নিজস্ব প্রতিবেদন : অতনু ঘোষের পরিচালনায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের 'ময়ূরাক্ষী' ছবিটি জাতীয় পুরস্কার পায়। যে ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্রের নাম ছিল সুশোভন। রবিবার, ১৫ নভেম্বর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে নানান কথা উঠে এল পরিচালক অতনু ঘোষের কথায়। ৫০ এর দশকে তাঁর প্রথম ছবি 'অপুর সংসার' থেকে ২০২৭তে এসে 'ময়ূরাক্ষী', প্রতিটি দশকে বিভিন্ন ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কীভাবে সকলের কাছে উদাহরণ হিসাবে থেকে গিয়েছেন, তা নিয়েই বিভিন্ন কথা বললেন পরিচালক অতনু ঘোষ। 


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক অতনু ঘোষ বলেন, ''অনেকেই বলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় যেন জীবনকে চিনিয়ে দেয়। আসলে যেসব বৈশিষ্ট্যের বলে একজন অভিনেতা অসামান্য হয়ে ওঠেন, সেই প্রখর বোধ, মানসিক একাগ্রতা, শৈলীর উপর দখল, সেসব ওঁর প্রভূত পরিমানে ছিল। তারসঙ্গে আরও একটা বিশেষত্ব ছিল, সেটা ওঁর অসাধারণ জীবনদর্শন। আমরা যদি ওঁর কেরিয়ারের এক এক দশক থেকে এক একটা ছবি বেছে নি তাহলে হয়ত অসামান্য যাত্রার কিছু হদিশ পাওয়া যাবে। যেমন অপুর সংসার, ৫০ এর দশক। বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে একেবারেই নতুন একটা ধারা। এত সহজ, স্বতঃস্ফুর্ত, সেটাই তখন সিনেমার জন্য উপযুক্ত বলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বীকৃতি পাচ্ছে। সেটাই ফুটে উঠেছে ওঁর অভিনয়ে। অথচ ওঁর প্রথম ছবি ওটা।


আরও পড়ুন-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে শোকপ্রকাশ বাংলার চলচ্চিত্র জগতের শিল্পীদের


এরপর ৬০ এর দশক, চারুলতার অমল, যে সময় সত্যজিৎ রায় ছবিটা তৈরি করছেন, তার থেকে অন্তত ৬০-৬৫ বছর আগের সময়ের একটা চরিত্র। আমরা সবাই জানি, এর জন্য সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজের হাতের লেখাই পাল্টে ফেলেছিলেন। বেশ কঠিন কিছু প্র্যাকটিস, ডিটেলের সংযোজন, তারপরেও অভিনয় ঝরঝরে, প্রণোবন্ত। এরপর যদি ৭০ এর দশকে আসি, অশনি সংকেতের গঙ্গাচরণ, বেশ জোরালো একটা চ্যালেঞ্জ। একদিকে সময়ের ঘাত প্রতিঘাত, টানা পোড়েন, অন্যদিকে চরিত্রের বিভিন্ন স্তর রয়েছে, অন্তর্দ্বন্দ্ব রয়েছে। তাঁর উপর গঙ্গাচরণ গ্রাম বংলার চরিত্র, তাঁর ভাষা, ভাবভঙ্গী, সবই চেনা ছকের বাইরে। আমরা মনে আছে অনেক সাক্ষাৎকারে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, তাঁর অভিনয় ধারা অনেকবার নতুন বাঁক নিয়েছে। এইরকমই একটা মোর, ৮০র দশকে কোনির সাঁতারের কোচ ক্ষিদ্দা চরিত্রে। যে ক্ষেপে গিয়ে বাঁশ নিয়ে তাড়া করে, আবার তুমুল আবেগে ছাত্রীকে বলতে পারে, ফাইট কোনি ফাইট। এবার আমরা যদি ৯০ এর দশকে আসি, হুইলচেয়ার, পরিচালক তপন সিনহা,র ছবিতে তাঁর যে ডাক্তারের চরিত্র, সেটাও বেশ জটিল। ওই চরিত্রে তিনি বাইরে থেকে কঠিন, আবার ভিতর থেকে একেবারে অন্য মানুষ। এই যে ভিতর ও বাইরের অন্তর্দ্বন্দ্ব, তার মধ্যেও কিন্তু নিজের লক্ষ্যে একেবারে স্থির এই চরিত্রটি। নিজস্ব জীবন দর্শন নিয়ে প্রত্যেকটি চরিত্রকে আলাদা মাত্রা দিতেন বলে কখনওই কিন্তু চরিত্রগুলি বাঁধাধরা গতের মধ্যে পড়ত না। 



২০০০ থেকে ২০১০ এর মধ্যে যদি আসি, অসাধারণ কাজ গৌতম ঘোষের দেখা ছবিতে। সেখানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একজন বোহেমিয়ান কবি, খুব সম্প্রতি গ্লুকোমায় অন্ধ হয়ে গেছেন, রীতিমত ধূসর তাঁর মানসিক স্তর। সেই মানুষটা অস্থির, অশান্ত, বেপরোয়া। আবার খুবই সেনসেটিভ, খুব অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন একজন মানুষ।


এবার ২০১০ থেকে ২০২০-র মধ্যে ময়ূরাক্ষী ছবিতে আবার নতুন করে সবাইকে চমকে দিলেন তিনি। একদিকে এক মানুষ যাঁর প্রভূত শিক্ষা, জ্ঞান, মেধা, মনন, একেবারে কানায় কানায়। আবার সেইরকম একজন মানুষই স্মৃতি হারিয়ে ফেলছেন। যার ফলে তাঁর একটা অদ্ভুত মানসিক অবস্থা। আমাকে বহু সমালোচক বলেছে, এই ছবিতে উনি ভীষণ রকম আধুনিক। অভিনয় শৈলীর বিষয়ে একেবারে আন্তর্জাতিক। এটা হয়ত বলার অপেক্ষা রাখে না, অভিনয় শিল্পের যাঁরা ছাত্র, বা অভিনয়ের প্রতি যাঁদের আকর্ষণ আছে, তাঁদের বারবার ফিরে আসতে হবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। কারণ, এমন উদাহরণ পাওয়া সত্যিই দুর্লভ। যেকোনও অভিনেতা যিনি সুদীর্ঘ ৬১ বছরের কেরিয়ারে বারবার নিজেকে ভেঙেছেন, আবার নতুন পথে হেঁটেছেন, কখনও থেমে যাননি। এটা একটা মস্ত বড় বিষয়।''