বাঙালির হাসির আজ মৃত্যুদিন, স্মাইলি দিয়ে কী আর হাসি বাঁচে!
স্বরূপ দত্ত
আজ ১০ সেপ্টেম্বর। সেই সক্কাল থেকে মনটা বড্ড খারাপ। ঘুম থেকে উঠে চায়ে চুমুক, সামনে খবরের কাগজ আর মুখে সিগারেট নিয়ে অনেকক্ষণ ভাবলাম। কীভাবে কাটাবো আজকের দিনটা? মানে খুব হাসব নাকি মুখটা করে রাখব গোমরাথেরিয়াম। হবো চিল্লানোসোরাস নাকি খুব খেয়ে হ্যাংলাথেরিয়াম? ভেবে-ভেবে দিনটাই কেটে গেল। কিন্তু সিদ্ধান্তে আসতে পারলাম না সন্ধে পর্যন্ত। দিনটা গেল সেই গতানুগতিক। অবশ্য ভুল বলা হল সামান্য। কারণ, মনটায় বিষাদ লেগেই ছিল। ভূমিকা এটুকুই থাক। এবার আসি প্রসঙ্গে।
আপনি বুঝতে পেরেছেন তো কেন মনটা খারাপ? ওই যে তারিখটা ১০ সেপ্টেম্বর যে। বাঙালির হাসির মৃত্যুদিন তো আজই। হ্যাঁ, সুকুমার রায় আজকের দিনেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। সালটা ছিল ১৯২৩। এই পৃথিবীতে এসেছিলেন ১৮৮৭ সালে। কাটিয়ে গিয়েছিলেন জীবনের ৩৫ টা বছর! হ্যাঁ, মাত্র ৩৫ বছরের জীবনে বাঙালিকে দিয়ে গিয়েছিলেন জীবনের সবথেকে মূল্যবান উপহারটা। 'হাসি'। কেন যে সৃষ্টিশীল মানুষেরা এত তাড়াতাড়ি পৃথিবীটা ছেড়ে চলে যান, মাথায় ঢোকে না। সুকান্ত ২১ বছর। বিবেকানন্দ ৩৯ বছর। সুকুমার ৩৫ বছর। আমরা ১০০ বছর বাঁচা লোকগুলোকে নিয়ে কত কত আলোচনা করি। আমার আলোচনা তো শেষই হয় না সুকুমার রায় আরও অন্তত ৩০টা বছর বেঁচে থাকলে কী করতেন। কত হাসাতেন। একটা চরিত্র দিয়ে গিয়েছেন। 'পাগলা দাশু'। আজও সে ওই ক্লাশ ফোরেরই ছাত্র যেন।
বাঙালির বইয়ের তাকে লাখো বই থাকুক, কিন্তু দেরাজে একটা আবোল তাবোল না থাকলে বুঝতে হবে, বইপ্রেমী মানুষটার সব থাকতে পারে, মনে রসিকতাটাই নেই। বাবা বলতেন, সুকুমার রায়কে না পড়লে হাসতে শেখা যায় না। কী ভালো বলতেন। পরে বুঝেছি, আমার জীবনে হাসিও শুরু করেছেন সত্যজিতের বাবা। আমার জীবনে কল্পনাশক্তির বিকাশও ঘটিয়েছিলেন সুকুমার রায়। আবোল তাবোলের পাতায় আহ্লাদে আটখানা হওয়ার ওই ছবিটা না দেখলে যে আমার আর কল্পনাপ্রবণ মানুষ হয়ে ওঠা হতো না। একটা শরীরকে আটটা টুকরো করে আহ্লাদে আটখানা হওয়া বুঝিয়েছিলেন সুকুমার রায়। একি কোনওদিনও ভোলার?
দাশুর কীর্তি না পড়লে, বন্ধু কী হয় জানতামই না। একটা ছেলে ভারী বজ্জাত। কিন্তু তার উপর মায়া জন্মায় কীভাবে, সেই সেন্টিমেন্টাল সুড়সুড়িগুলো বুঝতে শিখে গিয়েছিলাম সুকুমার রায়কে পড়তে পড়তেই। সত্পাত্র না পড়লে কী আর চরিত্রবান মানুষ হওয়ার দৃষ্টান্ত পেতাম! নাকি মানুষ ঠিকানা জানতে চাইলে কীভাবে বলতে হয়, সেটা বুঝতে পারতাম! আমি রোগা তাই আমাকে ল্যাগবাগার্নিশ বলা হচ্ছে, এটাও বোঝা যে তাঁর লেখা থেকেই। জল চাইতে গেল কী হ্যাপায় পড়তে হয়, অবাক জলপান না পড়লে আর বোঝা হত না। আর বোঝার কথাতেই মনে পড়ল, বুঝিয়ে বলার কথা। ও শ্যামাদাস আয় তো দেখি, বোস তো দেখি এখানে..। চিরকালীন সব লেখা, ভাবনা। আমার দাদু পড়ে হেসেছেন। আমার বাবা পড়ে হেসেছেন। আমি পড়ে হেসেছি। আর এখন আমার সন্তান পড়ে হাসছে। কাল আমার সন্তানের সন্তানও সুকুমার রায় রচনা সমগ্র পড়ে একইরকম হাসবে। আর প্রশ্নটা এখানেই।
সমাজ প্রতি বছরে কতটা করে বদলে যায়। কিন্তু ১০০ বছর ধরেও সুকুমার রায়ের হাসির মুগ্ধতা থেকে বেরোতে পারেনি বাঙালি। চার প্রজন্মের মনে থাকা একটা জিনিস। তাঁদের কাছে শ্রদ্ধার থাকা এক জিনিস। কিন্তু চার প্রজন্মকে হাসতে হাসতে লুটিয়ে ফেলা নিজের লেখা আর কল্পনা শক্তি দিয়ে, এটার জন্যই হাসতে হাসতে প্রণাম তাঁকে আরও একবার। তাঁকে নিয়ে কী বলার আর শেষ আছে। কিন্তু ওয়েবসাইট যে অত লেখার জায়গা নয়। তাই শেষ করার আগে বলার। এই পৃথিবী এখন প্রযুক্তি নির্ভর। এখন মানুষ হাসে কম। স্মাইলি ব্যবহার করে বেশি। ভাগ্যিস সুকুমার রায় আজ পৃথিবীতে নেই। থাকলে মানুষটা বড় কষ্ট পেতেন। মুখের হাসি কীভাবে স্মাইলি নামক একটা চিহ্নতে বদলে গেল দেখতে পেয়ে। আজকের প্রযুক্তির স্মাইলিগুলো পাল্টে যাচ্ছে প্রতি ছ'মাসেই। সুকুমার রায় যেখানে রয়েছেন, সেখান থেকেই চওড়া হেসে আমাদের মানুষ না বলে রামগরুরের ছানা বলছেন হয়তো। ঠিকই বলছেন।
আরও পড়ুন এত যে BMW-এর বিনিয়োগের কথা শুনলেন, জেনেই নিন BMW সম্পর্কে অজানা সব তথ্য