Haranath Chakraborty: ‘নতুনদের মধ্যে ডিসিপ্লিনের অভাব...’ অকপট হরনাথ চক্রবর্তী
Haranath Chakraborty: হাতে বাকি মাত্র কয়েকঘণ্টা, মুক্তি পেতে চলেছে পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তীর নতুন ছবি ‘ও লাভলি’। এই ছবির ইউএসপি তৃণমূল নেতা মদন মিত্র। হরনাথের হাত ধরেই অভিনয়ে ডেবিউ করতে চলেছেন মদন মিত্র। পরিচালক জানালেন, ‘শ্যুটিংয়ের মাঝে আমাকে জিগেস করতেন, এই ডায়লগটা কি যোগ করা যায়? এভাবে স্ক্রিপ্টেও যোগ করেছেন অনেক কিছু।’
সৌমিতা মুখোপাধ্যায়: উত্তম পরবর্তী সময়ে বানিজ্যিক বাংলা ছবির হাল ধরেছিলেন স্বপন সাহা, অঞ্জন চৌধুরীর মতো পরিচালকেরা। তাঁদের ব্যাটন হাতে নিয়ে এগিয়ে একসময় দর্শককে হলমুখী হতে বাধ্য করেছিলেন যিনি, তিনি কেরিয়ার শুরু করেছেন অঞ্জন চৌধুরীর অ্যাসিস্টান্ট পরিচালক হিসাবে কিন্তু তারপর তাঁর ছবিই মোড় ঘুড়িয়ে দেয় বাংলা সিনেমার। তিনি পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তী। ৬৪ বছরেও তিনি নতুন মাধ্যমে ডেবিউ করেছেন, বানিয়েছেন ওয়েব সিরিজ ‘ঘোষবাবুর রিটায়ারমেন্ট প্ল্যান’, পাশাপাশি বড়পর্দাতে আনছেন ‘ও লাভলি!’
কেরিয়ারের সবচেয়ে সুন্দর অগস্ট কী এটাই? একই মাসে মুক্তি পেল আপনার প্রথম ওয়েব সিরিজ আর নতুন ছবি?
হরনাথ চক্রবর্তী: হ্যাঁ, একই মাসে দুটো পরপর রিলিজ। তবে তা হওয়ার কথা ছিল না। সেই জামাইষষ্ঠী থেকে ‘ও লাভলি’ রিলিজের ডেট খুঁজছি কিন্তু একের পর এক বলিউডের রিলিজের কারণেই এতটা পিছিয়ে গেল। তাও এখনও বলিউডের ছবি চলছে। আগে এক একটা সিনেমা হলে তিন চারটে করে বাংলা ছবিই চলত কিন্তু এখন একটা শো পাওয়াও মুশকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমনকী মাল্টিপ্লেক্সও একাধিক শো পায় হিন্দি সিনেমা, অথচ বাংলা সিনেমা পায় না।
আরও পড়ুন- Chandrayan 3: চাঁদের মাটি ছুঁল ভারত, উদযাপনে শাহরুখ-অক্ষয় থেকে মিমি-দেব...
সিঙ্গল স্ক্রিন তো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে?
হরনাথ চক্রবর্তী: হ্যাঁ সেটা তো হচ্ছেই। সিনেমা যদি খারাপ হয়, মানুষ দেখল না, সেটা একরকম। কিন্তু সিনেমা যদি দেখানোই না যায়। সিঙ্গল স্ক্রিনগুলোতেও তিনটে শো হিন্দি ছবি নিয়ে রেখেছে।
এটা কি প্রশাসনিক ব্যর্থতা, আপনি এর প্রতিবাদে কী ভাবছেন?
হরনাথ চক্রবর্তী: দেব, কৌশিক গাঙ্গুলি যাঁরা এই সময় চুটিয়ে কাজ করছে, তাঁদের ভাবতে হবে। আমি কেউ নই ভাবার। যাঁদের পরপর ছবি আসছে, তাঁদের ভাবতে হবে। তবে মনে করি যে ভালো ছবি বানালে দর্শক দেখবে, হল শো দিতে বাধ্য হবে। বাংলা কিছু সিনেমা ‘প্রজাপতি’, ‘অর্ধাঙ্গিনী’ এগুলো তো ভালো চলছে। এখন আসলে প্রযোজকরা শহরকেন্দ্রিক অল্প বাজেটের ছবি তৈরি করছে, কমদিনে শ্যুট হচ্ছে, টাকা উঠলে ভালোই না উঠলে খুব বড় ক্ষতি হবে না। তাদেরও দোষ নেই কিন্তু হল পাওয়ার ক্ষেত্রে বম্বে থেকে কলকাঠি নাড়ছে। আমরা তো লব কুশের সময় সবাই একসঙ্গে প্রতিবাদ করেছিলাম। টানা ১৫ দিন শ্যুটিং বন্ধ ছিল। কিন্তু এখন সেই ইউনিটিই নেই। যে যার মতো গোছাতে ব্যস্ত।
খারাপ লাগে না?
হরনাথ চক্রবর্তী: ওই যেমন যৌথ পরিবার ভেঙে এখন সব ছোট পরিবার, ইন্ডাস্ট্রিও সেরকম হয়ে গেছে।
তাহলে এই যে সবাই একে অপরের সিনেমাতে এগিয়ে আসছেন, ‘বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়ান’ ডাক দিচ্ছেন?
হরনাথ চক্রবর্তী: এসব করে হবে না। ভালো ছবি বানাতে হবে। দর্শক সেরকম ছবি পেলেই হলে দেখতে আসবে। আরেকটা সমস্যা হল মোবাইল। ওটিটি আর টেলিভিশনে আমাদের পুরনো ছবিগুলোর দারুণ টিআরপি। গ্রামে গঞ্জে লোক মোবাইলেই ছবি দেখে নিচ্ছে তবে সেরকম ছবি বানাতে পারলে দর্শক হাউসে আসবে। এই যেমন ‘ও লাভলি’ বানালাম। পারিবারিক ছবি, কমেডি আছে, গান আছে, প্রেম আছে। আমাদের দুটো গান ইতোমধ্যেই হিট। এখন ছবি মুক্তির পর দেখা যাবে।
আরও পড়ুন- Sariful Razz | Pori Moni: ‘আমার ও পরীর মধ্যেকার সমস্যা মেটাতে গেলেই...’ বিরক্ত রাজ!
আপনি একের পর এক ছবি করেছেন রঞ্জিত মল্লিক, প্রসেনজিৎ, জিতের সঙ্গে। এখন নতুনদের সঙ্গে কাজ করছেন, কোনও তফাত পান?
হরনাথ চক্রবর্তী: অনেক তফাত। নতুনদের মধ্যে ডিসিপ্লিনের অভাব রয়েছে। সেটে নিজের শ্যুটিং বাদে আড্ডা গল্প চলে। চেঁচিয়ে থামাতে হয়। আগে এরকম ছিল না। সবাই পরিবারের মতো ছিল আর কাজে ডেডিকেশন ছিল।
নতুন পরিচালকরা আপনার কাছে সাজেশন নিতে আসে?
হরনাথ চক্রবর্তী: যাঁরা আসেন তাঁদের পরামর্শ দিই। এখন এত পরিচালক, সবার ভালো করে নামও জানি না। কেউ চাইলে পরামর্শ দিই। পুরনোদের সঙ্গে দেখা হলে পুরনোদিনের গল্প করি।
প্রভাত রায় সম্প্রতি বলেন যে কেউ সেরকম খবর রাখে না, আপনার কখনও এরকম মনে হয়েছে?
হরনাথ চক্রবর্তী: আমার সবার সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক। রঞ্জিতদাকে কয়েকদিন ফোন না করলেই বলেন ‘কী হল, আপনি কি ভুলে গেলেন?’ প্রভাতদা অসুস্থ ছিলেন। আমি, প্রেমেন্দু বিকাশ চাকী একসঙ্গে গিয়ে বাঙ্গুরে ভর্তি করালাম। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাঙ্গুর হাসপাতালটা অসাধারণ বানিয়ে দিয়েছেন। সেখানে প্রভাতদার চিকিৎসা হল, সুস্থ করে বাড়ি ফেরত নিয়ে গেলাম।
আরও পড়ুন- Srabanti: মর্ত্য তো কোন ছাড়! এবার মহাকাশেও 'তারা' শ্রাবন্তী...
আপনি বলছেন আগে ঐক্যবদ্ধ ছিলেন, পরিবারের মতো ছিলেন, কিন্তু সেই সময়ে ইন্ডাস্ট্রিতে রাজনীতির শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেন অনেকেই?
হরনাথ চক্রবর্তী: এখানে একটা বিষয়ে বলা দরকার। যে জিনিস বেশি বিক্রি হয়, সেই জিনিসই সবাই দোকানে রাখতে চায়। এটাও সেই রকম যে হিরো বেশি হিট দেয় তাঁকে নিয়েই পরিচালকেরা কাজ করতে চায়। একজন হিরো যদি হিটের পর হিট দেন, তাহলে তো তাঁকে নিয়েই লোকে কাজ করবেন। এটাই তো স্বাভাবিক। যাঁরা বলেছেন, তাঁরাও তো সেই সময় হিরো হয়ে কাজ করেছেন।
২০১৯ থেকে ২০২৩, মাঝে এই সময়টায় আপনি ছবি করেননি...
হরনাথ চক্রবর্তী: না, ছবি করেছি। আমার তিনটে ছবি তৈরি হয়ে পড়ে আছে, সেগুলো খুব তাড়াতাড়িই মুক্তি পাবে।
রাজ চক্রবর্তীর সঙ্গেই আপনার ওয়েব সিরিজ মুক্তি পেয়েছে। অনেকেই বলছেন রাজকে আপনি টেক্কা দিচ্ছেন?
হরনাথ চক্রবর্তী: না না (হাসি), টেক্কা দিচ্ছি না! সুরিন্দর ফিল্মসের তরফ থেকে ওয়েব সিরিজটার অফার পাই, ‘ঘোষবাবুর রিটায়ারমেন্ট’। রঞ্জিত মল্লিক নিয়ে তৈরি করেছি। যারা দেখেছেন, ভালোই বলেছেন। আমার স্টোরি রাইটার মনোজিৎ লাহিড়ী, ডিওপি, আমার ছেলে হিন্দোলও ছিল, গোটা টিম সাহায্য করেছে। টানা ১৪ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে শ্যুট করতাম। তাছাড়া সেই ‘শত্রু’ থেকে রঞ্জিতদার সঙ্গে কাজ করছি, তখন আমি অ্যাসিস্টান্ট ডিরেক্টর ছিলাম। তাই রঞ্জিতদার সঙ্গে আমার একটা বোঝাপড়া আছে, আমরা একে অপরকে বুঝতে পারি। সেটা বুম্বাদার সঙ্গেও আছে।
আপনার ছেলে তো ছবি পরিচালনা করছেন, ওঁর ছবি কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও দেখানো হয়েছে...
হরনাথ চক্রবর্তী: ও একটু অন্যরকম ভাবে। এই জেনারেশন যেরকম ছবি দেখতে পছন্দ করে, সেরকমভাবে। আমরা একসঙ্গেই কাজ করি। কাল রাত্রেই একটা গল্প শোনালো, আমারও ভালোই লেগেছে।
‘ও লাভলি’ মুক্তি পাচ্ছে, এই ছবিতে মদন মিত্রকে কেন নিলেন?
হরনাথ চক্রবর্তী: আমি বাম আমলে প্রতীম চ্যাটার্জিকে নিয়েও কাজ করেছি। আর মদনদা খুবই ভালো অভিনয় করেছেন। শ্যুটিংয়ের মাঝে আমাকে জিগেস করতেন, এই ডায়লগটা কি যোগ করা যায়? এভাবে স্ক্রিপ্টেও যোগ করেছেন অনেক কিছু আর ওঁর জনপ্রিয়তা। যেকোন সুপারস্টারের মতোই ওঁর জনপ্রিয়তা, যা অস্বীকারের জায়গা নেই।
উনি এত ব্যস্ত, সময় দিতে পারবেন কিনা, চিন্তা হয়নি?
হরনাথ চক্রবর্তী: প্রচণ্ড টেনশন ছিল। আমার শ্যুটিংয়ের আগের দিন থেকেই তুমুল টেনশন ছিল। আমি বললাম, ‘দাদা, আপনি বারুইপুরে একটা গেস্ট হাউজ নিয়ে ওখানে থাকুন’। আমি ভাবছিলাম যে যদি ভবানীপুর থেকে সময়ে পৌঁছতে না পারেন! উনি আমার কথামতো ওখানেই একটা গেস্ট হাউজে ছিলেন। শ্যুটিংয়ের দিন সকাল ৬টায় ফোন, ‘আমি কখন আসব?’ আমি বললাম, ‘আপনি ১১ টায় আসুন’। একেবারে সঠিক সময়ে মদনদা হাজির। শ্যুটিংয়ের সময় ফোনগুলো দিয়ে দিতেন সহকারীদের। শ্যুট শেষে আমার অনুমতি নিয়ে আবার ফোনগুলো নিয়ে নিতেন।
মানে খুবই ডেডিকেশন ছিল?
হরনাথ চক্রবর্তী: প্রচণ্ড। আর অসাধারণ মানুষ। যাঁরা মদনদাকে চেনেন তাঁরা চেনেন। দেখলাম, ঐ শ্যুটের পরেই অগুনতি মানুষের উপকার করছেন। কোনও রাজনৈতিক রং দেখেন না। কাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে, কার চাকরি নেই, কে কোন বিপদে পড়েছে, সবাইকে সাহায্য করেন।
এখন কোনও প্রযোজক আপনাকে খোলা অফার দিলে আপনি কী বানাবেন- ফিচার ফিল্ম নাকি ওয়েব সিরিজ?
হরনাথ চক্রবর্তী: আমি ছবি বানাতে চাইব। আসলে ওয়েবসিরিজও ছবি, ওটা মোবাইলে দেখা হয়। তবে ছবি বড়পর্দাতে দেখার যে আনন্দ, সেটা আলাদা। তাই ছবিই বানাব।
ঘোষবাবুর রিটায়ারমেন্ট প্ল্যান তো করলেন, হরনাথ চক্রবর্তীর এরকম কোনও প্ল্যান আছে?
হরনাথ চক্রবর্তী: আমি কাজ করে যেতে চাই। কাজের মধ্যে দিয়েই বাঁচতে চাই। এখনও ভালো কাজ করার চেষ্টা করছি, যেটা দেখে যেন আমি পরের ছবির অফার পাই। কোনও রিটায়ারমেন্ট নয়, সেটে কাজ করতে করতেই যেন চলে যেতে পারি, এটাই চাই।