জয়া সর্বজয়া, চোখের জলে ট্রোফি জিতলেন কৌশিক
শর্মিলা মাইতি
ছবির নাম- বিসর্জন
রেটিং- ****1/2
এ বিসর্জনের বোধনই হল সঙ্গীত পরিচালকের অকালপ্রয়াণ দিয়ে! এ বিসর্জন তবে কার? যদি ধরে নিই ভালবাসলে সব নারীই হয়ে যায় নরম নদী, নাকি অতল সমুদ্র? যে সমুদ্রের তীর বেয়ে পাগলপ্রায় জলোচ্ছ্বাস, অন্তঃস্থলে অপূর্ব স্থিতি। সেই স্থিতিতেই যেন ঘুমিয়ে আছে এ নারীর আবেদন।
অন্য কেউ হলে এ ছবি নির্ঘাত্ পুজোর আগে রিলিজ করতেন। পুজোর মরশুমে বোনাস পকেটে ঢোকে দর্শকের, সেটা শুধু কারণ নয়, ছবির বুকে বাজছে বিসর্জনের বাদ্যি। কিন্তু পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলি শুভ নববর্ষেই শুভ বিজয়া জানালেন। হতে পারে এটাই বিজনেস ট্যাকটিক্স।
কিংবা, শুভস্য শীঘ্রম। প্রযোজক হালখাতা খুলেছেন বিসর্জন দিয়েই। যে ছবিতে পরিচালক নিজের হৃদয় কেটে দিয়ে দিয়েছেন, যে ছবির সুরসৃষ্টি করার পর ভগবানই টেনে নিয়েছেন ভক্ত কালিকাপ্রসাদকে, সে ছবি যত তাড়াতাড়ি দর্শকের মন ছোঁয়, ততই ভাল।
পুজোর আগে প্রতি বছরই এ বাংলায় ছবি রিলিজের হুড়োহুড়ি লাগে। ছবির প্রোমোশনের ঢাকপিটুনির রকমসকম দেখলে ঢাকীরাও ঢাক বাজানো ছেড়ে তামাশা দেখতে দাঁড়াবেন! এ ছবির প্রযোজক হালখাতা খুলেছেন বিসর্জন দিয়েই।
ছবির শুরুর অংশে ইছামতীতে দুই বাংলার প্রতিমা নিরঞ্জন। অপূর্ব দোহারের কোরাস। বহুদিন পর সুরে পেলাম মাটির টান। আনন্দবেদনায় অনবদ্য সাউন্ড ডিজাইনিং। মুহূর্তে চারিত হয় দর্শকের হৃদস্পন্দনে। যে আনন্দ, যে বেদনা আসলে প্রতিবছরের অনুশীলন, তবু প্রতিবারই জলোচ্ছ্বাসের মতোই আত্মহারা। তার মধ্যেই ছোট্ট ছেলেটির রিনরিনে গলায় ছড়া শোনা যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে তার ছেলেমানুষি প্রশ্ন। “কেন” জানার ইচ্ছেতেই পরিপূর্ণ। কিন্তু তার মায়ের মন অন্যদিকে টানছে। দেখা যাচ্ছে না মায়ের পূর্ণরূপ। এ ছেলেটির সারল্য যেন দর্শকমনই। কিছুই জানে না এখনও।
ছেলেটির মায়ের হাতের সিঁদুরের রেশটুকু টেনে নিচ্ছে সাদা তুলো। পিছন ফিরে আটপৌরে শাড়ি পরা সুসজ্জিতা এক সুন্দরী জানালার পর্দা সরিয়ে দিলেন, তাকালেন জানালার বাইরে। কোথায় যেন শিরশিরিয়ে উঠল চারুলতা। বিসর্জনের দৃশ্যপট জানালাটা হাট খুলে দিচ্ছে। হুহু করে ফিরে আসছে বত্সরের স্মৃতি। আত্মবিসর্জনের স্মৃতি। ইছামতীর জলে ডুবছে মা দুর্গার মুখ।
কৌশিকের ছবিতে এমন আলতো গৌরচন্দ্রিকা আগে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এ ছবির ঠাসবুনট রচনা করেছেন পোস্টার থেকেই। নিউ থিয়েটার্সের যুগেই এমন পোস্টার তৈরি হত। জরুরি ছিল না হেডার দেওয়ার- রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন নয়। জরুরি ছিল আবহ। ইংরেজিতে যাকে বলা যায়, হিপনোটিক নস্টালজিয়া। মন দিয়ে দেখুন পোস্টারটা, নায়িকার কপালে সিঁদুরের টিপ, পলকহীন দৃষ্টি নামিয়ে তাকিয়ে আছেন নায়কের তদিকে। আলোয় উদ্ভাসিত তাঁর মুখ। যেন দেবী। নায়ক মুখ তুলে আছেন নায়িকার দিকে। এ ভালবাসা অধিকারের নয়, অপার মুগ্ধতার। মোহগ্রস্ততার। তার চোখের সজল মেঘ আর ঊজ্জ্বল রৌদ্রের কাছে বুঝি বা এ পুরুষ পরাস্ত। আঙুলসুতোয় জড়ানো পুতুল। আবিষ্ট হয়ে আছে এ নারীর অনন্যতায়।
দুর্গতিনাশিনীর অপর নামই তো জয়া। একদিন এমনই এক ছবিতে জয়া আহসানকে দেখব বলেই কি বিধাতা এমন নাম রেখেছিলেন তাঁর। নাকি বিসর্জন দেরিতেই এল পর্দায়, জয়ার অপেক্ষা ছিল বলেই। ওপার বাংলার ভাষাবন্ধ, উজাড় করে দেওয়া, সে কী শুধুই স্টার্ট অ্যাকশন কাট দিয়ে সম্ভব? মনে ভাবি, এই নায়িকা যাঁকে উপড়ে আনা হয়েছিল আবর্ত ছবিতে, ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল ঈগলের চোখে। কিন্তু এখনও তিনি নিজের দেশের মাটিরই খরস্রোতা পদ্মা। সাদা থানের, হাওয়াই চটি, কৌটোয় জমানো টাকা, বার্ধক্য়জর্জর শ্বশুর, সেলাই মেশিন, ছাপা শাড়ির পর্দার বাঁধনে যাকে আড়াল করা দুঃসাধ্য। অবাক হয়ে দেখি এ নারীর উঠোন ঝাঁট দেওয়া, উনানে রান্না করা, তার প্রতি চালচলনে যেন দর্পিত পল্লিগ্রাম। যাকে বিস্মৃত করার চেষ্টা হচ্ছে রুপোলি দুনিয়া থেকেও। এমনকি সাহিত্যের কলমও ব্রাত্য করে রাখে যাদের। শেষ তাকে দেখেছিলাম বিভূতিভূষণের রচনাবলী পাতায়, অক্ষরের আলপথ ধরে সে নারী হেঁটে চলে। কাঁটাতারের ওপারের মৌরীফুল। যাদের বুকের ভিতর সবসময়েই বয়ে চলে নদী। কখনও চোখের জলের, কখনও করুণার, কখনও লাস্যের। কখনও সন্তানস্নেহের। যাদের মায়াপাশে পুরুষ আজও বশ। নতমস্তক।
জয়া অভিনয় করলেন এমনই এক নারীচরিত্রে যিনি বিসর্জনে সর্বজয়া। গণেশ মন্ডল সেই পুরুষ, পদ্মা নদীর মাঝি হতে চান। তপস্বীর মতো একনিষ্ঠ, তাই কুণ্ঠিত। আবার একটু সুযোগ পেলেই চটিজোড়া খুলে টুক করে ঢুকে পড়েন পদ্মার অন্দরমহলে। আবার কখনও অপ্রস্তুত, শালীনতার লক্ষ্মণরেখা টপকে পদ্মার বিরাগভাজন হতে চাননা। এলাকায় গণেশ মণ্ডলের সে বলে, বিপদে পড়লে কিন্তু আমারে জানাইতে লেট করবেন না। সে সাধারণ প্রেমিক পুরুষ, যাকে সিনেমা-থিয়েটারও আলো দেয় না। জানে এই উপেক্ষাই তার সম্বল, তবু তরী নিয়ে অপেক্ষা করে। বাড়তে থাকা বয়স, চলতে থাকা সময় কোনও কিছুই হার মানাতে পারে না এই অপেক্ষাকে। পদ্মাকে সে সর্বসুখ দিয়ে ঘরে আনতে চায়, পৌরুষ দিয়ে জয় করতে চায় না সে। এই চরিত্রচিত্রণ কৌশিকের নিজের, আরও একটু তলিয়ে দেখলে বিসর্জনের নায়ক আসলে তিনিই, পোস্টারে নামাঙ্কন ও প্রতিকৃতি না থাকলেও। লুকিয়ে ট্রোফিটা জিতে নিয়েছেন নায়কের। যে আহত সুন্দর যুবককে বিধবা পদ্মা টেনে আনল তার জীবনডাঙায়, সে আসলে থেকে গেল পার্শ্বচরিত্র হয়ে। ছবিতে আবীর বেশিরভাগ সময় জুড়েই অসুস্থ। পদ্মার আশ্রিত। লোক জানাজানির ভয়ে তাকে প্রাণপণ আড়াল করার চেষ্টায় তাকে বাংলাদেশি টান শেখায়। ভোলা যায় না সেই দৃশ্য, নিজের কিনে দেওয়া সিগারেটের ধোঁয়াটুকু প্রাণপণ টেনে নিচ্ছেন জয়া, দরজার আড়াল থেকে। নিঃশ্বাসে সজীব হচ্ছে মৃত স্বামীর স্মৃতি। গাল বেয়ে নামছে অশ্রুধারা..
এমন কত দৃশ্যই লেগে রইল চোখের পাতায়। সেই ক্লাইম্যাক্স দৃশ্য। চিরতরে চলে যাওয়ার আগে আবীরকে নাগপাশে জড়িয়ে ফেলতে চায় পদ্মা। কপালে লাল সিঁদুরটিপ, অঙ্গে উঠেছে ছাপা শাড়ি। ঘুমের ওষুধের নেশা তাকে আরও মোহগ্রস্ত করে, শরীর জুড়ে যৌনতার নিবিড় ডাক। পৃথিবীর যে কোনও পুরুষ নত হবেন এই নারীর অনুন্মুক্ত নাভির কাছে। হলফ করে বলতে পারি, এমন ভাসিয়ে দেওয়া ফোরপ্লে দেখিনি কোনও ছবিতে। এই দৃশ্যে আবীর মনে দাগ দিয়ে যাবেন। পারবেন না ভুলতে।
খুব কম ছবি, খুব কম পরিচালকই পারেন নারীর গহিন সমুদ্রে ডুব দিতে। সত্যি বলতে কি, কখনও কখনও ডুবুরির কাজটা এত যত্ন নিয়ে করেছেন কৌশিক যে, সময়ে সময়ে বিসর্জন-কে থ্রিলার মনে হয়। তার অনুচরকে কাজে লাগায় চরবৃত্তিতে। প্রায় উপগ্রহের মতো চোখেচোখে রাখা জয়ার গতিবিধি। সে সব দৃশ্য আর বিশদে না-ই বা বললাম। এমন প্রেমিককে সচরাচর বাংলা ছবির পরিসরে জায়গা দেওয়া হয় না। কখনও সিকি, কখনও আধুলি বর্ণনাতেই বেঁধে দেওয়া হয়। এই ভয়ে যে, দর্শক বুঝি পয়সা খরচ করে দেখতে আসবেন না। এখানে সে পুরুষের অপেক্ষা সার্থক, সে পুরুষ তার কাঙ্খিত নারীর হাত স্পর্শ করে সেদিনই, যেদিন সে নারী তার হয়। সব সংশয়, দোটানার বাধা কাটিয়ে। সংক্ষেপে বলা ভাল, এ ছবিতে কৌশিক গাঙ্গুলি যা করে দেখালেন তাকে কোনওমতেই অভিনয় বলা চলে না। যেসব সংলাপ তিনি অনায়াসে বলে চললেন, তা বাস্তবে কোনও নারীর প্রেমে না পড়লে বলা সম্ভব নয়। এমন প্রেম যা পাওয়ার জন্য ব্যাকুলতা আছে, আকুতি আছে, জানা আছে পাওয়া হয়ত যাবে না এ জীবনে... আসলে জয়া আর কৌশিকের দৃশ্যগুলোয় তাঁদের স্বতঃস্ফূর্ততা স্ক্রিপ্টেড হতে পারে না। যাঁরা দেখবেন, তাঁরা মিলিয়ে নেবেন।
পদ্মাই জয়ী। কারণ সে দুর্বার, দুঃসাহসী। সাদা থানের খোলস ছেড়ে অন্য জীবনে যাওয়া, এক পুরুষকে মনের সমুদ্রে সলিল-সমাধি দিয়ে অন্য পুরুষের সঙ্গে ঘরে পা রাখার সিদ্ধান্ত তো তিনিই নিলেন। কোনও পুরুষ তো তার হাতে অস্ত্র তুলে দেননি। কিন্তু কার বিসর্জন হল? কেই বা শূন্য় হৃদয় ভাসিয়ে দিল ইছামতীর জলে? কে পেল আর কে হারাল? কয়েক বছর বাদে ছেলের গায়ে ফুটে ওঠা জন্মচিহ্ন কী রায় দিয়ে গেল? সে সব প্রশ্ন তর্কের জন্য তোলা থাক। মনকেমনটা রইল কৌশিক গাঙ্গুলির জন্যেই। জাতীয় পুরস্কার তাঁর প্রতি বছরের ভিকট্রি স্ট্যান্ড। এ ছবি দিয়েই আসলে তিনি অগোচরে নাম লেখালেন। কালোত্তীর্ণ হওয়ার খাতায়।
হয়ত আট-দশ দশক পরে পৃথিবীর কোনও এক কোণে সিনেমা-উত্সুকরা আলোচনা করছেন বিসর্জন নিয়ে। হয়ত তখন ইহলোকে নেই জয়া, আবীর, কৌশিক, কলাকুশলীরা..
সেই দিনটিই কি প্রাণ খুলে বলার দিন- শুভ বিজয়া!