বিভাস চক্রবর্তী
বিসর্জনের মাতন লেগে আর, দুলবে না গো সুরমা নদীর জল
বাল্যকালে আমি ছিলাম সিলেটে।সিলেটে না কাটিয়ে পুজোটা আমার মামারবাড়ি শিলংয়ে কাটাতাম। শিলংয়ের স্মৃতি মনে পড়ছে। আমাদের জেলরোড পাড়াতেও পুজো। মনে আছে প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়েছিল। ওই পুজোটা বাইরে বেরিয়ে উপভোগ করতে পারিনি। লেপের তলায় ঢুকে সারাদিন কাটিয়েছিলাম।
সিলেটে, যেখানে প্রায় ১১ বছর বয়স অবধি ছিলাম আমি, সেখানে বাড়িতে কোনও পুজো হত না। তবে সিলেট টাউনে অনেক পুজোই হত। অনেকের বাড়িতে হত, কিছু পুজো ছিল পাড়ায়। কিন্তু কলকাতায় আসার পর পুজোর যে ব্যাপ্তিটা দেখেছি, যেরকম জাঁকজমক দেখেছি, সেইরকমটা হত না সিলেটে। বরং, পৌষপার্বণের আড়ম্বরে সিলেট অনেক এগিয়ে।
বাবা ছিলেন সাংবাদিক, একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তখন আমাদের অবস্থাটা স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত বলা চলে। সেই জন্যই দারুণ দামি জামাকাপড় কেনা হত না। মধ্যবিত্তদের বাড়িতে যেমন সাধারণ জামাকাপড় কেনা হত, আমাদের বাড়িতেও পুজোয় তেমন জামাকাপড়ই আসত। তবে একবার পুজোয় সিল্কের জামা পরেছিলাম, সেইজন্য ওই বছরটা স্মরণীয় হয়ে আছে।
পুজোর সময়ে সিলেটে নাটক হত। একটাই নাটক দু-তিন দিন ধরে চলত। সে নাটকের আয়োজন বিরাট। কলকাতার মঞ্চসফল নাটকগুলোই। যেমন কারাগার, উত্তরা এই নাটকগুলোই হত। শহরের বাবুরা অনেকদিন ধরে রিহার্সাল করে নাটক নামাত। আমাদের বাড়ির খুব সামনেই একটা বড় মাঠে হত সেগুলো। তখন কলকাতা থেকে মঞ্চের বিভিন্ন জিনিস, সেট সেটিংয়ের জিনিস আসত। এমনকী, সখির দলও আসত কলকাতা থেকে। প্রত্যেক বছরই ওই নাটকগুলো দেখার পর বহুদিন আমার হ্যাংওভার থাকত। ওইসব নাটকে অভিনেতাদের যেমন পোশাক পরতে দেখেছি, মায়ের শাড়ি, ব্লাউজ দিয়ে ওরকম পোশাক তৈরি করা বা বাড়িতে পর্দা খাটিয়ে চৌকির ওপর একটু অভিনয় করা, এমনকী অস্ত্রশস্ত্র-গয়নাগাটি গুলো পিচবোর্ড, আঠা দিয়ে নিজের মতো বানিয়ে আমার প্র্যাকটিস চলত। আসলে পুজোর ওইসব নাটক আমায় খুব টানত। যারা অভিনয় করতেন তারা অসাধারণ অভিনেতা ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন হেম রায়, টনিক দা, নিতাই চন্দ, ডাকসাইটে অভিনেতা তারা। পরে যখন কলকাতায় এসে নামকরা অভিনেতাদের দেখেছি, প্রায় তাদের কাছাকাছি মানের অভিনেতা ছিলেন সিলেট শহরের অভিনেতারা।
এরপর দেশভাগ তো হয়েই গেল। আমরা ছোট হলেও ধরেই নিয়েছিলাম দেশ আমাদের ছাড়তে হবেই। পুজোর সেই আনন্দ আগের মত থাকবে কি না সেই নিয়েও সন্দেহ ছিল। বাবা ওই সময় একটা কবিতা লিখলেন। সেই কবিতার একটা লাইন এরকম-"বিসর্জনের মাতন লেগে আর, দুলবে না গো সুরমা নদীর জল।" সুরমা হল আমাদের সিলেট শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া একটা নদীর নাম। এটাকে সুরমা উপত্যকাই বলে। ওই সুরমা নদীতে ঠাকুর ভাসান হত, সেটা তো আর হবে না, আমরা তো আর সেটা দেখতে পাব না। সেই দুঃখ, আক্ষেপটা বাবার কবিতায় বেরিয়ে এসেছিল। এ বয়েসে এসেও কবিতার লাইনগুলো ভুলিনি। কারণ, ওগুলো ভোলার নয়।
( 1 )
দেশভাগের পর চলে এলাম রানাঘাটের পাশে একটা গ্রামে। নাম আনুলিয়া। সে গ্রামে ছিল আমার কাকার শ্বশুরবাড়ি। কেউ থাকত না সেই বাড়িতে। সিলেট শহরে আমাদের জীবনটা যেমন ছিল এখানে এসে বদলে গেল। সেখানে বাধানো চণ্ডীমণ্ডপ ছিল, ওপরে ছাদ ছিল, নিচে বসার জায়গা ছিল। বেদিতে ঠাকুর তৈরি হচ্ছে, সুতরাং সব মিলিয়ে গ্রামের মধ্যে বিরাট একটা সাড়া পড়ে যেত। এখানেই প্রথম অনুভব করলাম পুজো কিন্তু দারুণ একটা বড় আলাদা উত্সব। গ্রামের বিজয়দশমী দেখেছি। ছোটছেলে থেকে বুড়ো সবাই সবার সঙ্গে বিজয়ার সম্ভাষণ করছে। অনেকে বাড়িতে যাচ্ছেন, বাড়িতে কোলাকুলি হচ্ছে। পুজোমণ্ডপেও চলত কোলাকুলির পালা। আর আমরা ছোটরা দলবেঁধে একটা কাপড় নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিমকি, দরবেশ, গুজিয়া, মিষ্টি সংগ্রহ করতাম। এভাবে আমরা সারা গ্রাম ঘুরে বেড়াতাম। এটার মজাই আলাদা। ভাসানের পর এই মণ্ডপেই মঞ্চ তৈরি হত। ওখানেই হত নাটক। সেই নাটক দেখার অভিজ্ঞতাই আলাদা। চন্দ্রগুপ্ত নাটককে গ্রামের সরল মানুষরা এমন ব্যাখা করত যা দিয়ে অনায়াসে আরও একটা হাসির নাটক মঞ্চস্থ করে ফেলা যেত।
রানাঘাটে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ে, চলে এলাম কলকাতায়। আমরা এলাম শ্যামবাজারের একটা পাড়ায়। অর্থাত্ কি না একটা কাঠ বাঙাল গিয়ে পড়ল একেবারে কাঠ ঘটিদের মধ্যে। শ্যামবাজারের ওই পাড়াটায় পুজো হত না, তবে আশপাশে পুজো হত। ওখানে হিন্দু সঙ্ঘ নামে একটা ক্লাব ছিল, সেই ক্লাবে বিশাল বড় করে তিনদিন ব্যাপি একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত। সেই অনুষ্ঠানে একদিন বিরাট করে একটা জলসা হত। সেই জলসায় আসতেন শচীনদেব বর্মন, শ্যামল মিত্র, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্য থেকে শুরু করে প্রত্যেককে আসতে দেখেছি, কে না আসতেন সেটাই মনে করতে পারছি না। এই যে আমি ডানহাতে ঘড়ি পরি সেটা ছোটবেলাই ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্যের থেকে দেখে শেখা। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্য হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন আর ওনার ডান হাতে ঘড়ি। তখন থেকেই আমার ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্যের প্রতি দারুণ আকর্ষণ। ঠিক করেছিলাম কোনওদিন যদি ঘড়ি পরি তাহলে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের মত ডানহাতেই পরব। এই রকম সব ছেলেমানুষী ছিল।
সেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে জলসার পাশাপাশি নাটকও হত। কলকাতায় আমার প্রথম থিয়েটারে হাতেখড়ি এই হিন্দু সঙ্ঘের ক্লাবে শ্যামবাজারের পাড়ায়। সেখানে কালু দা (রমেশ চট্টোপাধ্যায়) নামে একজন ছিলেন। তিনি মুলত অফিসক্লাবের নাটক পরিচালনা করতেন। কিন্তু কী অসাধারণ পরিচালক ছিলেন, সেটা বলে বোঝানো কঠিন। কৈশোরেই এই কালুদার কাছে অভিনয়ের তালিম পেয়েছি।
আগে কলকাতায় যে পুজোগুলো দেখতাম সেটা সর্ব অর্থেই সর্বজনীন। স্থানীয় মানুষরা তাতে অংশগ্রহণ করতেন, আড্ডা মারতেন, আলোচনা হত, গল্পগুজব হত। কিন্তু পুজোটা কেমন যেন একটা দ্রষ্টব্য, মানে একজিবিশন গোছের কিছু একটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবাই লাইন দিয়ে সেই একজিবিশনে ঢুকছে, আর আওয়াজ হচ্ছে দেখে আস্তে আস্তে বেরিয়ে যান। সত্যি যেন একটা একজিবিশন। ( 2 )