শিরীষ কাগজ থেকে উল্টো কেটলড্রামের সুর, আজও দিগন্ত পঞ্চমমুখর
‘সত্তে পে সত্তা’র ‘দুক্কি পে দুক্কি’ গানে ব্যবহার মাউথ অর্গান, বাটন অ্যাকর্ডিয়ান ও ব্যাঞ্জো।
রোশনি কুহু চক্রবর্তী
গানকে গান হিসেবে দেখার থেকেও অনেক বেশি মিউজিক হিসেবে দেখতেন উনি। ওঁর নামেই সুর। উনি পঞ্চম। রাহুল দেব বর্মন। প্রথম বড় সাফল্য আসে ১৯৬৬-এ মুক্তি পাওয়া ‘তিসরি মঞ্জিল’ ছবিতে। তারপর রাহুলকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি।। তিনিই প্রথম ইলেকট্রনিক অর্গানের সঙ্গে ভারতীয় চলচ্চিত্রের শ্রোতা ও দর্শকের আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। গানটি ছিল ‘ও মেরে সোনা রে’। চেলো ও বাজ গিটারের সুর থেকে আরবি, লাতিন, পশ্চিমি ঘরানার মিউজিকে রাহুলই অনবদ্য। ‘শোলে’ ছবিতে হেমা মালিনীকে গব্বরের গুন্ডারা যখন তাড়া করেছে তখন একমাত্র রাহুল দেব বর্মনের পক্ষেই সম্ভব ওই তবলার শব্দ ব্যবহার করা।
একইভাবে কিতাব’-ছবিতে ‘মাস্টারজি কি আ গয়ি চিঠ্ঠি’-গানে ডেস্ক বাজিয়ে রেকর্ডিং করিয়েছিলেন শচীন কর্তার পুত্র। কাচের গ্লাসে চামচের তালেই নাকি ‘চুরালিয়া হ্যায় তুমনে জো দিলকো’র মিউজিক তৈরি করেছিলেন। কখনও বৃষ্টি পড়ার টুপটাপ, কখনও বা ফাঁকা বোতলে ফুঁ দিয়ে মিউজিক কম্পোজ, কখনও বা জলভর্তি বোতলের শব্দের ব্যবহার। গানের শুরু প্রি-লিউড, গানের মাঝে ব্যবহার হওয়া ইন্টারলিউডকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন রাহুল। খুশবু ছবিতে ‘ও মাঝি রে’ গানটির মিউজিকই পেল অন্য মাত্রা।
১৯৮৩ সালে ‘মহান’ ছবিতে বেহালা, টাম্বুরিন, ডাফলি-র ব্যবহারে ছবির গানগুলি ভুলতে পারলেন দর্শকরা। ‘সত্তে পে সত্তা’র ‘দুক্কি পে দুক্কি’ গানে ব্যবহার মাউথ অর্গান, বাটন অ্যাকর্ডিয়ান ও ব্যাঞ্জো। এদিকে ১৯৭৯ সালের ‘গোলমাল’ ছবিতে হারমোনিয়াম আর তবলায় বাজিমাত করলেন ছবির টাইটেল ট্রাকে।
মিউজিক গ্রাফড মডিউলেশনকে ট্রেডমার্ক বানিয়ে ফেললেন পঞ্চম। ‘শোলে’র ‘মেহবুবা’, কিংবা ‘হাম কিসিসে কম নাহি’র ‘তুম কেয়া জানো’, ‘পুকার’ ছবির ‘সমন্দর মে’, ‘আপনা দেশ’এর ‘দুনিয়া মে’-র প্রিলিউডই তার প্রমাণ। বেশ কিছু পানীয়ের বোতল ব্যবহার করেই ‘মেহবুবা’র সেই অনবদ্য কম্পোজিশন। চরিত্রহীন ছবিতে পানশালার আবহে ‘তেরি মেরি ইয়ারি বড়হি পুরানি’ গানে টিম্পানি, কেটলড্রাম বাজল তবে উল্টো করে। স্ত্রী, বন্ধু আশা ভোঁসলের হাসিকে ‘মঞ্জিল মঞ্জিল’ ছবির ‘ইয়ে নয়না, ইয়ে ইয়াদ হ্যায়’-তে ছন্দ হিসেবে ব্যবহার করতে রাহুল ছাড়া কেই বা পারেন। ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন দ্য ওয়েস্ট’-এর থেকে নিলেন হারমোনিকার সুর। ‘তেরে বিনা’-য় নেপালি মাদল ব্যবহার করে যে ছন্দটা আনলেন সেটা কিন্তু আবার লাতিন। সবকিছুতেই ঠিক পঞ্চমের মতোই অভিনবত্ব। একবারেই চিনে নেওয়া যায়।
আরও পড়ুন: Raj-কেই 'বন্ধু', 'পথপ্রদর্শক', 'উপদেষ্টা' বলে মনে করেন Saayoni Ghosh
শিরীষ কাগজ এবং বাঁশের কঞ্চি দিয়ে রাহুল তৈরি করলেন চলন্ত ট্রেনের আওয়াজ। তৈরি হল ‘জামানে কো দিখানা হ্যায়’ ছবির ‘হোগা তুমসে পেয়ারা কউন’ গানটি। ‘পড়োসন’ ছবিতে ‘মেরি সামনেওয়ালি খিড়কি’ গানটিতে চিরুনি ঘষার আওয়াজে লাতিন যন্ত্র ব্যবহার করে তাক লাগিয়ে দিলেন। ১৯৭১ সালের ‘অমর প্রেম’ ছবিতে ‘রয়না বিত যায়ে’-তে মিলে গেল সন্তুর ও গিটার। খুব সম্ভবত রাহুল দেব বর্মনই প্রথম সঙ্গীত পরিচালক যিনি এই দুঃসাধ্য কাজটি করেছিলেন। ১২ তারের সেমি-ক্লাসিকাল গিটারে ‘টোয়াং এফেক্ট’ আনলেন ১৯৮৩ সালের ‘মাসুম’ ছবির ‘তুঝসে নারাজ নাহি জিন্দগি’-তে। ১৯৮২ সালের মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘আমনে সামনে’-তে ‘তু ম্যায় বন গয়া’-তে ভোকাল হারমোনাইজার এবং বাবল বার্স্ট এফেক্টও আরডি-র তৈরি। কখনও ছায়াসঙ্গী রমেশকে বলছেন, প্লেকট্রাম নয় পেন কিংবা পেনসিল দিয়ে গিটার বাজাতে। কখনও বা এক সেট গিটার পরপর বাজিয়ে চলেছেন আইয়ার। গান কিন্তু একটাই। এমনই তো ছিলেন রাহুল দেববর্মন।
আরও পড়ুন: তাঁর অ্যালবামের নাম টুকে দিলেন সৃজিত! শিলাজিতের সোশ্যাল পোস্টের ছত্রে ছত্রে অভিমান
ইলেকট্রিক সেতারে ফ্ল্যাঙ্গিং এফেক্ট আনলেন, ১৯৭৮ সালের ‘শালিমার’ ‘ওয়ান টু চা চা চা’-গানে। আফ্রিকান ড্রামস কিংবা বেস গিটার, অ্যাকুয়াস্টিক গিটার, মাদল, শেকারস, বঙ্গোর ব্যবহারের ভঙ্গিটাই পাল্টে দিলেন। এক সময়ে বছরে ১৭টা ছবির জন্য গান তৈরি করছেন যে শিল্পী তিনি ১৯৯৪ সালের ৪ জানুয়ারি চলে গেলেন অনেক যন্ত্রণা নিয়েই। তাঁর শেষ কাজ, ১৯৪২-লাভ স্টোরি মুক্তি পেল ১৫ জুলাই। রয়ে গেল, ‘কুছ না কহো’, ‘রিমঝিম রিমঝিম’-এর সুরের রেশ। রাহুলের মতো শিল্পীদের যে মৃত্যু হয় না।