স্বরূপ দত্ত


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

খবর মানেই তো মানুষের মৃত্যু। এই হয়ে আসছে গত কয়েক বছর ধরে! হয় আত্মহত্যা না হলে দুর্ঘটনা কিংবা খুন অথবা জঙ্গি হামলার শিকার। কারণ, যেটাই হোক, গল্প সেই এক। মানুষের মৃত্যু। ভালো লাগে না। আরও খারাপ লাগার কারণটা অন্য। আমাদের মধ্যে এ কী পরিমাণ অসহিষ্ণুতা এসে গিয়েছে! মৃত মানুষটাকেও একটু করুণা করতে পারি না আমরা! সে চরিত্রহীন, সে মাতাল, সে নোংরা স্বভাবের, সে বড়লোক ঘরের, সে চোর, সে আরও কত কত কত কত কী..! ভাবি আর কষ্ট হয়। কারও মৃত্যু কীভাবে অন্য মানুষের আনন্দের হয়! কীভাবে কেউ বলতে পারেন, 'বেশ হয়েছে/হওয়ারই ছিল/ঠিকই আছে/অমন মানুষের বেঁচে থাকার দরকার কী!' চারপাশের পৃথিবীটায় এগুলো দেখতে দেখতে মনটায় বড় কষ্ট হয়। মনে হয়, আসেপাশের মানুষগুলো, মানুষই তো? তাহলে এরা কেন মানসিকভাবে এত হিংস্র!


ভয় লাগে। আর এই ভয়ের ওষুধ নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে। তাই রোজ ভালো খবর খুঁজি। যা আমি চোখের সামনে পাই, তাতে বেশিটাই খারাপ। তাই নিজের জন্য ভালো খবর খুঁজি। মানুষ বাঁচার খবর খুঁজি। নিজের বেঁচে থাকার মানে খুঁজি। বাকি পৃথিবীর হিংস্র মানসিকতার মধ্যে কুঁকড়ে এক কোণে বসে থাকি। রোজ খুনিদের নাম জানতে জানতে 'ঈশ্বর'রের (সব ধর্মের) কাছে প্রার্থনা করি।


জানি, এই পৃথিবীতে তবু আমাদের চোখের সামনে কিংবা দূরে এখনও অনেক মানুষ রয়েছেন, যাঁরা আজও মানুষ। তাঁরা খারাপ মানুষের মরে যাওয়াতে ততটাই কষ্ট পান, যতটা কষ্ট পান, একজন ভালো মানুষের মৃত্যুতে। কে বোঝাবে সবাইকে, 'প্রাণ' শুধুই ভালো। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম তাঁকে। মানুষ বলব নাকি ঈশ্বর! জানি না। একটা প্রণাম করলাম অনেক দূরে থেকেও। মানুষটার নাম করে, ছবি ছুঁয়ে। কেন? বলছি ছোট করে -


চিনের নানজি প্রদেশ। ছবির মতো শহর। আধুনিক চিনের যাবতীয় উপকরণ রয়েছে সেখানে। ঝা চকচকে বড় বড় বাড়ি। বিরাট বড় ব্রিজ। হাজার হাজার মানুষ। অনেক কাজ। অনেক উন্নয়ন। অনেক আধুনিকতার ছোঁয়া। কিন্তু শরীর খারাপ হয়েছে নানজিং শহরেরও। তাই তো শহরের অনেক মানুষেরই মন খারাপ হয়। আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না কারও কারও। তখন তাঁরা চলে যায়/চলে যান নানজিং ইয়াংতে নদীর ব্রিজের উপর। শুধু নানজিংয়ের নয়, গোটা চিনের অন্যতম কুখ্যাত ব্রিজ এটি। কারণ, বছরের পর বছর ধরে হাজার-হাজার মানুষ এই ব্রিজ থেকে জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করছেন। আজও করে চলেছেন।


এই শহরেরই বাসিন্দা চেন সি। মাঝবয়সী ভদ্রলোক। ২০০৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর থেকে প্রতি শনিবার-রবিবার চলে আসেন নানজিংয়ের ওই ব্রিজে। কখনও সময় পেলে সপ্তাহের অন্যদিনেও। সেই থেকে আজকের ২০১৬, চেন সি ৩০০ জনেরও বেশি আত্মহত্যা করতে আসা মানুষকে বাঁচিয়েছেন! না, তিনি ডাক্তার নন। যে মানুষগুলো আত্মহত্যা করতে ওই ব্রিজ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল, তারা তো মরতোই। এটাই অবধারিত। তেমন ৩০০ জন মানুষ আজও পৃথিবীটায় বেঁচে আছেন! ওই চেন সি-র জন্য! কী বলবেন তাঁকে? মানুষ নাকি ঈশ্বর? আত্মহত্যা করতে ওই ব্রিজ পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া ওই ৩০০ মানুষ পৃথিবী থেকে কমে গেলে, কার কী কষ্ট হত? এই পৃথিবীতে রোজ এমন আত্মহত্যায় কয়েক হাজার মানুষ মারা যায়। আর আজ আমাদের যা অবনতি তাতে, আত্মহত্যা করে কেউ মরলে, সে কী খারাপ, কী খারাপ! লোকে বলে, 'শালা বেশ হয়েছে। লোকটার ধার ছিল। লোতটা চোর ছিল। লোকটার চরিত্র খারাপ ছিল। আরও কত কত কী....'। এই হিংস্র লোকদের মাঝে বেঁচে আছেন চেন সি। না, তাঁর কাছে প্রাণটার দামই আজও বেশি। প্রাণটা যার বুকের মাঝে রয়েছে, তার চরিত্র নিয়ে কোনও মাথা ব্যাথা নেই তাঁর। ভাগ্যিস।


কী করেন চেন সি? গিয়ে বসে থাকেন ব্রিজের এক পাশে। কারও মতিগতি সন্দেহজনক ঠেকলেই অমনি পৌঁছে যান তাঁর কাছে। তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেন দূর থেকেই যে, কেন করছো আত্মহত্যা? এভাবেই ভরসা দিতে থাকেন ক্রমাগত। তারপর প্রায় মরে যাওয়া মানুষটাকে বাঁচিয়ে নতুন জীবন দান করেন! এই তো সেদিন একজন আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিল ১৫০০০ টাকা দেনা শোধ করতে না পেরে! চেন সি, সেই পাওনাদারের সঙ্গে নিজে কথা বলেন। আর মানুষটাকে প্রাণে বাঁচান। এই বছরই চেন সি-কে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র বানানো হয়েছে। অ্যাঞ্জেল অফ নানজিং। ঠিকই তো। ঈশ্বর বলতে হবে না, কিন্তু দেবদূত তো তাঁকে বলতেই পারেন। পুরোটা ইউটিউবে পরে সময় করে দেখে নেবেন। আপাতত ট্রেলরটা দেখতে পারেন। মাত্র দু মিনিটের ভিডিও বলে লিঙ্কটা দিয়ে দিলাম। এটা তো দেখবেনই। দেখার পর ভাবার চেষ্টা করবেন, চেন সি যদি মানুষ হন, তাহলে আমি, আপনি কী! আপনাকে কোনও দুঃখ দিয়ে থাকলে আমায় ক্ষমা করবেন প্লিজ। আর সবশেষে, চেন সি-কে একটা প্রণাম করবেন। ডাক্তার ছাড়া কোনও মানুষ ৩০০ জনের থেকেও বেশি মানুষের জীবন দিয়েছেন! টেনে এনেছেন মৃত্যু আর জীবনের সেঁতুর মাঝখান থেকে! ইস্, আফশোস হচ্ছে, কেন হতে পারি না আমি চেন সি! আর একটা কথা, আজকের দিনের বড় চেনা লাইন, 'চায়না মাল ছুঁড়ে ফেলে দাও!' ওটার প্রতিবাদটাই বোধহয় করেছেন চেন সি।