেল রাস্তার দিকে,
ও কাকে দেখতে চায়, কার মুখে খোঁজে
কিশোরবেলার সেই লজ্জা, ব্রণ, বিদ্রোহের দাগ-
আজ হাস্যকর তবু তীব্র গোপনীয়।

আর বৃদ্ধ ভদ্রলোক ছাদে উঠে যেন
কয়েকটি ফুলগাছ ঠিকঠাক করে,
এটা একবার দেখে, ওটাকে সরায়।
হাতড়ায় মণিরত্ন,
কী যে এত ঢাকে, একমাত্র সন্তানের দোষ
কিংবা নিজের সন্তাপ।

আমার দুঃখ আমি বলব না,
আমার সুখও আমি বলব না।
আপনি কি বলেন, তুমি বল?


অমিতাভ গুপ্ত প্রাককথন
শুরু হল নিঃশঙ্কের
জীবনে জীবনে চর্যা
শুরু হল মহাসমাপন


প্রসারিত ওই দু'টি হাতেই
যেন অনাগত আশ্রয়
পাওয়া না-পাওয়ার প্রশ্নের


বীজ, উৎসার, বীজাংকুর
সবই আজ ওই দুটি হাতে
ঝরেছে কীর্ণ দীর্ণ


আজ মনে হয়, অলংকার
স্বনির্বাচিত বাক্যের
হৃদয়ে রাখব, অঙ্গে নয়


তাহলে যদি-বা মুক্ত
হাইবিসকাস গোত্রের
জবা জ্বলে ওঠে রক্তে


তাহলে যদি-বা উদ্ভাস
ফিরে আসে বোবা স্বদেশে
ভাষার তীর্থ শুরু হয়




গৌতম বসু
জন্মাষ্টমী
কিছু বাক্যালাপের গহ্বরে প'ড়ে গিয়ে মৌনতার দেখা পেলাম আমি পিপাসার্ত জেনেও তুমি যখন মারণাস্ত্র হাতে তুলে নিলে বোঝা গেল, চিত্ত, ধীরে কিন্তু সুনিশ্চিতভাবে শীতল হয়ে আসছে, ঘুমচোখে দেখতে পাচ্ছি ব্রজনারীদের, ঘুমচোখে, কুণ্ঠা, তোমায়, চিত্ত শীতল হয়ে আসছে।

অবাঞ্ছিত উদ্ভিদের মতো মনমাঝে যে-কথা লতিয়ে উঠেছিল
সে আজ মূক, হয়তো বা বধিরও, কোমলরূপে আপন ক্রোধে স্থির;
এবার ভাবো, এত উত্তাপ কোথা থেকে উঠে আসছে, আহা, বৈকাল,
নিশানায় কোনও ভুল ছিল না আমার, ব্রজনারীরা সরে দাঁড়ান,
আঁখি মেলুন, শব্দ, কিরণ।

ভাঙা শব্দ, ভগ্নস্বাস্থ্য কিরণ, তোমাদের ফিরে আসাও ধরা যাক,
কক্ষপটে ওদের নেমে আসাও সত্য, হয়তো অধিকতর সত্য;
আমার কবিতার পংক্তিদের ভিতর দিয়ে পথ কেটে, এঁকে-বেঁকে
অ্যাম্বুলেন্স ছুটছে, হা বেণু, সুদর্শনচক্রবত্‍ নীলবর্ণ আলো,
যা-যা হবার ছিল, তা হল।


tukro-kotha
সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়
একটি কবিতা
তিল তিল ক'রে ঘুম গ্রীষ্ম হয়ে ঝরে যায়
এইভাবে জ্ঞান জমে ওঠে মাথাটির
উন্মাদের মতো গ্রীষ্ম মাথার কুটির
শূন্য ক'রে তৃণশ্যাম চুলগুলি খায়
চণ্ডালের মতো তার দুটি হাত খালি
সেই রিক্ততার দিকে পূর্ণতাপ্রণালী
শিখে নিতে হবে আজ এ-রিক্ত মাথাকে

নগ্ন কেশহীন মাথা ক্রমে তীক্ষ্ণ হয়
একা ভিক্ষুণির প্রায় বিহার-প্রান্তিকে
নিরাপত্তাহীন ভাবে ছিল জনান্তিকে
আজ সে সঙ্ঘকে দেয় কেশের প্রণয়
সমস্ত ঝরেছে তার বোধির আড়ালে
মুগ্ধবোধিনীরা জাগে ছিন্নকেশ জাগে




কুমার চক্রবর্তী
কে বলে এসেছি
এসেছি তো, এসেছি কি?
দ্বিপ্রহরে রয়েছি আগুনে, এদিকে বেলা যে পড়ে যায়
যায় নাকি? সরে যায় তোমার ছায়াও,
মেঘ যায় স্পর্শাতীত ঘাটে,
ছিলে চিহ্ন, চিহ্নিত হয়েছো আজ,
অস্পষ্টতা অর্থময় হয়, হতে হতে অন্তর্ধান
আমিও চেয়েছি যেতে, একা,
যে পথে পিঁপড়েরাও আজ পাতালরেখায়,
গ্রীবার কাছেই আছে মৃত্যুর অদ্ভুত ভাষ্য
গূঢ় সব কায়দাকানুন, অট্টহাস্য,
বলে কিনা
নাস্তানাবুদ হও মুখর অস্তিত্বহীনে
হাঁসকল পড়ে আছে জীবনের ঋণে,
সব কিছু কদাচিত্‍, পরবর্তী বলে কিছু নেই,
ভেতরে ফলেছে আজ নৈঃশব্দ্যের ঘাস, তাতে শুয়ে
একবার হেসেছিলে তুমি, তাতেই চেয়ারগুলো পড়ে গেছে
শ্রবণবধির হয়ে গিয়েছিল ইঁদুরেরা হেমন্তর মাঠে
এসেছি তো, এসেছি কি! কে বলে এসেছি?
আসা বলে কিছু নেই, সব স্মৃতি
জীবনের দিক থেকে, বিরতিতে বিরতিতে, অদ্ভুত ছায়ায়,
সংকেতের বিপরীতে, হাওয়ায় হাওয়ায়




যশোধরা রায়চৌধুরী যে গানটি লেখা হয়নি এখনো
নিজেকে অসংলগ্ন করে নিলে, নিজেকে ইরেসপন্সিবল করে নিলে তুমি

নড়ন্ত দাঁতের মত তুমি এক লুজ কানেকশনে

পিছলে গেলে, সটকে গেলে, ইলেকট্রিক শক খেতে খেতে

তুমিও কালোর কালো, ঝাঁঝরা, পোড়া, তবু

ক্রমাগত সরে গেলে, ঝুলে গেলে ফসকে গেলে নিচে

নিজেকে অসংলগ্ন করে নিলে, আত্মহীন পরহীন স্বার্থহীন ক্রান্তিহীন প্রাণ

নিজেকে অসংলগ্ন করে নিলে, কামচোর, ফেরেব্বাজ, ফাঁকিবাজ পিপুফিসুপ্রাণ

নিজেকে সতর্কতা, বাজিধরা থেকে

নিজেকে খেলায় নামা, প্রতিযোগিতার হিস্যা থেকে

ক্রমশ সরিয়ে নিলে, দায়িত্বহীনতামাত্রে অপরাধী, ডেলিংকুয়েন্ট...

তুমি এক অসতর্ক, গেরোবাজ, ঝামসর্বস্ব, ঠ্যাঁটা, গান...

সুমন গুণ শোক মানুষ ছড়িয়ে পড়ে, চেনা ঘর চেনা পাড়া চেনা সন্ধেবেলা
ফেলে রেখে যে যার তাগিদে ছুটে যায়

কেন যায়? কেন ছোটো ছোটো সাধ্য ও আহ্লাদ
সুরক্ষিত থাকে না, আমরা কেন আরও অভিসন্ধিময়
সিঁড়ির আহ্বান নিতে সারাক্ষণ ওঁত পেতে থাকি?

হঠাত্‍ কখনো থেমে পেছনে তাকালে
দেখা যায় বাড়ির সামনের চেনা গলি, চেনা পাশের বাড়ির
বারন্দায় লাল চটি, চেনা দোতলার
জানলায় খয়েরি পর্দা অসম্পূর্ণ হাওয়ায় দুলছে

পল্লব ভট্টাচার্য
বিপদচিহ্ন
আমাদের বাবা'রা আমাদের ছেড়ে যাওয়ার আগে একটি বিপদচিহ্ন রেখে গেছেন।
আমরা দেখি, সেই লাল থেকে ফোঁটা ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে রক্ত।
তবুও, এই রক্তমায়ার দিকে উড়ে যায় যে জীবন, তার
পুড়ে যাওয়া পাখায় রচিত হয় আমাদের ঘর। স্নানের পর,
দরজায় স্বস্তিক চিহ্ন আঁকতে গিয়ে, হাত বেঁকে যায়। দেখি,
লাল একটা বিপদচিহ্ন থেকে গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত, ওরা দেখবে বলে।

আমাদের ছেলেরা দেখছে, ছেড়ে যাওয়ার আগে বাবা'রা একটি বিপদচিহ্ন...

অভিমন্যু মাহাত হাঁড়িয়া দুঃখ উজাগর, আমায় হাত ধরো
রোদ জ্বলছে, বুক পেতে ডাকো

এলোমোলো অপেক্ষা নয়, না পসন্দ।
আগল ঠেলে আপন করলে
দিতে পারি সময় অপরিমাপ।
ছায়ার ঘুম পায়, আমি স্বভাবের পথের পাশে থাকি...

ফুঁ দিলে টলোমলো হয় স্বাদ, হাট ভাঙে
সেগুন পাতায় গোধূলি ঠোঁট রাখে আশ্লেষে...
মাঝি মেঝান আমার আশ্রয়

এসো, নগর
আমি তোমার দুঃখজাগানিয়া হব না,
লু, তাপ প্রবাহের কাঁপন দেবো না
তোমার জীবনের বিপরীতমুখী বহতা দেবো...


তানিয়া চক্রবর্তী
পিতা কিম্বা প্রেমিক
সারা ঘরে অর্জন করেছি ফড়িং-এর ডানা
খাটের পাশে দানবীয় সূর্যশিশির
কাকবন্ধ্যা-একটিমাত্র দুধে শিশু
উষালগ্নে মা বলতে গিয়ে সে থেমে গেছে
আমার সারা ঘরে তার পিতৃজনুর ক্রম
ধারাবাহিকের পিঠে আহুতি দিই নাড়ীর
জিভে কেবলই তিক্ত কোরক
কাগজের জ্বলনবিন্দু আর মিথ্যে শব্দে
ভরে গেছে নিবিড় জংঘা
সারা ঘরে তুলসীমঞ্চের অক্ষত মাটি খুঁজি
যতটা সময় ছোঁয়া যায় না
ততক্ষণ শীধু মাখাই হাতে
শুধু ঝড়ই শরীর----শরীরই বৃষ্টি
ঝড়ের আদরে উড়ে আসে টিন
টিনকে বলি গলা কাট---গলা কাট
এ গলাকে কেউ মসৃণ সিঁড়ি বলেছিল
পরে বলেছে ওটা বলির মাংস
গলা কেটে একটা শিশু দে
ও টিন, একটা অনিবার্য শিশু দে
যাকে পিতা কিম্বা প্রেমিক বলতে পারি...

দেবায়ুধ চট্টোপাধ্যায়
প্রতিমুহূর্তে প্রতিবার
প্রতি মুহূর্তে প্রেমে পড়বো, প্রতিটি জ্যোৎস্নায় আমি
জীবনে প্রথমবার চাঁদ দেখে ভেসে যাবো
প্রতিটি নদীর তীরে প্রত্যেকবার এসে ইচ্ছে করবে ঝাঁপ মারতে
প্রতিটি সমুদ্রের সামনে প্রতিবার আমি
হাঁটু গেড়ে বসে থাকবো, ফিরে আসবো জল না ছুঁয়েই
প্রতিটি জলের গন্ধে সন্ধ্যা হয়ে ডুবে মরবো
প্রতিটি তমাল চোখে খুঁজে যাবো রাধিকার ছায়া
এর বেশী কি করতে পারি, কিই বা করার আছে বলো
যখন ক্লিশের মতো তুমি বারবার এসে আর বারবার চলে গিয়ে
নব নব রূপে ফের আসো

ফেরাতে শিখিনি আমি, বলেছি আবার ভালোবাসো...।।





Table of Contents