স্বরূপ দত্ত


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

সদ্য শুরু বর্ষা। প্রাকৃতিক নিয়মেই চলবে অন্তত আগামী ১০০ দিন। অফিসের নিচে নেমে একটা সিগারেট খেতে গিয়ে চারপাশটা কালো করে বৃষ্টি দেখতে বেশ দিব্যি লাগছিল। হাতের সিগারেটটা কখন শেষ হয়ে গিয়েছে। ফের ধরালাম আরেকটা। ওই বৃষ্টির ছাঁট থেকে নিজেকে বাঁচাতে ইচ্ছে হল না। শরীর পিছিয়ে মনকে এগিয়ে দিচ্ছিলাম আরও। পড়ুক ক'ফোঁটা জল। শরীর, মন, যাক ভিজে সব। শুধু যে প্রকৃতির একার দরকার রয়েছে বর্ষাকে, তা তো নয়। বছরে একবার বর্ষা না আসলে, মনের খরা কাটবে কীভাবে?


ওই ভরা বৃষ্টিতেই দেখছিলাম, ওদের দুজনকে। কতই বা বয়স আর? বছর বাইশ-তেইশ। ছেলেটি আর মেয়েটি টাপুর-টুপুর বৃষ্টির তালে দিব্যি চলে যাচ্ছিল, এগিয়ে। ওদের গন্তব্য তো আমার জানা নেই। তবে, ওদের পথ প্রেমের। বেশ লাগলো। হাতে ছাতা রয়েছে। কিন্তু সেটা নিপাটভাবেই বেঁধে রাখা। তা বলে মনকে বেঁধে রাখার কোনও ইচ্ছে নেই ওদের। বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা ওই যুগলকে দেখে ভালোলাগাটা কেটে গেল, পাশের দুজনের একটা কথা শুনে। মাঝবয়সীই হবেন তাঁরা। বলছিলেন, একে অপরকে, 'গেল। সব উচ্ছন্নে গেল। এই বৃষ্টিতে শরীর দেখিয়ে প্রেম করতে করতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। লাজ-লজ্জার আর বালাই রইল না!' কিন্তু ওই মাঝবয়সীদের কথা শুনে, অন্য দু'-তিন জন যুবকও তাতেই সায় দিল। অর্থাত্, এভাবে ভিজতে ভিজতে প্রেম করার বিপক্ষে!


ভাবনার রসদটা এলো মাথায়। বলা ভালো প্রশ্নটার। কোনটা ভালো? প্রেমকে গোপন রাখা? নাকি এভাবেই খুল্লামখুল্লা সঙ্গীর হাতে হাত রেখে এই পৃথিবীর তোয়াক্কা না করে প্রেমের বরষায় ভিজে যাওয়া? কোনটা ভালো? কোনটা নিজেদের জন্য বেছে নেবে প্রেমিক-প্রেমিকা? এ গল্প তো আর আজকের নয়, চিরকালের।


আমার মনে হয়, মানুষ যখন নিজে প্রেম করে, তখন সে খুল্লামখুল্লাতে বিশ্বাসী। কিন্তু প্রেম যদি নিজের না হয়ে অন্যের হয়, তাহলে সেটা বোরখার আড়াল থেকে বেরোলেই বিপদ! প্রেম যে বড় সর্বেনেশে নেশা। দিনের শেষে ক'ফোঁটা প্রেমের জলে শরীর আর মন না ভিজলে, কী আর মন বসে? এই তো সেদিন এক সহকর্মীর মুখে শুনছিলাম। সদ্য প্যারিস ঘুরে এসেছে সে। মুগ্ধতার রেশ চোখে রেখেই বলছিল, 'প্যারিস কেন প্রেমের শহর বুঝলাম। রাস্তার দুপাশে সারি সারি যুগল প্রেম করছে।' ভাবছিলাম, ঠিকই তো। চোখের সামনে দুজন মানুষ, পরষ্পরকে ভালোবাসছে দেখলে তো ভালই লাগে। তাহলে আমাদের কেন এত রাখঢাক?


ছেলেবেলা থেকেই পড়ে এসেছি, শুনে এসেছি, প্রেমই জীবন। ঈশ্বরের সবথেকে বড় দান প্রেম। প্রেমের মাধ্যমেই মানুষ যেতে পারে স্বর্গে। প্রেমের সাগরে ডুব না দিলে কি আর জীবন-অমৃতের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিলো কোনওদিন? প্রশ্নটা সেখানেই। এ কেমন দ্বিচারিতা সমাজের? বলবে, শেখাবে, উপদেশ-পরামর্শ দেবে প্রেম করার। কিন্তু চোখের সামনে কাউকে প্রেম করতে দেখলেই, 'ছিঃ ছিঃ'! বুঝুন কাণ্ড। ভিজতে হবে প্রেম বৃষ্টিতে। কিন্তু নিজেদের ঢাকতে হবে মেঘের আড়ালে। লোক দেখানো সব সমাজ সহ্য করে নেবে হাসিমুখে। কিন্তু লোক দেখানো প্রেম? ডিরেক্টরের মতোই সটান বলে দেবে 'কাট'!


অন্যের প্রেম কেন ২০১৬-তে এসেও আমাদের কাছে 'সুস্বাগতম' পাবে না? কেন, 'তাকে' লুকিয়ে পড়তে হবে ঝোপের আড়ালে অথবা পার্কের বাগানে? বাসে, ট্রেনে কোনও প্রেমিকা কোনও প্রেমিকের শরীরে খানিকটা এলিয়ে দেয় নিজের শরীর, কী এত আপত্তি থাকতে পারে আমাদের? কেন ওই 'যুগলকেই' ভাবতে হবে, না, এটা এখানে করা যাবে না? অথবা কেন, সামনে থেকে কোনও একজন বলে উঠবে টিপ্পনি কেটে যে, 'ইস্, সব রসাতলে গেল'! যেভাবে পৃথিবীটায় হিংসা ভরে গিয়েছে, এবার আমাদের এই আদিখ্যেতা থেকে একটু একটু করে বেরোনোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। সমাজকে আমরা যেভাবে সাজাবো, সেভাবেই আমাদের সমাজটা সাজবে।


সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ঐতিহ্য নিশ্চয়ই বজায় থাক। বজায় থাক, শালীনতা, সীমাও। আমাদের প্রেমের ঠাকুর শ্রীকৃষ্ণ, দিব্যি 'মেয়েদের' পোশাক লুকিয়ে রেখেছিলেন তাঁদের স্নানের সময়। অথচ, ২০১৬-তে এসে কেউ চোখের সামনে শরীর ভিজিয়ে প্রেম করলে, আমাদের 'শালীনতাবোধ' উথলে ওঠে। ISIS নামক এক মহামারী যেভাবে পৃথিবীর বুকে বাসা বেঁধেছে, তাতে হয়তো রাস্তা-ঘাটে বেঘোরে মারা যাওয়াটাই আমাদের ভবিতব্য। তাই যদি থাকে কপালে, তাহলে প্রেম করতে করতে হাসিমুখেই হোক না দুটো শরীর নিথর ওই ভিড় বাসে ট্রামেই। বৃষ্টি ভেজা প্রেমের শুরুটা রক্তে ভিজে শেষ হলেও, দুটো শরীর থাকবে তো 'আপন শরীরে'।