রণিতা গোস্বামী


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

১৯৮৪ সালে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস অবলম্বনে 'ঘরে বাইরে' ছবিটি বানিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। ছবিটি বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি মাইলস্টোন বলা যেতে পারে।  বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে 'ঘরে বাইরে' উপন্যাস অবলম্বনেই ফের একবার এই ছবি বানিয়ে ফেলেছেন পরিচালক অপর্ণা সেন। ছবির নাম 'ঘরে বাইরে আজ'। সময়ের প্রেক্ষিতে ও চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে এই ছবিতে বিমলা বদলে বৃন্দার রূপ পেয়েছে। যে চরিত্রে দেখা যাবে মেদিনীপুরের কাঁথির মেয়ে তুহিনা দাসকে। তুহিনার কাছে এটাই প্রথমবার কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়। 'ঘরে বাইরে আজ'-এ কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন? Zee ২৪ ঘণ্টা ডিজিটালের সঙ্গে ছবি ও শ্যুটিংয়ের নানান মুহূর্ত নিয়ে খোলামেলা কথা বললেন তুহিনা। 


'ঘরে বাইরে আজ' ছবিটা তো রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস 'ঘরে বাইরে' অবলম্বনে তৈরি, রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে থেকে এই ছবির গল্পটা কতটা বদলেছে?


তুহিনা : দেখো, রবীন্দ্রনাথের মূল উপন্যাস থেকে ছবির গল্প সেভাবে কিছুই বদলায় নি। তবে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় 'ঘরে বাইরে' ছবি আর এই 'ঘরে বাইরে আজ' দুটো ছবির সময়ের পার্থক্য রয়েছে। সেকারণেই ছবিটির নাম 'ঘরে বাইরে আজ' রাখা হয়েছে। আজকের সামাজিক, অর্থনৈতিক সমস্ত কিছুই এই ছবিতে আজকের প্রেক্ষিতে তৈরি হয়েছে। মূল গল্পটুকু ছাড়া বাকি সমস্ত কিছুর মধ্যেই পরিবর্তন হয়েছে।


'বিমলা' চরিত্রটি ছিল, আর এখানে তোমার চরিত্রের নাম 'বৃন্দা' রাখা হয়েছে, এই দুটো চরিত্রের মধ্যে কি কোনও বদল ঘটেছে?


তুহিনা : অবশ্যই, আমরা যে বিমলাকে দেখেছি, তার সঙ্গে বৃন্দার বেশকিছুটা পার্থক্য। ট্রেলারে রয়েছে চরিত্রটির একটা সময় নাম ছিল বিমলা, সেখান থেকে বৃন্দা হয়েছে। তাই এই দুটি চরিত্র অনেকটাই আলাদা। বৃন্দা চরিত্রটি অপর্ণা সেনের হাতে তৈরি নতুন চরিত্র বলতে পারো। এখানে এই বিমলা থেকে বিম্লা, বিম্লা থেকে বৃন্দা হওয়ার যে বিবর্তন সেটা শুধু নামেই হয়েছে এমনটা নয়। এই মেয়েটির সামাজিক, তার চারপাশের মানুষজন, কথা বলার ধরণ, ভাষা, পোশাক পরিচ্ছদ, সমস্ত কিছুর মধ্যে দিয়েই একটা বিবর্তন ঘটেছে। 'ঘরে বাইরে'র তিনটে চরিত্র নিখিলেশ, সন্দীপ আর বিমলা, তিনটে চরিত্রকে আলাদা করে পাশাপাশি রেখে যদি দেখি তাহলে দেখবে সবথেকে বেশি পরিবর্তন হয়েছে বৃন্দার (বিমলা) চরিত্রে। এরপর বাকি পরিবর্তনটা সিনেমাটা দেখলে বুঝতে পারবে। (হাসি)


১৯৮৪ সালে সত্যজিৎ রায় যে 'ঘরে বাইরে' বানিয়ে ছিলেন, সেখানে বিমলা চরিত্রে ছিলেন স্বাতীলেখা সেনগুপ্তকে। আর এখানে তুমি প্রায় ওই একই চরিত্রে অভিনয় করছো। স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের সঙ্গে তোমার তুলনা হতে পারে, এমন কোনও চাপ কি রয়েছে?


তুহিনা : দেখো, দর্শকরা তুলনা করবেন কিনা জানি না, হয়তবা তুলনা করবেন, বা করবেন না। (একটু গম্ভীর হয়ে) তবে আমি আলাদা করে চাপ অনুভব করিনি, কারণ আমাদের প্রত্যেকেরই তো 'ঘরে বাইরে' দেখা। তবে এই বৃন্দা চরিত্রটা ফুটিযে তোলার জন্য আমি কয়েকটা জিনিস মাথায় রেখেছিলাম, যে রীনা দি (অপর্ণা সেন) যেভাবে চেয়েছেন, সেভাবে এবং আমার নিজের মতো করে বৃন্দা চরিত্রটি তুলে ধরতে। তবে আলাদা করে চাপ অনুভব করিনি, কারণ দুটো চরিত্রের মধ্যে সেভাবে কোনও মিল নেই। এই চরিত্রটা প্রায় পুরোটাই রীনাদির (অপর্ণা সেন) মতো করে তৈরি করা। এই একটি চরিত্রেই ছবিতে সবথেকে বেশি বদলেছে।


'ঘরে বাইরে'তে দেখিছি নিখিলেশ নিজেই তাঁর স্ত্রীকে বাড়ির অন্দরমহলের বাইরে নিয়ে আসেন 'ঘরে বাইরে আজ' ছবিতেও কি নিখিলেশ ঠিক এমনই?


তুহিনা : একেবারেই। নিখিলেশ এখানেই একটা উদার মনের মানুষ। যিনি কোনও কিছুতেই বাধা দেন না, স্ত্রীকে স্বাধীনতা দেওয়াতেই বিশ্বাসী। সেই জিনসটা কিন্তু এখানেও একই রয়েছে।




এই ছবিতে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আগের ছবির থেকে কতটা বদলেছে?


তুহিনা :  দেখো রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা খুবই কম। তবে হ্যাঁ, ছবিতে একটা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট একটা তো রয়েছেই। এবিষয়ে রীনা দি (অপর্ণা সেন) নিজেই বারবার বলেছেন, তাঁর পরিচালনায় সেই অর্থে সবথেকে বেশি রাজনীতির ছোঁয়া রয়েছে বলতে যা বোঝায় সেটা হল 'ঘরে বাইরে আজ'। তবে আমার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা খুবই কম, তাই এর থেকে বেশি আমি কিছু বলতে পারবো না (হাসি)।


গৌরী লঙ্কেশ খুনের ঘটনা কি কোনওভাবে এই ছবিতে উঠে আসছে?


তুহিনা : দেখো, আমিও শুনেছিলাম ওই ঘটনাটির জন্যই রীনাদি (অপর্ণা সেন) এই গল্পটার কথা ভাবেন, বা এই ছবিটা বানানোর প্রয়োজন মনে করেছিলেন। এবিষয়ে শুধু আমি এইটুকুই বলতে পারি।


অপর্ণা সেনের সঙ্গে শ্যুটিংয়ের অভিজ্ঞতার কথা যদি বলতে...


তুহিনা : অসাধারণ অভিজ্ঞতা, (উচ্ছ্বসিত হয়ে) প্রথমেই বলতে হয়, রীনাদি (অপর্ণা সেন) একজন অসাধারণ শিক্ষক। খুব যত্ন সহকারে উনি শেখান। আমাকে শুধু অভিনয় কেন, আরও অনেক কিছুই উনি উজাড় করে শিখিয়েছেন। আমি যতটা পেরেছি চেষ্টা করেছি, রীনাদির থেকে শিখে নেওয়ার। আরেকটা বিষয় হল, রীনাদি প্রত্যেকটা চরিত্রকে খুবই আদরে যত্নে গড়ে তোলেন। উনি সবসময় চান তাঁর অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ফ্লোরে যাওয়ার আগে যেন জানেন যে তাঁদের কী করতে হবে। আমি তো খুব অল্প কাজ করেছি, তবে তা থেকেও আমার যেটা মনে হয়েছে, রীনাদি ভীষণ ধরে ধরে কাজ করতে ভালোবাসেন। এখনকার সময়ে এমন আর কেউ আছে কিনা আমি বলতে পারবো না। শুধু তাই নয়, এই গোটা টিমে যে মানুষগুলোর সঙ্গে আমি কাজ করেছি, যেমন সোহাগ সেন, ডিওপি সৌমিকদা (সৌমিক হালদার), তারপর আর্টের তন্ময়দা এবং আমার সহ অভিনেতারা, এই প্রত্যেকটা মানুষের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতাই ভীষণ ভালো। 



শ্যুটিংয়ের মজাদার অভিজ্ঞতা কি বলতে চাইবে?


তুহিনা :  দেখো, আমার বৃন্দা হযে ওঠার যাত্রাটা প্রায় মাস দেড় দুই ধরে চলেছে । রীণাদিকে (অপর্ণা সেন) আমি দেখেছি শ্যুটিংয়ের আগে লুক নিয়ে উনি ভীষণ সচেতন, উনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে লুকগুলো তৈরি করান, খুঁটিনাটি সবকিছুতেই ওনার নজর। এই অভিজ্ঞতা আমার কাছে খুব লোভনীয় ছিল। একটা মানুষ কতটা যত্নে একটা ছবি তৈরি করেন, সেটা রীণাদিকে (অপর্ণা সেন) না দেখলে আমি হয়ত জানতামই না। এছাড়া যীশুদা কাজ ও কাজের বাইরে যে কতটা আলাদা, সেটা তুমি না দেখলে বুঝতেই পারবে না। খুব মজা করে কাজ করেন। একটা সিরিয়াস দৃশ্যের আগেও দিব্যি মজা করছেন, যাতে কোনও চাপ না হয়। সবমিলিয়ে আমার শ্যুটিংয়ের অভিজ্ঞতাটাই মজার। 


তুমি শুনেছি এই ছবিতে একটা গান গেয়েছো, তুমি কি অভিনয়ের পাশাপাশি নিয়মিত গানটাও করো?


তুহিনা : গানটা আমি ছেলেবেলা থেকেই শিখেছি, তবে গান গাওয়ার মতো যে অনুশীলনের দরকার হয়, সেটা একেবারেই নেই। এটা কিছুই নয, আমি থিমের প্রয়োজনে একটা ক্লাসিক্যাল গান দুটো লাইন খালি গলায় গেয়েছি। যীশুদার সঙ্গে একটা দৃশ্য রয়েছে, সেখানে গেয়েছি। (একটু মজা করে) তোমরা যদি সিনেমাটা দেখো তাহলে বলতে পারবে কতটা খারাপ গেয়েছি। (হাসি)


যীশু না অনির্বাণ তুমি কাকে ব্যক্তিগতভাবে এগিয়ে রাখবে?


তুহিনা : দেখো দুজনেই আমার প্রিয়, একজন ব্ল্যাক বিউটি, একজন হোয়াইট বিউটি, তবে অভিনেতা হিসাবে দুজনেই অসাধারণ। ওনাদের মতো অভিজ্ঞতা সম্পন্ন দুজন অভিনেতার সঙ্গে কাজ করার বিষয়টাই আমার কাছে একটা বড় পাওনা। শুধু নিজেরাই ভালো অভিনয় করেন না, অন্যকেও ভালো অভিনয় করতে সাহায্য করেন। আমাকে প্রচুর সাহায্য করেছেন।


তোমার বাড়ি বোধহয় মেদিনীপুরে, তো সেখান থেকে কি অভিনয়ে আসার জন্যই কলকাতায় আসা?


তুহিনা : হ্যাঁ, আমার বাড়ি কাঁথিতে। ওখান থেকে পড়াশোনার জন্য কলকাতায় এসেছিলাম। তারপর পড়াশোনা করতে করতেই অভিনয়ে চলে আসি। আসলে প্রথমে আমি একটা নাটকের দলে যোগ দিয়েছিলাম, সেখান থেকে টেলিভিশনে টুকটাক কাজ, তারপর অরিন্দমদার (অরিন্দম শীল) 'আসছে আবার শবর', তারপর সৃজিতদার ছবিতে, এভাবেই অভিনয়ে চলে আসি।
প্রথম থেকে অভিনয়কেই পেশা করার ইচ্ছে ছিল?


তুহিনা : না, না একেবারেই নয়। স্কুলে অবশ্য নাটক করতাম ঠিকই, তবে অভিনয়ে আসবো একেবারেই ভাবিনি। ভালোলাগা ছিল। মনে হত, এটাই হয়ত একমাত্র পেশা যেখানে একটা মানুষ অন্য একটা মানুষ হয়ে জীবন-যাপন করতে পারে। তবে পরিকল্পনা করে কিছুই করিনি।


ঘরে বাইরে পরকীয়া দেখানো হয়েছে, তোমার চরিত্রের বাইরে বেরিয়ে একটা কথা বলো, পরকীয়া ব্যাপারটা তুমি কীভাবে দেখো?


তুহিনা : দেখো, আমাকে ব্যক্তিগতভাবে বলতে বললে বলবো, আমি কমিটমেন্টে বিশ্বাসী, কারণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা একটা ভীত। সেটায় আমি বিশ্বাস করি।


চলচ্চিত্র জগৎ বা সাধারণ সমাজেও গায়ের রং নিয়ে একটা পাগলামো রয়েছে, ফর্সা, শ্যামবর্ণা এসব বিষয় নিয়ে অনেকের বড় মাথা ব্যাথা।  কাজের ক্ষেত্রে তোমায় কি কখনও এসব নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল?


তুহিনা : দেখো, এখন সৌন্দর্যের এই সংজ্ঞাটা কিন্তু অনেক বদলে গিয়েছে। বাংলাতেই পাওলি দাম, পার্নো মিত্র সবাই প্রতিষ্ঠিত। তাই এই সংজ্ঞাটা আগেই বদলেছে, ধীরে আরও বদলাচ্ছে। তবে গায়েং রং নিয়ে কিছুই শুনিনি বললেও মিথ্যে বলা হবে। একদম প্রথমদিকে কিছুটা শুনতে তো হয়েছিলই। এইরকমও হয়েছে, যে অনেকে বলেছেন তোমার অডিশন পছন্দ হয়েছে, তবে কোন চরিত্রে কাস্ট করবো বুঝতে পারছি না? তবে এটাও ঠিক 'ঘরে বাইরে আজ' করার প্রস্তাবও কিন্তু আমি আমার লুকের কারণেই পেয়েছিলাম। রীণাদি (অপর্ণা সেন) যেভাবে বৃন্দাকে দেখেছিলেন, সেটার জন্যই আমায় বাছেন। তাই আমার এই লুকের একটা পজিটিভ বিষয়ও রয়েছে বলে আমি মনে করি। (হাসি)


তবে একজন আমায় বলেছিলেন, তুই কোনওদিন সকলের ভিড়ে মিশে যাবি না। তো, সেটা ঠিক কী করণে বলেছিলেন আমি অবশ্য জানি না। তবে আমারও মনে হয়েছে সত্যিই আমি কোনওদিন ভিড়ে মিশে যাব না। তবে এই বিষয়টা নিয়ে কোনওদিনই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগিনি। যে পরিবারে আমি বড় হয়েছি, সেখানেও এই বিষয়টা আমার ভিতরে কোনওদিনই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়নি। বরং আমি খুশি আমার এই লুকের জন্যই আমি বৃন্দার মত এমন একটা আইকনিক চরিত্র পেলাম। 



তোমাকে তো গয়নার বিজ্ঞাপনেও দেখেছি, মডেলিং নাকি অভিনয় কোনটা বেশি পছন্দ?


তুহিনা :  হ্যাঁ, দেখো আমি মনে করি না আমি কোনওভাবে মডেলিং জগতের জন্য তৈরি বলে। যদিও অনেকের কথায় আমায় মডেলদের মতো লাগে। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার অভিনয়টাই পছন্দ। আমি নিজেকে অভিনেত্রী হিসাবেই দেখতে চাই।


তোমার তো প্রথম বার লিড চরিত্র, সেই হিসাবে কেমন লাগছে?


তুহিনা : এটাতো অসম্ভব একটা বড় প্রাপ্তি আমার কাছে। একজন যে কেরিয়ার সবে সবে শুরু করেছে, তার কাছে অপর্ণা সেন, বিমলা (বৃন্দা) দুটোই বড় প্রাপ্তি ছাড়া আর কী! আমার কাছে সত্যিই এটা আশীর্বাদ।


ঘরে বাইরে আজ ছাড়া আর কি কোনও করছো?


তুহিনা : দেখো, আমি অপেক্ষা করছি। ভালো কোনও চিত্রনাট্য পেলে, বা মিনিং ফুল কিছু করার সুযোগ পেলে অবশ্য করবো। এবিষয়ে কিছু কনফার্ম হলে তবেই বলতে চাই।


আগামী ১৫ নভেম্বর মুক্তি পেতে চলেছে অপর্ণা সেন পরিচালিত 'ঘরে বাইরে আজ' ছবিটি। যেখানে রবীন্দ্রনাথের বিমলা অপর্ণা সেনের হাতে পড়ে হয়ে উঠেছেন বৃন্দা। আপাতত দর্শকরা সেই নতুন বৃন্দাকে দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন।