স্বরূপ দত্ত


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

ইদানিং কথাটা শুনতে পাই খুব। 'বই এখন আর কে পড়ে!' যাঁরা বলেন, তাঁরা শিক্ষিত মানুষ! জানি না, আপনার পাশের লোক বলে কিনা! আমি অন্তত আশেপাশের অনেক মানুষকেই কথাটা বলতে শুনি। বই যেন বড় তাচ্ছিল্যের জিনিস। বই তো এখন 'e' হয়ে গিয়েছে! কাগজের নৌকা, কাগজের বউ-এর মতো দাম কমে গিয়েছ নাকি কাগজের বইয়েরও! সব পড়তে হবে স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনে! সব পড়তে হবে বাড়ির ডেস্ক টপে বসে! কিন্তু দুই মলাটের পাতায় নতুন পাতার গন্ধের দাম নাকি এ যুগে আর নেই!


শুনতে খারাপ লাগে। অনেক ভেবেও সড়গড় হওয়ার চেষ্টা করেও বিশেষ লাভ হল না! আসলে ছেলেবেলা থেকে মায়ের ভরসার আঁচল আর বইয়ে মুখ গুঁজে বড় হয়েছি। বুড়োও হতে চাই ওই বইয়ে মুখ গুঁজেই। কিন্তু মোবাইল ফোন মুখ গোঁজাটা আর যাই হোক আমার অন্তত চরিত্রের সঙ্গে যায় না। আমি নিশ্চিত, অনেকের সঙ্গেই যায় না। কিন্তু বই পড়ুন, বই পড়ো, বই পড়, এসব সামনের লোককে বলতেও এখন কেমন যেন একটা দ্বিধা আসে মনে। বই পড়া মানুষ তো! এই সমাজের চোখে ব্যাকডেটেড হয়ে গিয়েছি হয়তো!


সাম্প্রতিক মোবাইল ফোনের, ই বুকের যুগে, বুকটায় একটা কষ্ট দানা বাঁধছিল। 'বই কেউ পড়ে না আজকাল'! দেখতে চার শব্দের একটা বাক্য। কিন্তু বুকটা দুমড়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ঠ। খারাপ লাগে। বই তো সম্মানের বড়। বই যে সঙ্গীও বড়। সেই জন্ম-জন্মান্তরের সঙ্গীর এমন অসম্মাণ, আসলে নিজের মেরুদণ্ডটাতেও খুব জোরে আঘাত করে। কিন্তু ওই মানুষগুলোর সঙ্গে তর্ক করতে মন চায় না। শুধু মন চায়, বইয়ের সাস্থ্য আর আয়ু যেন অনেক অনেক বেড়ে যায়।


আমার মতোই এ শহরের, এ রাজ্যের, এ দেশের অনেক মানুষই বইয়ের জন্য এমন প্রার্থনা নিশ্চয়ই করেন। তারই বোধহয় খানিকটা ফল পাওয়া গেল। এ দেশে অন্তত বই পড়ার হার মোটেই কমেনি। যাঁরা বই কেউ পড়ে না কথাটা বলেন, তাঁরাই বোধহয় ব্যাকডেটেড হয়ে পড়লেন। কারণ, একটা তথ্য - সারা পৃথিবীতে আজও এক দিনে সবথেকে বেশি সময় বই পড়েন ভারতীয়রাই! হ্যাঁ, গোটা বিশ্বে ভারতীয়রাই আজও সারাদিন সবথেকে বেশি সময় বই পড়ে কাটান।


একজন ভারতীয় গড়ে প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা ৪২ মিনিট বই পড়েন। বই পড়াতে ভারতের নিকটতম প্রতিদ্বন্দী থাইল্যান্ড । সারা দিনে গড়ে চিনের লোকরা বই পড়েন ৯ ঘণ্টা ২৪ মিনিট। ভারত বেশ খানিকটাই এগিয়ে। কিন্তু, যারা অনেক বেশি প্রষুক্তি নির্ভর বলে, পৃথিবীটা নিজেদের জমি ভাবে, তারাই বরং, বই পড়াতে পিছিয়ে পড়েছে অনেকটা। এক্ষেত্রে শুরুতেই এমন তিনটে দেশের উদাহরণ দিই। এক, আমেরিকা। বই পড়াতে আমেরিকানরা এখন সারা বিশ্বের বিচারে রয়েছে ২২ নম্বরে। একজন আমেরিকান সারাদিনে গড়ে মাত্র ৫ ঘণ্টা ৪২ মিনিট বই পড়ে। দুই, ইংল্যান্ড। ইংরেজদের পড়াশুনো শিকেয় উঠেছে। কারণ, তালিকায় তাদের স্থান আরও পিছনে। ২৬ নম্বরে থাকা ইংরেজরা একদিনে ৫ ঘণ্টা ১৮ মিনিট করে গড়ে বই পড়ে! প্রযুক্তিতে অনেক উন্নতি করেছে জাপান। তাই বই পড়ার হিসেবের তালিকায় জাপানিদের এখন দূরবীণ দিয়ে খোঁজার মতো অবস্থা। কারণ, তারা রয়েছে ২৯ নম্বরে! একজন জাপানি সারাদিনে গড়ে ৪ ঘণ্টা ২৬ মিনিট বই পড়ে! এক কাজ করি, প্রথম ৩০ দেশের তালিকা আগে দিয়েই দিই-


১) ভারত - ১০ ঘণ্টা ৪২ মিনিট
২) থাইল্যান্ড - ৯ ঘণ্টা ২৪ মিনিট
৩) চিন - ৮ ঘণ্টা
৪) ফিলিপিন্স - ৭ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট
৫) মিশর - ৭ ঘণ্টা ৩০ মিনিট
৬) চেক প্রজাতন্ত্র - ৭ ঘণ্টা ২৪ মিনিট
৭) রাশিয়া - ৭ ঘণ্টা ৬ মিনিট
৮) সুইডেন - ৬ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট
৯) ফ্রান্স - ৬ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট
১০) হাঙ্গেরি - ৬ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট
১১) সৌদি আরব - ৬ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট
১২) হংকং - ৬ ঘণ্টা ৪২ মিনিট
১৩) পোল্যান্ড - ৬ ঘণ্টা ৩০ মিনিট
১৪) ভেনেজুয়েলা - ৬ ঘণ্টা ২৪ মিনিট
১৫) দক্ষিণ আফ্রিকা - ৬ ঘণ্টা ১৮ মিনিট
১৬) অস্ট্রেলিয়া - ৬ ঘণ্টা ১৮ মিনিট
১৭) ইন্দোনেশিয়া - ৬ ঘণ্টা
১৮) আর্জেন্টিনা - ৫ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট
১৯) তুরস্ক - ৫ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট
২০) স্পেন - ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট
২১) কানাডা - ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট
২২) জার্মানি - ৫ ঘণ্টা ৪২ মিনিট
২৩) আমেরিকা - ৫ ঘণ্টা ৪২ মিনিট
২৪) ইতালি - ৫ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট
২৫) মেক্সিকো - ৫ ঘণ্টা ৩০ মিনিট
২৬) ইংল্যান্ড - ৫ ঘণ্টা ১৮ মিনিট
২৭) ব্রাজিল - ৫ ঘণ্টা ১২ মিনিট
২৮) তাইওয়ান - ৫ ঘণ্টা
২৯) জাপান - ৪ ঘণ্টা ৬ মিনিট
৩০) কোরিয়া - ৩ ঘণ্টা ৬ মিনিট


এবার তালিকাটার দিকে দুটো-তিনটে জিনিস আপনার মাথায় আসবে। এক, গর্ব। কারণ, ভারতের নামটা সবার আগে, সবার উপরে! তাও জিনিসটা, খুন, রাহাজানি, ধর্ষণের জন্য নয়। বই পড়াটা বোধহয় খানিকটা সামাজিক মর্যাদাই। বিশ্বসংসারে বেশ খানিকটা সম্মান ভারতের শুধু এই জন্যই পাওয়া উচিত। আপনি পড়লে জ্ঞানী হবেন, এটা তো ঠিক। তাহলে এই তালিকার দিকে চোখ বোলালে বাকি বিশ্বের ভারতকে একটু বাড়তি সমীহই করার কথা। একজন ভারতীয় হিসেবে এবং আপাদমস্তক বইপ্রেমী হিসেবে বেশ গর্বই লাগছে আমার। আশা, আপনারও মনের অবস্থা তেমন। মাথায় রাখবেন, কানাডা এই পৃথিবীর সবথেকে শিক্ষিত দেশ। কিন্তু বই পড়ার তালিকাতে তারাও রয়েছে কিনা ২১ নম্বরে!


আর দ্বিতীয় যেটা বেশি করে চোখে লাগছে, তা হলো - তথাকথিত প্রথম বিশ্বের দেশ বলে যারা পরিচিত, তারা কিন্তু বইয়ের পাতায় দাদাগিরিতে অনেকটাই পিছিয়ে। যে দেশ যত বেশি প্রযুক্তি নির্ভর, সে দেশের বই পড়া লাটে উঠেছে! বরং, উপরের সারিতে রয়েছে তারাই, যাদের প্রযুক্তির স্রোতে গা ভাসানোও আছে, আবার আছে ঐতিহ্যকে, ভালোবাসাকে বুকে টেনে রাখার অভ্যাস। তবে, একটা সামান্য খারাপ লাগাও আছে। আমরা বাঙালিরা তো মূলত বাংলা ভাষার বই পড়ি। বাংলা যেমন আমাদের রাজ্যের ভাষা, তেমনই যে বাংলাদেশেরও ভাষা। বরং, বাংলাদেশের জন্যই বেশি করে আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষাটার একটু বেশিই স্বীকৃতি। সেই বাংলাদেশ কিন্তু বই পড়াতে বেশ পিছিয়ে পড়েছে। ও দেশের সরকার থেকে সাধারণ মানুষের কিন্তু এখনই এই বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার।


মাঝেমাঝেই বিভিন্ন সব তালিকা প্রকাশ পায় রাষ্ট্রসংঘের পক্ষ থেকে। সেই খারাপ জিনিসের তালিকায় ভারতকে অনেক সময়ই দেখি তালিকার উপরের দিকে থাকতে। খারাপ লাগে। কিন্তু সত্যি বলছি। বই পড়ার তালিকায় ভারত যে সবার উপরে, এটা ভেবে আজ বড্ড গর্বিত লাগছে। হাসি পাচ্ছে, তাঁদের মুখটা আরও একবার মনে করে। যাঁরা বলেন, 'বই আবার আজকাল কেউ পড়ে নাকি!' -এর উত্তর একটাই, পড়ে 'বই'কি!


আরও পড়ুন আমরা মানুষ হলে, তিনি কী? আর তিনি মানুষ হলে আমরা কী?