খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের কাছে বড়দিনের ইভ্ মানেই লাল মখমলের স্যুট আর টুপি পরা সান্তা ক্লজ। পেছনে তার ঝোলাভর্তি উপহার। হাসিমুখে শিশুদের উপহার বিলিয়ে যাচ্ছেন তিনি। অন্তত এমন চিত্রই আমরা দেখে আসছি বছরের পর বছর ধরে।
চেনা রূপের বাইরেও সান্তা ক্লজকে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। সান্তা ক্লজকে নিয়ে নির্মিত বিখ্যাত সিনেমা 'দ্য সান্তা ক্লজ' এর অভিনেতা টিম অ্যালেনের পোশাক বা 'মিনস গার্লস' সিনেমায় মিনি স্কার্টের সান্তাকেও আমরা দেখতে পেয়েছি।
সান্তার ঐতিহ্যবাহী রূপ আজকের সমাজের কল্পনা ও সংস্কৃতিতে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে।
সান্তা ক্লজের পোশাক সব জায়গায় এক রকম রাখা হয়, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের শপিংমলগুলোর সান্তাদের পোশাক সবসময়ই অপরিবর্তিত। সান্তা কোনও বাস্তব চরিত্র না হলেও, তার পোশাকের বৈশিষ্টগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
একবার নিউ ইয়র্কের ব্লুমিংডেলস শপিংমলে সান্তা সবুজ পোশাক পরেন। একটি বিশেষধরণের প্রচারের অংশ হিসেবেই সেটি করা হয়েছিল। কিন্তু ওই ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়া থেকে শুরু করে জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। তখন একজন মন্তব্য করেছিলেন যে সব কিছু বদলানোর কোনো প্রয়োজন নেই। সবুজ সান্তা বোকামি। এটা অনেকেই মেনে নিতে পারেনি।
মুরের কবিতায় সান্তাকে দেখানো হয়েছে চালাক ও বেঁটে এক মানুষকে। তিনি সহজেই চিমনির ভেতর প্রবেশ করতে পারেন। ১৮৬৪ সালের একটি চিত্রে সেন্ট নিকোলাসকে হলুদ পোশাক ও পশমের টুপি পরানো হয়েছিল। এমন পোশাক সাধারণত বিশপরা পরেন। ১৮৩৭ সালের একটি চিত্রে তাকে পশম দিয়ে সাজানো একটি লাল টুপি পরতে দেখা যায়। ১৮৫০ সালের পি টি বারনামের বিজ্ঞাপনে তাকে দাঁড়িবিহীন বিপ্লবী হিসেবে দেখানো হয়।
আর ১৯০২ সালের এল. ফ্রাঙ্ক বাউমের 'দ্য লাইফ অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার অব সান্তা ক্লজ' বইয়ের প্রচ্ছদে তাকে কালো পোশাক, পশমের টুপি ও লাল বুট পরিহিত উপস্থাপন করা হয়।
হার্পারস উইকলি পত্রিকা কার্টুনিস্ট থমাস ন্যাস্ট সান্তা ক্লজের চেহারা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৮৬৩ সালে আমেরিকান গৃহযুদ্ধের সময় তিনি প্রথম সান্তাকে আঁকেন। সেখানে দেখা যায় সান্তা স্টার্স অ্যান্ড স্ট্রাইপস পরেছিলেন এবং ইউনিয়ন সেনাদের উপহার দিচ্ছিলেন।
সান্তার সবচেয়ে প্রভাবশালী চিত্রকর্মটি ১৮৮১ সালের। সেখানে সান্তাকে একটি লাল স্যুট পরিহিত দেখানো হয়, অনেকটা আজকালের মতো। পরে শিল্পী নরম্যান রকওয়েল ওি জে.সি. লেইন্ডেকার বিংশ শতকের প্রারম্ভে 'দ্য সাটারডে ইভনিং পোস্ট' সান্তাকে তার ঐতিহ্যবাহী স্যুটে আঁকেন।
১৯৩১ সালে কোকা-কোলা তাদের ছুটির প্রচারের জন্য হ্যাডন সান্ডব্লমের আঁকা সান্তার চিত্র ব্যবহার করতে শুরু করে। এতে সান্তার গাল ছিল গোলাপি ও শরীর স্থূল। এটি মূলত হ্যাডন তার এক বন্ধুকে কল্পনা করে এঁকেছিলেন। এই চিত্রটি তখন খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং এখনো পরিচিত।
বোলারের মতে তার মনে হয় অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করেন যে, কোকাকোলার সঙ্গে এক বিশেষ যোগ ছিলো সান্তার লাল ও সাদা পোশাক প্রতিষ্ঠার সঙ্গে। যদিও সান্তার এই ঐতিহ্যবাহী পোশাক অনেক আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। কোকাকোলা সান্তার পোশাক প্রচারের প্রথম সফট ড্রিংক ছিল না। বিশ্বযুদ্ধের সময়, প্রথম সান্তার পোশাক পরা চিত্রটি প্রচার করেছিল হোয়াইট রক বেভারেজেস। এটি ছিল কোকা-কোলার সান্ডব্লমেরও আগে।
আগে সান্তা ক্লজ সবসময় লাল পোশাক পোশাক পরতেন। তার বর্তমান চেহারা, পোশাক ও উচ্চতা গড়ে উঠতে প্রায় এক শতাব্দীরও বেশি সময় লেগে গিয়েছে। তার পূর্বসূরিদের মধ্যে ছিলেন খ্রিস্টীয় বিশপ সেন্ট নিকোলাস, ডাচদের সিন্টারক্লাস, ফ্রান্সের পেরে নোয়েল এবং জার্মানির উপহার দেওয়া শিশু যিশু, ক্রিস্টকিন্ডল।
ক্রিস্টকিন্ডল থেকে আমেরিকায় ভুল উচ্চারণে 'ক্রিস ক্রিঙ্গল' নামে পরিচিতি পায়। তবে আমেরিকান সান্তার রূপ প্রথম গড়ে উঠতে শুরু করে ১৮২০ সালের দিকে। কবিতা, সিনেমা ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তার এই চেহারা ধীরে ধীরে জনপ্রিয় আকার ধারণ করে।
১৮২৩ সালে আমেরিকান কবি ক্লিমেন্ট ক্লার্ক মুর 'এ ভিজিট ফ্রম সেন্ট নিকোলাস' নামে একটি কবিতা লেখেন। সেখানে সান্তাকে একজন সাদা গোফদাঁড়ি, পশমের পোশাক পরিহিত একজন মানুষকে দেখানো হয়। তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মেরু অঞ্চলের হরিণচালিত স্লেজ গাড়ি। মুরের এই বর্ণনাটাই প্রায় ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
অজ্ঞাত এক কবির কবিতায় 'সান্তেক্লজ' নামটি উল্লেখ করা হয়। অবশ্য এই কবিতায় তার পোশাকের বর্ণনা দেওয়া হয় ভিন্নরকম ভাবে।
'সান্তা ক্লজ : এ বায়োগ্রাফি' বইয়ের লেখক ইতিহাসবিদ জেরি বোলার বলেন যে ১৯ শতকের সান্তা ক্লজের চেহারা ও পোশাক নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক ছিলো। আমেরিকান শিল্পীদের সান্তার পোশাক নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে প্রায় ৮০ বছর লেগে গিয়েছিলো। তখনও পর্যন্ত সান্তাকে যেকোনো রঙের পোশাকে ও বিভিন্ন ধরনের পোশাকে উপস্থাপন করা হতো।