প্রতীম ডি গুপ্তা


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

আমি 'ভ্যানিশ' নামে একটি ছবির চিত্রনাট্য লিখেছিলাম। আমি চেয়েছিলাম সেই ছবিতে একটি চরিত্রে ঋতুদা অভিনয় করুক। চিত্রনাট্য পড়ে শোনাতেই একদিন হাজির হই তার কাছে। সেই চিত্রনাট্য শুনে আমি কেমন স্ক্রিপ্ট লিখি সে বিষয়ে একটা ধারণা করতে পেরেছিল ঋতুদা। এই ঘটনার আগে অবধি আমাকে সাংবাদিক হিসাবেই চিনত। আমার চিত্রনাট্য শোনার পর একদিন বলল, 'তুই আমার সঙ্গে একটা চিত্রনাট্য লিখবি?' এটা আমার কাছে বিশাল ব্যাপার ছিল। আমি গল্প না শুনেই হ্যাঁ বলে দিয়েছিলাম। 


ঋতুদার বাড়ি ছিল ইন্দ্রানী পার্কে, সেখানেই রোজ আমাদের সেশন বসত। ঋতুদা ছিল ভোরবেলা ওঠার মানুষ, সন্ধে সাতটা আটটাতেই ঘুমিয়ে পড়ত। এদিকে আমার রুটিন ছিল একেবারেই উল্টো। খবরের কাগজের অফিসে তখন আমার দুপুর থেকে রাত দশটার শিফট। ভোরবেলা অ্যালার্ম দিয়ে রাখতাম। তাড়াতাড়ি উঠে নিজেই ড্রাইভ করে পৌঁছে যেতাম ঋতুদার বাড়ি। প্রায়ই ধোকলা কিনে নিয়ে যেতাম কারণ ঋতুদা তখন ডায়েটে ছিল কোনও ভাজা খেত না। আমরা দুজনে চা, ধোকলা দিয়েই ব্রেকফাস্ট সারতাম। ইন্দ্রানী পার্কের বাড়িতে ঋতুদার একটা ঘর ছিল সেখানে দেওয়াল জুড়ে শর্মিলা ঠাকুর থেকে শুরু করে রাইমা সেন, যত নায়িকাদের সঙ্গে ঋতুদা কাজ করেছে, তাঁদের সবার সাদা কালো ক্লোজাপ ছবি ছিল। সেই ঘরেতেই আমাদের রোজের সেশন বসত। কাজের পাশাপাশি চুটিয়ে আড্ডাও চলত। ঋতুদার শ্যুটিংয়ের নানান গল্প, নানা মিষ্টি মিষ্টি গসিপ নিয়ে ছিল আমাদের রোজের আড্ডা সেশন । একটা সময়ের পর তো বাড়ি থেকে বেশি বেরোত না কিন্তু ঐ ঘরে বসেই পুরো ইন্ডাস্ট্রির খবর রাখত। আমি সবসময় ঐ আড্ডার জন্য মুখিয়ে থাকতাম। 


আরও পড়ুন: ছোট্ট কবীরকে কৃষ্ণ সাজালেন Koel Mallick, মায়ের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে একরত্তি


এখন যখন পিছনে ফিরে তাকাই তখন আমার মনে হয়, ঋতুদার সঙ্গে আমার চিত্রনাট্য লেখার সেশনটা আমার কাছে ফিল্ম স্কুলে যাওয়ার মতো ছিল। ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলোকে যেভাবে ঋতুদা ছবিতে তুলে ধরেছে তা আরও ভালো বুঝতে পারি যখন তার সঙ্গে চিত্রনাট্য লিখতে বসি। উনিশে এপ্রিলে মা মেয়ের সম্পর্ক হোক বা উৎসবে একটা যৌথ পরিবারে একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক, দোসরে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক যেভাবে পর্দায় ও সম্পর্কের গল্প তুলে ধরেছিল তা প্রথম থেকেই আমার কাছে ছিল শিক্ষনীয়। কিন্তু লিখতে গিয়ে দেখতে পেলাম যে কিভাবে ঋতুদা ভাবে, আগে ইমেজটা মনে আসে নাকি চরিত্রটা কি করবে সেটা আগে মাথায় আসে অর্থাৎ চরিত্রগুলো তৈরির পিছনে যে ভাবনা, সেই প্রক্রিয়াটা বুঝতে পেরেছিলাম। তবে ঋতুদার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল তার সংলাপ। ঋতুদা প্রথমে নিজেই কলম দিয়ে লিখত, পরে আমি সেটা চিত্রনাট্যের আকারে লিখতাম। 
 
একদিন আমরা বসে লিখছি, ঋতুদা একটা চমৎকার সংলাপ বলেছিল, আমার এখনও মনে আছে। গল্পটা ছিল একটি মেয়ে আর ছেলে ছোটবেলার বন্ধু। ছেলেটা পরবর্তীকালে সুপারস্টার হয়ে যায় আর মেয়েটি ঐ গ্রামেই থেকে যায়। বহু বছর পর তাঁদের দেখা হয় যখন, তখন মেয়েটি বিবাহিত তাঁর একটি সন্তান রয়েছে। সেখানে একটি সংলাপ ছিল, লোকটি মেয়েটিকে জিগেস করে, 'তোর বাচ্চাটা কেমন আছে রে।' মেয়েটি বলে, 'ছেলে না মেয়ে ভুলে গেছ বলে বাচ্চা বললে।' এই সংলাপটা লিখে ঋতুদা নিজেই বলে উঠল ,'এটাই হল ঋতুপর্ণ ঘোষ'। এই যে একটা সংলাপের খেলা, ছোট্ট একটা সংলাপেই চরিত্রটা বলে দিল, তোমার এখন আমাকে আর মনে নেই, তোমার জীবন বদল গেছে। এটাই ছিল ঋতুপর্ণ ঘোষের ক্ষমতা। অনেক কিছু শেখার ছিল। আমার কাছে ঐ সকালগুলো ছিল একেবারে ফিল্মস্কুলের মতো। তবে বিশ্বের তাবড় তাবড় ফিল্ম স্কুলগুলোও এগুলো শেখাতে পারবে বলে মনে হয় না। একটা মানুষ যে প্রচুর সিনেমা বানিয়েছে তাঁর লেখার ভার, তাঁর চিত্রনাট্য়ের ভার, এত সামনে থেকে দেখা, আমার মনে হয় আমি খুবই ভাগ্যবান। 


চিত্রনাট্য় লেখার বিষয়ে আমি যেভাবে গল্পকে একটা আকার দিতাম সেটা পছন্দ করত ঋতুদা। আমি চেয়েছিলাম ফেলিনির 'এইট অ্যান্ড হাফ' ছবির মতো এই ছবির যিনি সুপারস্টার আর তাঁর জীবনে যে নারীরা রয়েছেন তাঁদের নিয়ে একটা চিত্রনাট্য গড়ে তুলতে। আমার গঠন প্রক্রিয়া ও চরিত্রগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়া খুবই পছন্দ হয়েছিল ঋতুদার। হয়তো আরও একসঙ্গে কাজ করা হত কিন্তু সেই সুযোগ আর রাখলেন না ঋতুপর্ণ ঘোষ।


(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)