পার্থ প্রতিম চন্দ্র


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

 


মানুষের অদ্ভুত অদ্ভুত সব ভাল লাগা থাকে। আমারও এমন একটা আছে, বলা ভাল ছিল। আমার অদ্ভুত ভাল লাগা হল কাশির শব্দ শুনে সেটা নকল করা।


ছোটবেলায় ভাঙা দালানের কোণে বসে দাদু যখন কাশতো, আমি সেটা হুবহু নকল করতাম। দাদুর কাশিকে নকলটা এত ভাল হত, সবাই আমাকে বারবার সেটাই করতে বলত। বিয়েবাড়ি, উত্সব যেখানেই যাই সবাই আমায় টেনে এনে বলত, এই বাপ্পা ওই কাশির আওয়াজটা একবার শোনা না। ছোটবেলায় কাশি আমায় একেবারে 'ফেমাস' বানিয়ে দিল।


এরপর যখন ক্লাস ফাইভে নামজাদা এক স্কুলে ভর্তি হওয়ার ইন্টারভিউতে বসি তখন আমায় বাঁচিয়ে দেয় কাশিটাই। স্কুলের অ্যাডিমিশনে টেস্টে ইংরেজি পরীক্ষাটা ভাল দিতে পারিনি। তবু তিন চারদিন পর মৌখিক পরীক্ষায় ডাকা হয়েছিল। পাঁচজন বাঘা বাঘা স্যার-ম্যাডামদের সামনে একেবারে ইঁদুর হয়ে বসলাম মৌখিক পরীক্ষায়। প্রথম প্রশ্ন উড়ে আসার আগেই দিলাম জোরে একটা কাশি, তারপর আবার, তারপর আবার...সেখানেই বাজিমাত। স্যাররা আর প্রশ্ন করার সুযোগ পাননি। শরীর খারাপ বলা ভাল কাশির সৌজন্যে অ্যাডিমিশন টেস্টে উতরে গেলাম।  


ক্লাস এইটে আবার আমার জীবনে কাশি ফিরে এল। বাংলার তাপস স্যার বললেন, আজ একটা খেলা খেলব, যে এই খেলায় জিতবে তাকে অ্যানুয়াল পরীক্ষার আমি বাংলার পুরো প্রশ্নপত্র বলে দেব। ক্ষ্যাপাটে তাপস স্যার দিলেন একটা রচনা লিখতে হবে, বিষয় শীত, যে সবচেয়ে ভাল লিখবে সে পাবে পুরস্কার। আমি লিখলাম শীতের সাইডএফেক্ট নিয়ে... হেডিংয়ে দিলাম 'কাশিতে কাশিও না'। বাকিরা লিখল নিয়মমাফিক সব রচনা। 'কাশিতে কাশিও না' পরে একেবারে গদগদ তাপস স্যার আমায় পুরস্কার দিলেন। জীবনে ওই একবার লেটার মার্কস পেলাম।


কলেজে উঠে কাশির সংজ্ঞা বদলে দিলাম। নিঝুম বলে একটা মেয়ের প্রেমে পড়লাম। কিন্তু নিঝুম এত চুপচাপ থাকত যে ওকে কোনও কথাই বলতে পারতাম না। কলেজ শেষ হব হব করছে সাহস করে মনের কথাটা ওকে বলে বসলাম অনেকটা সিনেমার কায়দায়। ক্লাসে প্রফেসার ঢুকব ঢুকব করছে সেই সময় ওকে বললাম, জানি তুমি কথা খুব কম বল, তাই সঙ্কেতে তোমার জবাব চাই। যদি তুমি আমায় ভালবাসো, তাহলে ক্লাসের মাঝে তুমি একটু জোরে কাশবে, তাহলেই বুঝে যাব তুমি আমায় ভালবাসো, আর না কাশলে আমি আর তোমায় কোনওদিন মুখ দেখাবো না।


রাশভারী চেহারার অর্থনীতির অধ্যাপক ক্লাসে ঢুকলেন। ইউনিয়ন করা ছেলেগুলো পর্যন্ত রাগী অধ্যাপকের ক্লাসে একেবারে চুপচাপ হয়ে গেছে। আমি বসে নিঝুমের কাশির অপেক্ষায়। স্যার তখন পড়াচ্ছেন চাহিদার সঙ্গে জোগানের সম্পর্কের কথা। আর আমি ভাবছি প্রেমের সঙ্গে কাশির সম্পর্কের কথা। একটু বেঞ্চ সরানোর আওয়াজ হলেই আমার বুকটা ধক করে উঠছে। এই বোধহয় কাশির আওয়াজ হল বলে। ক্লাস চলছে, মাঝে মাঝে দু একটা আওয়াজও হচ্ছে। চক পড়ে যাওয়ার শব্দটাও একেবারে বুকে এসে গাঁথছে।  ক্লাস শেষ হতে চলল, কাশির আওয়াজ আসছে না, আমার বুকটা এবার কাঁপতে শুরু করল। বুঝতে পারলাম মেয়েটাকে বড্ড ভালবেসে ফেলেছি। এই ক মিনিটের মধ্যে কাশির আওয়াজ কানে না এলে আমি ভেঙে পড়ব। ক্লাস শেষের  ঘণ্টা বেজে গেল, আমার শরীরটা কেমন করতে লাগল, জ্বর এলো বোধহয়। সেই জ্বরের জন্য আর কলেজে যাওয়া হয়নি। শরীর খারাপ নিয়েই কোনও মতে ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষাটা দিলাম। রেজাল্টের দিনে কলেজে গিয়ে নিঝুমকে খুঁজলাম পেলাম না।


তা হোক, ততদিনে আমার বিশ্বাস এসে গেছে কাশিটা আমার কাছে খুব 'লাকি সাইন'। প্রতি শীতেই একবার না একবার কাশি হয় আমার। তখন বেশ লাগে। কফ সিরাপগুলো খেতেও বেশ ভাল। মিথ্যা বলব না কাশি আমার কাছে পয়া বলে মাঝে মাঝে জোর করে ওকে ডেকেও আনি। বিশ্বাসটা আরও দৃঢ় হল গত বছর শীতে। বলা নেই কওয়া নেই একটা পত্রিকায় গল্প লেখার জন্য বেশ ভাল টাকার অফার পেলাম, গলায় তখন আমার কফ, মাঝে মাঝেই তখন আমি খকখক শব্দে কাশি।



ও ঘর থেকে কাশির শব্দটা শুনে এখন কানে হাত দিই। অসহ্য লাগে শব্দটা। যেখানেই যাই যেন ওটা তাড়া করে বেরোয়। সেদিনে এক বন্ধুর বাড়ি পার্টিতে রাতে খুব জোরে গান বাজাচ্ছে, আমি তখন ঘোর মাতাল, হঠাত্‍ কোত্থ থেকে এসে পড়ল আওয়াজটা। গানের সুর ছাপিয়ে ধুকো কাশির আওয়াজ..আমি দুটো হাত দিয়ে ভাল করে কান দুটো বন্ধ করে দিলাম। ঠিক ফাঁক খুঁজে ঢুকে পড়ল বেয়ারা কাশির শব্দটা। আমি ছুটে বাইকে উঠে পড়ে পালালাম..আওয়াজটাও আমায় তাড়া করে ধরে ফেলল। বাইকের ঘঁ ঘঁ আওয়াজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাজছে কাশির শব্দটা।


অনেক টাকা দরকার এখন...বাবার কাশির সঙ্গে রক্ত বেরোচ্ছে। জানি না কী হবে...কাশির শব্দটা এখন আমায় ভেঙচি কাটে। দিনরাতে রাতবেরোতে উদয় হয়...কানে চাপা দিয়ে দিই তখন। এখন আবার ওই শব্দের সঙ্গে নতুন একটা যোগ হয়েছে। দাদুর শ্রাদ্ধের দিন মজা করে দাদুর কাশির ডাকটা অন্য ভঙ্গিমায় নকল করেছিলাম, সেই ডাকটা এখন শুনতে পাই। কাশি জিনিসটা ভয়ঙ্কর আমি আর ওকে ভালবাসি না, একদম না....