ফিল্ম রিভিউ: সেকুলার বনাম হিন্দুত্ব- অপর্ণার `ঘরে বাইরে আজ`কের রাজনীতি
``বাইরে যা ছিল সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল, কিন্তু মনের ভিতরে যা রয়ে গেল সেগুলোকে পোড়াবে কেমন করে?``
রণিতা গোস্বামী: ''বাইরে যা ছিল সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল, কিন্তু মনের ভিতরে যা রয়ে গেল সেগুলোকে পোড়াবে কেমন করে?'' বিমলার উদ্দেশ্যে এই প্রশ্নটাই ছুঁড়ে দিয়েছিলেন নিখিলেশ। 'ঘরে বাইরে আজ' দেখে বের হওয়ার পর যেন সেই প্রশ্নটাই মনের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। বিমলা (বৃন্দা) সত্যিই কি পারবেন মনের ভিতরে রয়ে যাওয়া, উথাল পাথাল করা ঘটনাগুলো পুড়িয়ে ফেলতে কিংবা মুছে ফেলতে? বিমলা (বৃন্দা) পারবেন কিনা জানি না, তবে 'ঘরে বাইরে আজ' দেখে বের হওয়ার পর, দেশের বর্তমান অস্তির, রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে আপনাকেও ভাবাবে সেটা নিশ্চিত।
রবীন্দ্রনাথের 'ঘরে বাইরে' পড়েছেন তো? কিংবা সেই 'ঘরে বাইরে' উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৮৪তে বানানো সত্যজিৎ রায়ের বানানো সেই ছবিও নিশ্চয় দেখেছেন। সেই গল্পেরই পুনর্নির্মাণ করেছেন পরিচালক অপর্ণা সেন। কিছুটা বদলে নাম রেখেছেন 'ঘরে বাইরে আজ'। নামের সঙ্গে ছবির প্রেক্ষাপটও বদলে ফেলেছেন পরিচালক। নিখিলেশ-সন্দীপ-বিমলা গল্পের মূল চরিগুলি এবং গল্পের মূল বুনন এক রাখলেও গল্পটিকে একেবারেই নতুন রূপে, নিজের মনের মতো করে চালনা করেছেন অপর্ণা সেন। গল্পের সঙ্গে মিশিয়েছেন নিজের রাজনৈতিক চেতনাকে। এই ছবির মাধ্যমেই বর্তমান সমাজের অনেককিছু নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন পরিচালক।
আরও পড়ুন-ঘরে বাইরে আজ: আমার লুকের জন্যই তো বৃন্দার চরিত্রটা পেয়েছি, খোলামেলা তুহিনা
রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'ঘরে বাইরে' উপন্যাস যেখানে শেষ করেছিলেন, অপর্ণা সেনের ছবির গল্প কিন্তু সেখানে থেমে যায়নি। এখানে বৃন্দা (বিমলার পরবর্তীত রূপ) প্রতিবাদে গর্জে উঠেছেন। টেনে ছিঁড়ে দিয়েছেন সন্দীপের মতো ভণ্ড, ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক নেতার মুখোশ। এছবিতে বর্তমান সমাজের প্রেক্ষিতে যদি কোনও চরিত্র সবথেকে বেশি বদলে গিয়ে থাকে সেটা হল বিমলা। 'ঘরে বাইরে'র বিমলা অপর্ণা সেনের হাত ধরে হয়ে উঠেছেন 'বৃন্দা'। বিহারের ঝরিয়ার কোল মাইন এলাকার দলিত বিমলা মাঝি ব্রাহ্মণ পরিবারে এসে বৃন্দা হয়ে উঠেছেন। তবে এই ছবিতে নিখিলেশ একটুও বদলায় নি। তাঁকে আগের মতোই মুক্তমনা, উদার হিসাবেই তুলে ধরা হয়েছে। স্বামী নিখিলেশেরই ছেলেবেলার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সন্দীপের সঙ্গে প্রেম এবং শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়ার পরও বৃন্দাকে কোনওভাবেই দোষারোপ করেননি পরিচালক। রবীন্দ্রনাথের 'ঘরে বাইরে'তে নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফিরে আসার পর শাস্তিরূপে নিখিলেশকে হারিয়ে ফেলেছিলেন বিমলা। এখানেও বৃন্দার অনুশোচনা হয়েছে ঠিকই, তবে তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাননি পরিচালক। বরং তাঁকে আরও বেশি করে প্রতিবাদী করে তুলেছেন। বৃন্দা এখানে আধুনিকা, সে সিগারেট খায়, সন্দীপকে তাঁর ভালো লাগে সেকথা স্বামী নিখিলেশকে বলতেও সে ভয় পায় না। আবার তার সাজ-সজ্জা, রুচিবোধেও মেলে আধুনিক শিক্ষিতা নারীর পরিচয়।
রবীন্দ্রনাথের 'ঘরে বাইরে'র মতোই অপর্ণা সেনের 'ঘরে বাইরে আজ' ছবিতেও নিখিলেশের পাশাপাশি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সন্দীপের চরিত্রটিও সমান আকর্ষণীয়। তাঁর ব্যক্তিত্ব, ভুল ঠিক ব্যাতিরেখে নিজের হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক ভাবাদর্শকে যুক্তির জালে সাজিয়ে বৃন্দার মনে ঢুকিয়ে দিতে তিনি একপ্রকার সফলই হয়েছিলেন। আমোঘ আকর্ষণে বৃন্দাকে প্রেমের জালে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে ফেলতেও তিনি সফল। তিনি শুধুই নিখিলেশ-বিমলার সুখী দাম্পত্যের কালো ছায়া নয়, নিজের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে বন্ধু নিখিলেশের মুক্তমনা রাজনৈতিক চেতনাকে এক ঝটকায় শেষ করে দিতেও তিনি পিছপা হন না।
সবমিলিয়ে ছবিতে নিখিলেশের হাত ধরে ধর্ম-নিরপেক্ষ ভাবনা, সন্দীপের কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক আদর্শ, হিন্দু রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন দুই মতাদর্শকেই সুন্দরভাবে মেলে ধরেছেন পরিচালক অপর্ণা সেন। এখানে 'জয় শ্রীরাম' না বলার জন্য খুন হতে হয়েছে এক মুসলিম যুবককে। আবার হিন্দু তীর্থযাত্রীদের মুসলিম জঙ্গিদের হাতে খুন হওয়ার কথা তুলে ধরতেও ভোলেননি পরিচালক। একদিকে তিনি হিন্দুত্ববাদী সন্দীপের মুখ দিয়ে হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের যুক্তি সাজিয়েছেন। আবার তাঁর নোংরা রূপকেও টেনে ছিঁড়ে দিতে ভোলেননি পরিচালক। পাশাপাশি ছবিতে সমাজকর্মী শ্বেতা, বস্তারের চিকিৎসক বিনয় সেনের চরিত্রগুলিও যেন খুব চেনা চেনা লাগে। ছবিতে সাংবাদিক নিখিলেশের মুক্তমনা তাঁর ধর্ম নিরপক্ষ রাজনৈতিক চেতনা, খুন হওয়ার ঘটনায় কোথাও যেন গৌরী লঙ্কেশের ছায়া রয়ে যায়। ছবিতে জাতীয়তাবাদকে অন্য সংজ্ঞা দিয়েছেন পরিচালক। বর্তমান সমাজে ঘটে যাওয়া ঘটনার উপর নিজের পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিদর্শনকেই ছবির গল্প প্রতিভাত করেছেন।
সব ভালোর মাঝেও কয়েকটি বিষয়ে খটকা থেকেই যায়। এই ছবিতে কলেজ পড়ুয়া ঋতব্রত, ফোনে আসা SMS- এক ঝলকে দেখেই কীভাবে তাঁর মুসলিম বন্ধুর মৃত্যু সম্পর্কে এত কথা জেনে যেতে পারে, এবিষয়টি ঠিক বোঝা গেল না। আবার নিখিলেশের বাড়ির শম্ভু দার বয়স বৃন্দার ছেলেবেলায় যেভাবে দেখানো হয়েছে। বৃন্দা প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে যাওয়ার পরও তাঁর বয়স বিশেষ বেড়েছে বলে মনে হল না। তবে ছবিতে এই কয়েকটি খটকা ছাড়া ভালোলাগার পরিমানটাই যেন বড় বেশি হয়ে ওঠে। সবথেকে বেশি মন ছুঁয়ে যায় নিখিলেশের মৃত্যুর পর দুঃখে বৃন্দার পাথর হয়ে যাওয়া। আবার তারপরেও নিজেকে স্থির রেখে নিখিলেশের মৃত্যু বদলা নিতে তিনি ভোলেননি। এই দৃশ্যগুলি সত্যিই মনে দাগ কেটে যায়।
ছবিতে নিখিলেশের চরিত্রে নজর কেড়েছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য, সন্দীপের চরিত্র যীশু সেনগুপ্তের অভিনয় নিয়ে প্রশংসা করলেও কম করা হয়। তবে সেই অর্থে নজর কেড়েছেন নবাগতা অভিনেত্রী তুহিনা দাসের অভিনয়। নিখিলেশের স্ত্রী হিসাবে কিংবা সন্দীপের প্রতি প্রেম, আবার বদলা নেওয়া সব দৃশ্যে তিনি যেন বড়বেশি করে সপ্রতিভ হয়ে ওঠেছেন। তথাকথিত ছোট চরিত্র হলেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় শ্রীনন্দা শঙ্কর, ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়, সোহাগ সেন, বরুণ চন্দ, অঞ্জন দত্ত সকলের অভিনয়ই চরিত্রের প্রয়োজনে প্রশংসনীয়। ছবিতে মন ছুঁয়ে গেছে নীল দত্তের আবহ সঙ্গীত। মন কেড়েছে তুহিনার খালি গলায় গাওয়া গানের দুই কলি। নজর কেড়েছে ডিওপি শমীক হালদার ও সম্পাদনায় রবীরঞ্জন মৈত্রের কাজ। সবমিলিয়ে বলা যায় রবীন্দ্রনাথের 'ঘরে বাইরে'-কে বর্তমান সময়ের ছাঁচে ফেলে ভীষণই সফল ভাবে 'ঘরে বাইরে আজ' বানিয়েছেন পরিচালক অপর্ণা সেন। পরিচালনায়, দৃশ্যায়নের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রন্ধ্রে নিজের ছাপ রেখে গেছেন তিনি। তাঁর এই ছবিকে তাই ৫এ ৪ দেওয়াই বাঞ্ছনীয়।