স্বরূপ দত্ত


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

আমাদের রাজ্যে এবারের বিধানসভা নির্বাচন শুরু হয়েছিল সেই ৪ এপ্রিল থেকে। শেষ হল এক মাস পেরিয়ে ৫ মে-তে এসে। মনে হয়েছিল বাঁচা গেল! ধুর ধুর, একেবারে সাধারণ মানুষ। রাজনীতির কচকচানি ছেলেবেলা থেকে আজ পর্যন্ত চারপাশের সব শুনে নিয়েছি। আমি যে অঙ্ক পরীক্ষা দিয়ে বেশি বেশি নম্বর পেয়ে পাশ করতাম, সেই অঙ্কের সঙ্গে রাজনীতির অঙ্কের কোনও মিল পাইনি, পাই না। একটা উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলতে পারব - একটা দল ২ কোটি ৪৫ লক্ষ ভোট পেয়ে ২১১ আসন পেয়ে 'সাপের পাঁচ পা' দেখে সরকারে! আর একটা দল ২ কোটি ১৫ লক্ষ ভোট পেয়ে গো হারা হয়ে 'প্রায় কবরে'! কেন এমন? এমন নয় যে, এই সমীকরণ এবারই। প্রতি নির্বাচনের পরই তো এমনই। যখন যারা জেতে, তারা অর্ধেকেরও কম মানুষের পছন্দের! অথচ, তাঁরা পরবর্তী ৫ বছর সগর্বে বলে যান, 'মানুষ আমাদের সঙ্গে'! তখন ভাবার চেষ্টা করি, বাকি অর্ধেকেরও বেশি মানুষ তাহলে 'অমানুষ'!


আজ অবশ্য প্রথমবার অনুভব করলাম, ভোটটা শেষ না হলেই ভালো হত। ভোট শেষ ৫ মে-তে। ফল প্রকাশ ১৯ মে। কেন শেষ হয়ে গেল? দিব্যি তো চলছিল। গণতন্ত্রের উত্সব কখনও অনুভব করিনি, লোকের হাজার বলাতেও। কিন্তু, আজ মনে হল, গণতন্ত্রের উত্সবের বিজয়া দশমীটা না হলেই ভালো হত। কেন বলছি এমন? উত্তর -


প্রতিদিনের মতো আজ সকালেও এসেছিলাম অফিসে। ভোট উত্সবের জন্য 'মিডিয়াতে' কিছু 'অতিরিক্ত' লোক নিয়োগ করা হয়। টেম্পোরারি। ভোট শেষ। তোমার অবদান মনে রাখাও শেষ। তুমি এবার তোমার রাস্তা দেখে নাও। হয়তো কেউ এমন কর্কশ করে বলেন না। উপায় নেই ওই মানুষগুলোরও।তাঁরা তো মালিক নন। মাইনে দেন না। তাঁদেরও মন আছে। আর এসো না বলতে, তাঁদেরও গলায় মাংসপিণ্ড আটকে যায়। কিন্তু যিনি শোনেন, তাঁর কাছে এই, আর না আসার খবর পাওয়াটা বড্ড কর্কশ।এই ভোটের সুযোগেই গত তিন মাস বেশ কিছু নতুন মুখ চারপাশটা থেকে আনাগোনা করত। সেভাবে কোনওদিনও কথা হয়নি কারও সঙ্গেই। আজ, তাঁদেরই দুজন সক্কালবেলায় এসে বলল, আজই শেষ চললাম।


গায়ে শিহরণ অনুভব করলাম মুহূর্তে। চোখে চোখ পড়ল। সামনের চোখ জোড়া প্রথমে চিকচিক, তারপর টলমল, মাধ্যাকর্ষণের টানে মাটির ছোঁয়া পাওয়ার আগের মুহূর্তে সামলে নেওয়া! বুকটা হালকা হল। কেন এমন? একজন নয়, দুজন নয়, বেশ কয়েকজন আজকের পর আর আসবে না। ওদের ভোট শেষ। ওরা বলে গেল, যোগাযোগ রাখব। ওরাই বলল, চলে গেলে কে আর মনে রাখবে। ওরাই বলল, কোনও সূযোগ থাকলে বোলো। ওরাই বলল, অবশ্য আমাদের আসার আগে অন্য লোক নেওয়া হয়ে যাবে।


ওদের নাম নেই। ওরা প্রতীক। ওরা আমার অফিসে। ওরা আমাদের প্রতিদ্ব্ন্দী কোম্পানির অফিসে, ওরা এই শহরের কত অফিসে আলো করেছিল এতদিন। আজ ওদের সবাই বাড়ি ফিরে যাবে। তামাক ছাড়ার শপথের দিনে ওদের অফিসটাই ছাড়তে হবে। ওরা সংখ্যায় কয়েকশো। এটা তো শুধু মিডিয়ায়। পরে বোঝার চেষ্টা করলাম, এই একটা ভোটের জন্য কত মানুষের অন্ন সংস্থান হয়। নেতাদের কাছে ভোট জেতা-হারার ম্যাচ। ভোট রাজনৈতিক কেরিয়ারের মাইলস্টোন। কিন্তু এ রাজ্যের সাধারণ মানুষের কাছে এই ভোট পেটে ভাত দেয়।চোখে স্বপ্ন এনে দেয় দুটো পয়সা রোজগারের।


মন সত্যিই বড় খারাপ আজ। ভোট ভালো। ভোট অনেক মানুষের কাজ দেয়। ভোট অনেক মানুষের বাড়িতে রোজগার দেয়। ভোট অনেক বেকারের চোখে ভালো থাকার স্বপ্ন এঁকে দেয়। এতসবের পরেও ভোট বড্ড খারাপ।কারণ, ভোট শেষ হয়ে যায়। আর আসছে বছর আবার নয়, আসছে পাঁচ বছর পর আবার হয়। ভোটের অঙ্ক বুঝতে পারি না। ভোট শেষে মানুষের ফের বেকার হয়ে যাওয়াটাও বুঝতে পারি না। লেখার, বলার অনেক বিষয়। সন্ত্রাস, মৃত্যু, ঘর-বাড়ি পুড়ে যাওয়া, বাড়ি ছাড়া হওয়া। কিন্তু আজ আমার তিন মাসের অচেনা সহকর্মীদের চোখে চোখ রেখে বুঝতে পারলাম - 'ভোট শেষ তাই কোম্পানির সঙ্গেও জোট শেষ'। খুব জোরে চিত্কার করে আজ ওদের সব্বাইকে বলতে ইচ্ছে হল, আমি তোমাদের সঙ্গে 'জোট'টা রাখব।