এক হেলিকপ্টার আর তিন প্রিয় ক্রিকেটার
স্বরূপ দত্ত
হেলিকপ্টার। ছেলেবেলা থেকে আজ পর্যন্ত যে যান নিয়ে সবথেকে বেশি উত্তেজিত হই। বিমান দারুণ। চড়াও হয়েছে। ভালো। জাহাজ, সে আরও ভালো। সেটাও চড়েছি জীবনে। কিন্তু আজ পর্যন্ত ওঠা হল না, যে জিনিসটায়, সেটা হল হেলিকপ্টার। কারণ, ট্রেন-বাস-ট্রাম তো চেপে চেপে অভ্যাস হয়ে গেল। কিন্তু ফ্যান্টসিটা হেলিকপ্টারটা সম্পর্কে সেই একইরকম রয়েছে। ছেলেবেলাতেই সবাই বলতো, ফড়িং দেখেই নাকি হেলিকপ্টার বানানোর পরিকল্পনা এসেছিল বিজ্ঞানীদের। আর ফড়িং কার ভালো লাগে না বলুন? ছেলেবেলায় কে ফড়িং ধরতে পছন্দ করে না? হাতে ধরে, তারপর ফড়িংয়ের থেকে আঙুলে, হাতে একটু সুড়সুড়ি খেয়ে আবার দিতাম "ব্যাটাকে'' উড়িয়ে। ফড়িং প্রিয়। তাই প্রিয় হল হেলিকপ্টার। সহজ সরল সমীকরণ। উড়তে উড়তে এক জায়গায় দাঁড়াতে পারে। বোঁ বোঁ চক্কর কাটতে পারে। আর যখন হেলিকপ্টার নিচে নাম, তখন তার পাখার হাওয়ায় উড়ে যায় ধুলো। উফ! জীবনে হেলিকপ্টার না দেখলে এত আনন্দ আর এত কল্পনা আসতো না।
সেই ছেলেবেলা থেকেই খুব প্রিয় ক্রিকেট খেলাও। খেলা তো ঠিক নয়, জীবন যেন। আর এই হেলিকপ্টারের সঙ্গে সঙ্গেই জড়িয়ে গেল ক্রিকেট। কীভাবে? সেটাই তো বলছি - ক্রিকেট মাঠে হ্যানসি ক্রোনিয়ে আমার বেশ প্রিয় ছিলেন। ভালো লাগতো খুব। ভারতীয় নন, হলেনই বা দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষ। তাঁকে ভালোলাগতো। ভালোবাসতামও। কিন্তু এসে গেল সেই দিনগুলো। ক্রিকেট আর বেটিং যখন হয়ে উঠল একেবারে সমার্থক। তারপর একদিন নির্বাসিতও হয়ে গেলেন ক্রোনিয়ে। মন খারাপ লাগত। হ্যানসি অন্তত চোখের জল মুছতে মুছতে তাঁর দোষটা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। অত কষ্টের মধ্যেও নায়কের অমন নায়কোচিত কাজের জন্য ভালো লাগা বাড়িয়ে দিয়েছিল। এসেছিল, সহানুভূতিও। কীভাবে এই নোংরা গোলকধাঁধায় জড়িয়ে গিয়েছিলেন মানুষটা ভেবে। কিন্তু তখন কীভাবে জানবো যে, ওর থেকে আরও অনেক বেশি মন খারাপের বাকি রয়েছে। একদিন সেই বুক ফেটে যাওয়া খবরটা পেয়েও গেলাম। হ্যানসির হেলিকপ্টার ভেঙে পড়েছে। মানুষটা বেটিংয়ে যুক্ত। সে প্রমাণিত দোষী। তবু, অনেক ভালোলাগা দিয়েছিলেন। সেটাকে ভুলি কীভাবে! তাই মাঠে না দেখতে পারলেও, পৃথিবীটায় তো ছিলেন। কিন্তু অপঘাত বোঝালো, দোষের শাস্তি বড় নির্মম হয়। বড্ড নির্মম। তাই তো প্রিয় হ্যানসি আর বাঁচলোও না পৃথিবীটায়। কিন্তু আমার মনের পৃথিবীতে হ্যানসি আজও আছেন। রোজ খেলেন। আমায় ভালোলাগা দেন। আর প্রিয় হেলিকপ্টারটা সেই ঘটনার পর থেকে আমার কাছে হয়ে উঠেছিল অপছন্দের। ও হ্যানসিকে নিয়ে নিয়েছে যে!
সেই হেলিকপ্টার আবার জীবনে এলো ২০০৩ এর পর থেকে। ক্রিকেট মাঠেই। মহেন্দ্র সিং ধোনি নামের এক সদ্য তরুণের হাত ধরে। তখন মাহি রোজই মাঠে নামলে দেখা যেত হেলিকপ্টার শট। আর ছক্কা মেরে ম্যাচ ফিনিশ! হ্যানসিকে মেরে ফেলা হেলিকপ্টার আবার আমার জীবনে ভালো হয়ে দেখা দিল। ধোনি আর হেলিকপ্টার হয়ে উঠল সমার্থক শব্দ। আর ভালোলাগার। ধোনি অনেক রান করলেন না কম রান করলেন জানার দরকার নেই। শুধু দেখার আশায় বসে থাকতাম, আজও থাকি, ওই একটা শটের জন্য। হেলিকপ্টার। ব্যাটটা ওরকম হেলিকপ্টারের পাখার মতো ঘুরিয়ে মারটা যে কী ভালো লাগে। তাহলে কী দাঁড়ালো? প্রিয় হেলিকপ্টার ভালো থেকে খারাপ হয়ে গেল, হ্যানসির মৃত্যুর পর। সেই হেলিকপ্টার আবার মনে জায়গা ফিরে পেল মহেন্দ্র সিং ধোনির জন্য।
আর সেই হেলিকপ্টারকে এবার জীবন থেকেই বাদ দিয়ে দেব। ভেবেছিলাম, পুজোর মধ্যে বা পরপর একবার হেলিকপ্টারে করে কাছে-পিঠে কোথাও ঘুরে আসবো। এখন খুব কম টাকায় এই সুযোগ সুবিধা তো সবাই পান। তাহলে একবার হেলিকপ্টারেও চড়ে নিই। তাহলে মোটামুটি সব যানেই চড়া হয়ে যাবে। কিন্তু গতকালের পর থেকে হেলিকপ্টার শব্দটাই জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিতে চাই। কারণ, শাকিব আল হাসান। আমি ব্যক্তিগতভাবে এদেশী মানুষ। গোটা জীবনে একবারও বাংলাদেশে যাইনি। কিন্তু বাংলাদেশকে বড় ভালোবাসি। কারণের তালিকা ইয়া লম্বা। কিন্তু বলার জন্য একটাই যথেষ্ঠ। বাংলা ভাষা। এই ভাষাটা ছাড়া আমি কে? আমার অন্য কোনও ভাষায় দখল নেই। কারণ, বাকিরা কেউ আমায় কোনওদিন টানেনি। আর এই বাংলা ভাষাটাকে বাঁচিয়ে রাখা হোক, স্বীকৃতি দেওয়া হোক, সবকিছুই যে বাংলাদেশের অনেক অনেক বেশি। এইসব কারণেই বাংলাদেশ প্রীতি আমার আছেই। সে দেশের ক্রিকেট নিয়েও। আশরাফুল যখন অস্ট্রেলিয়ার বোলিংকে তছনছ করতেন, বাঙালি হিসেবে গর্বে বুকটা ভরে উঠতো। আজ সৌম্য সরকার যখন এমন দুর্দান্ত ফিল্ডিং করেন, তখনও বুকটা ভরে ওঠে বাঙালি হিসেবেই। ভাবিই না, ওটা আমার দেশ কিনা। জানি, ওটা আমার জাতি। বাঙালি।
আর সেই বাঙালি ক্রিকেটারদের মধ্যে শাকিব যে কতটা ভালোলাগার কী করে এত অল্প কথায় বোঝাই। এক বাঙালি ক্রিকেটার বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার। কতটা গর্ব হয় বলুন তো! বিশ্বের বহু মানুষের স্ত্রীদের দেখেছি, কিন্তু শিশিরের থেকে 'সুন্দরী বউ' কখনও কাউকে লাগেনি। বাড়িতে, বন্ধু-বান্ধবদের কতবার বলেছি সে কথা যে, শাকিব আর শিশির পৃথিবীর সেরা কাপল। ওঁদের দুজনকে বড্ড ভালোবাসি। শাকিব তো আমাদের কলকাতা শহরেরও। সেই শাকিব আর শিশির কিনা কাল মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলো ! আবার সব পণ্ড করে দিচ্ছিল সেই হেলিকপ্টার। মাত্র ঘণ্টা খানেক আগে পড়ে! মাত্র দেড় কিলোমিটারের মধ্যে একই হেলিকপ্টার ভেঙে পড়ে মারা গেলেন একজন! চারজন মারাত্মক জখম! ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, অন্তত অক্ষত শাকিব আর শিশির। কিন্তু প্রাণ যে গেলই একজনের। খারাপ লাগা তাই থেকেই গেল। একটা শপথ নিয়েই নিলাম তারপর থেকে, এ জীবনে হেলিকপ্টারকে আর কখনও মনে জায়গা দেব না। ও বড্ড খারাপ। হ্যানসিকে নিয়ে নিয়েছে। শাকিবকে পারেনি। কীভাবেই বা পারবে। বাঙালির কলজে যে। দুদেশের মধ্যে বেড়া আছে তো কী হয়েছে। বাঙালি শব্দটার মধ্যে আর কলজেটার মধ্যে কোনও বেড়া নেই। শাকিব আর শিশির তোমরা ভালো থেকো। তোমাদের ফুটফুটেটাও।
আরও পড়ুন গব্বর শুধু গোঁফে তা দিয়ে কাটিয়ে দিলেন আর গম্ভীর ভালো খেলেও বাইরে থেকে গেলেন