স্বরূপ দত্ত


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

 


আর ঠিক একটা মাস পর তাঁর জীবনে আসত আরও একটা জন্মদিন। পা দিতেন ৬৯-এ। কিন্তু 'টার্ন'-টা যে বরাবরই খুব ভালো নিতেন। জীবন-মৃত্যুর এই অসম লড়াইতেও, 'ক্রুয়েফস টার্ন' অনবদ্য। চলে গেলেন। এটা লিখতে হয়, তাই লেখা। কারণ, জোহান ক্রুয়েফরা কোথাও যান না। তাঁরা যেখানে থাকেন, সেখান থেকে যাওয়া যায় না। মানুষের মন থেকে ক্রুয়েফকে কে যেতে দেবে!


গোটা দেশে যখন চলছে রঙের উত্‍সব। খবরটা এলো তখনই। জোহান ক্রুয়েফ প্রয়াত! বুকটা কেঁপে উঠল। জোহান ক্রুয়েফ নেই! এটা মানা যায়! আরে ওই লোকটাই তো জিততে শেখালেন। সেই এভাবে অসুখের সঙ্গে লড়তে লড়তে হার মানবেন! না, প্রকৃতির এটা ঠিক হল না। প্রকৃতি বড় ভুল লোককে বাঁছলো, নিয়ে যাওয়ার জন্য। যাঁরা এ লেখাটা পড়ছেন, মূলত, তাঁদের দুটো ভাগ। এক দল- যাঁরা ক্রুয়েফকে জানেন। খেলা দেখেছেন তাঁর। আর একদল নতুন প্রজন্ম। তাই ক্রুয়েফের সম্পর্কে বিশেষ জানা নেই তাঁদের। আর খেলাও দেখা হয়ে ওঠেনি। এই দুধরনের পাঠকদের উদ্দেশ্য করেই কথাটা বলা। যাঁরা জানেন, আজ তাঁদের আরও ভালো লাগবে। আর যাঁরা ক্রুয়েফকে চেনেন না বা জানেন না, কারণ, তাঁদের বয়স একটু কম, তাঁদের আজ বড্ড ভালো লাগবে। ঠিক পড়ার পর বলবেন, 'ইস্ লোকটা চলে গেল!'


ওয়েবসাইটের স্বার্থেই, পড়তে সুবিধার জন্য লেখাটা 'পয়েন্ট ওয়াইজ' করে নিলাম। এতে আপনাদের পড়তে সুবিধা হবে। নাহলে যে লোকটাকে নিয়ে আজ লিখতে বসছি, তাঁকে নিয়ে একটা ''ক্রুয়েফায়ণ'' বা একটা 'মহাক্রুয়েফ' লিখে ফেলাটা মোটেই দুসাধ্য নয়। বরং, সহজ। লেখার পয়েন্ট হবে ১৪ টা। কারণ, পরিষ্কার। ক্রুয়েফের জার্সি নাম্বার ছিল এটাই। আর বলতে পারেন, কলকাতার মাঠেও এই যে তুষার রক্ষিত, বাসুদেব মণ্ডলরা ১৪ নম্বর জার্সি পড়ে খেলতে এত পছন্দ করতেন, তার কারণ, সংখ্যাটা ক্রুয়েফের তাই। তাহলে শুরু করা যাক।


১) ক্রুয়েফের গল্প আই এম বিজয়নের মতোই - জীবনের শুরুর গল্পটায় আমাদের বিজয়নের সঙ্গে ক্রুয়েফের বড্ড মেলে। কিরকম! ত্রিচুরের স্টেডিয়ামের পাশে জলের বোতল বিক্রি করতে করতে জীবন শুরু হয়েছিল বিজয়নের। সেখান থেকে ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম সেরা হয়ে ওঠা। অভাবের গল্প ক্রুয়েফেরও একইরকম। তাঁর মা ক্যান্টিন চালাতেন হল্যান্ডের আয়াক্স আমস্টারডাম ক্লাবে। বিকেলবেলায় তাই ফাউ ফুটবল দিয়েই দেওয়ালে মেরে একা একা চলতো প্র্যাকটিস। তারপর ক্রুয়েফ হয়ে ওঠা। বিশ্বের সর্বকালের সেরা ফুটবলার। অন্যতম আজ মৃত্যু দিনে বসাতে ইচ্ছে হল না সেরার আগে।



২) সিগারেট আর ক্রুয়েফ - ক্রুয়েফ ছিলন চেন স্মোকার। বলতেন সারা দিনে ২ প্যাকেট সিগারেট খান। কিন্তু, বেশি হলেও হতে পারে। ফিফা টেকনিক্যাল এরিয়ায় কোচদের সিগারেট খাওয়া নিষিদ্ধ করল তো সেদিন। কিন্তু ক্রুয়েফ যখন চুটিয়ে কোচিং করাচ্ছেন, তখনই ফিফা কর্তারা ঘোষণা করলেন, আর টেকনিক্যাল এরিয়ায় কোচ, ম্যানেজাররা সিগারেট খেতে পারবেন না। কোথায় যান ক্রুয়েফ! ভাবলেন, ধুর কোচিংটাই ছেড়ে দেবেন। কিন্তু অত সহজ! ফুটবল ছাড়া তিনি বাঁচবেন কীভাবে! পাল্টালেন সিদ্ধান্ত। কোচিং করালেন। না, আর সিগারেট ছোঁননি ক্রুয়েফ! ইউনিসেফ পর্যন্ত ক্রুয়েফকে তাঁদের নো স্মোকিংয়ের হয়ে প্রচারের জন্য ব্র্যান্ড অ্যম্বাসাডর ঘোষণা করল! যে মানুষ এমন কঠিন লড়াই জিতেছিলেন অবলীলায়, সেই আজ হেরে গেলন! মানতে কষ্ট হবে না?



৩) টোটাল ফুটবলের কনডাক্টর - রেনেশ মিশেল যে ফুটবল কোচিংটা শুরু করেছিলেন, তার মত ছিল প্রেসিং ফুটবল। অর্থাত্‍ বিপক্ষের পায়ে বল পড়লেই, তাঁদের চেপে ধরো। সেটাই কীভাবে যেন প্রেসিং থেকে টোটালে পরিণত হয়ে গেল! যাক গে যাক। এই 'টোটাল অপভ্রংশ' নিয়ে পরে একদিন আলোচনা করব। আজ শুধু বলা, রেনেস মিশেলের সেই প্রেসিং ফুটবলের সিস্টেমে খেলতেন তো মাঠে এগারোজনই। কিন্তু লিডারই বলুন, কনডাক্টরই বলুন অথবা শিল্পী। ক্রুয়েফই ছিলেন সব। রেনেসের মস্তিষ্ক আর ক্রুয়েফের পায়ের 'মিশেল'!



৪) তিনটে ব্যলন ডিওর আছে বাড়িতে - ব্রাজিলের বা আর্জেন্টিনার ফুটবলার নন। ক্রুয়েফ নেদারল্যান্ডের ফুটবলার। বিশ্বকাপ-টিশ্বকাপে তাঁদের দেখা যায় শুধু। কিন্তু কমলা সুন্দরীরা জেতেন না। সব পাল্টে দিয়েছিলেন প্রায় একা ক্রুয়েফই! ১৯৭৪-এ তাঁর জন্যই হল্যান্ড উঠেছিল বিশ্বকাপের ফাইনালে। ১৯৭৮-এ তিনি খেলেননি। কিন্তু এতটাই প্রেরণা ছিলন যে, ফের বিশ্বকাপ ফাইনালে হল্যান্ড। সেই লোকটার বাড়িতে তো তিনটে ব্যালন ডিওর থাকবেই। আপনি ৩ সংখ্যাটার সঙ্গে আজকের দিনের অনেকের তুলনা করবেন হয়তো। কিন্তু তুলনাটা না করলেই ভালো করবেন। কারণ, কিছু মানুষ 'অতুলীনয়' হন। ক্রুয়েফ তেমনই।



৫) রেকর্ড ট্রান্সফার - আজকের দিনে রোনাল্ডো, বেলরা যে কাড়ি কাড়ি টাকায় ট্রান্সফার হন বিভিন্ন ক্লাবে, সেদিনও অন্যথায় ছিল না। আর ক্রুয়েফ ফুটবল জীবনের শুরুতে আয়াক্সের হয় ঝড় তুলে দিয়েছিলেন। তাই হন্যান্ডের বাইরে স্পেন পর্যন্ত সে খবর পৌঁছতে দেরি হয়নি। বার্সা এমন ফুটবলারকে কখনও ছাড়ে! তাই ১৯৭৩-এ ক্রুয়েফ এসেছিলেন বার্সোলানায়। সবথেকে বেশি টাকায়। আজকের বেল-দের মতো তাঁর টাকার পরিমানও সেদিন অনুযায়ী ঠিকই ছিল।



৬) ৫৪ দেশের ১০০ বছরের সেরা - ইউরোপের গত শতাব্দীর সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হয়েছিলেন ক্রুয়েফ। হ্যাঁ, ১০০ বছরের সেরা ফুটবলার। এবং সেটা গোটা ইউরোপ মহাদেশের! আপনি ভাবুন, ইউরোপের ৫৪ টা দেশ ফুটবল খেলে। এই ৫৪টা দেশের হয়ে ১০০ বছরে কত কত ফুটবলার খেলেছেন। এঁদের মধ্যে কত কিংবদন্তি রয়েছে! সবাইকে টপকে সেরা ক্রুয়েফ। এবার কী আর বলে বোঝাতে হবে, কোন লোকটা আজ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন, বুঝলেন! তাও না বুঝতে পারলে, মনে করার চেষ্টা করুন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সেরা ফুটবলারদের কথা। সবার নাম মনে পড়ার পর, জানবেন, ক্রুয়েফই সেরা!



৭) বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা ১০০ বছরে !- হ্যাঁ, ইউরোপের প্রথম। বিশ্বের ক্ষেত্রে তাঁর ঠাঁই হল, দ্বিতীয় স্থানে। কী করবেন, আগে যে পেলে বলে একটা নাম আছে। কিন্তু পেলের পরে যে নামের সংখ্যাটা হাজার হাজার। সেখানে আবার পেলের মতো তিনিই সবার আগে। হ্যাঁ, যে লোকটা আজ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন, তিনি ১৯০০ থেক ১৯৯৯ পর্যন্ত এই গ্রহের দ্বিতীয় সেরা ফুটবলার। পেলের পর আপনি অনেক নাম করতে পারেন। কিন্তু দ্বিতীয় সেরা ক্রুয়েফই।




৮) ক্রুয়েফস টার্ন - দেখেছেন কখনও? দাঁড়ান, নিচে ভিডিও দিয়ে দিচ্ছি। এই পৃথিবীতে বল নিয়ে কারিকুরি অনেকেই দেখিয়েছেন। আজই তো মেসি-রোনাল্ডোদের কত 'ভাজাভাজি' করতে দেখেন। সেদিনের ডেনিলসন তো বল নিয়ে যা খুশি তাই করতে পারতেন। কিন্তু ক্রুয়েফ একটা টার্ন নিতেন বল পায়ে। ওটা তিনি একাই নিতেন। আর ওভাবে বল কাটালে, কোন ডিফেন্ডার আর আটকে রাখবে! তাই ভালো করে দেখে নিন, ক্রুয়েফ টার্ন।


 




৯) ফ্যান্টম গোলের মালিক!- ক্রুয়েফ টার্ন তো দেখে ফেললেন। এবার শুনুন ফ্যান্টম গোলের কথা। তখন ক্রুয়েফ বার্সাতে খেলছেন। খেলা পড়ল অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিরুদ্ধে। ক্রুয়েফ একটা গোল করেছিলেন। সেটা এতটাই বিষ্ময়কর ছিল যে, গোলটার নামও হয়ে যায় ফ্যান্টম গোল! মানে, অশরীরীর করা গোল! হাঃ, হাঃ, এসব কাব্য টাব্য ক্রিকেটে হয়। যে ফুটবলার, ফুটবলেও এমন কাব্য এনে দিতে পারেন, তাঁর শিল্পসত্ত্বা নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন থাকে।




১০) তিনি গোল করলে নেদারল্যান্ড হারত না - নেদারল্যান্ডের হয়ে ১১ বছর ফুটবল খেলে মোট ৪৮টি ম্যাচে ৩৩ গোল করেছেন ক্রুয়েফ। ভাবছেন এত বড় ফুটবলার, তাঁর কিনা মাত্র ৩৩ গোল! তাহলে একটা তথ্য দিই। যেটা আপনাকে চুপ করিয়ে দেবে। ক্রুয়েফ যে ম্যাচে একটি গোলও করেছেন, নেদারল্যান্ড সেই ম্যাচে হারেনি!! আপনি রেকর্ডটা ভেবে নিন একবার। সচিন তেন্ডুলকর, বিরাট কোহলিদের সঙ্গে অথবা ফুটবল বিশ্বের যোকনও কারওর সম্পর্কে জেনে আসুন। এরকম গর্বের তথ্য পেলে মেইল করবেন। ভালো লাগবে। ক্রুয়েফরা যে ম্যাচে খেলতেন, সে ম্যাচে দেশ হারবে কেন! তাহলে তিনি মাঠে ছিলেন কী করতে!



১১) জার্সি নম্বর ছিল ১৪ - তিনি, যখন ফুটবল খেলতেন, তখন ১ থেকে ১১ এই নম্বরেরই জার্সি নাম্বার দেওয়া হতো। কিন্তু লোকটা যে একটু হাটকে। তাই বেরিয়ে গেলেন ১১-র ওপাশে। নিজের জন্য বাঁছলেন ১৪ নম্বর জার্সি। সেই শুরু। ফুটবলবিশ্বে এই ১৪ নম্বর জার্সির কদর বেড়ে গেল। আমাদের তুষার রক্ষিত, বাসুদেব মণ্ডলদের ছাড়ুন। থিয়েরি অঁরি কিংবা মার্ক ওভারমার্স, সবার কেরামতিই ওই নাম্বার ফোরটিনের জন্য।



১২) কাঁদের কোচ ছিলেন জানুন - ফুটবল কেরিয়ারের শেষের পর কোচিংয়েও এলেন। দায়িত্ব নিলেন বার্সেলোনারও। কারা খেলতেন সেই বার্সা দলে? আজকের যে পেপ গুরার্দিওলাকে নিয়ে খুব লাফালাফি হয়, সেই পেপ খেলতেন ক্রুয়েফের কোচিংয়ে। আর দলের বাকিদের নামগুলো এরকম - রোমারিও!(বিশ্বের সবথেকে বেশি গোলের মালিক।), স্তোইচকোভ (বুলগেরিয়ার ফুটবলের পেলে বা মারাদোনা বলতে পারেন তাঁকে), মাইকেল লাউড্রপ (এই ড্যানিশ ফুটবলারকে কে না চেনে! বলা ভালো দুই ভাইকেই)। কোম্যান, (যাঁরা নিয়মিত ডাচ ফুটবল ফলো করতেন, তাঁরা ভালো চিনবেন), ক্রুয়েফের হাতে তৈরি এই টিমকে বলা হতো, ড্রিম টিম। যা যা জেতার ছিল, সবই জিতেছিলো এই ড্রিম টিম।



১৩) আমেরিকায় পাড়ি তিনিও দিয়েছিলেন - ফুটবলের প্রসার আমেরিকায় করার জন্য পেলে শুধু একা যাননি। ৩২ বছর বয়সে খেলা ছাড়ার পর ক্রুয়েফ গিয়েছিলন লস অ্যাঞ্জেলেস অ্যাজটেকে খেলতে। পেলে গিয়েছিলেন কসমসে। ক্রুয়েফের ওরকম বেতের মতো ছিপছিপে শরীরে ফুটবল দেখে আমেরিকানরাও প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন তাঁর।



১৪) এই গ্রহে থাকলেন না, অন্য গ্রহটাই তিনি  - জন্মেছিলেন ১৯৪৭-এর ২৫ এপ্রিল। চলে গেলেন আজ ২৪ মার্চ ২০১৬। বয়স ৬৮ বছর। কালের নিয়মেই কোনওদিন চলে যাবেন, জানতো সবাই। তাই, কলেজ, ইন্স্টিউট, প্রতিযোগিতা, বিশ্ববিদ্যালয়, যার যার নাম তাঁর নামে করা যায়, ক্রুয়েফের নামে সবই হয়েছিল। বাকি ছিল একটা কাজ। সেটাও হয়ে গিয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল অ্যস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন ২০১০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর একটা বামন গ্রহের নাম করে দেয় ক্রুয়েফের নামে! হ্যাঁ, ওই বামন গ্রহটির নাম ১৪২৮২ ক্রুয়েফ! তাই আজ থেকে তিনি হয়তো পৃথিবীতে মৃত বা প্রয়াত। কিন্তু অনেক দূরের এক আকাশে ক্রুয়েফ চিরকাল থাকবেন জীবিত।