সরল সুরের সেই ভাষাতেই গান বাঁধলেন সত্যজিৎ
ছবির আবহসঙ্গীতকে কোথাও আবশ্যিক করে তোলার ক্ষেত্রেও সত্যজিতেরই অবদান।
রোশনি কুহু চক্রবর্তী
ছবি বিশ্বাসের মুখের উপর ক্যামেরার ফোকাস। স্থির সেই ছবি। আরামকেদারায় বসে নদীর পারে তাকিয়ে রয়েছেন বিশ্বম্ভর রায়। ভেসে আসছে বিসমিল্লা খাঁয়ের শেহনাইয়ের সুর। বাজতেই থাকে সেই সুর। ছড়িয়ে পড়ে তাঁর ছেলের উপনয়নের অনুষ্ঠানের মধ্যে। মিশে যায় সন্ধ্যার ‘গ্র্যান্ড কনসার্ট’-এর সুরের সঙ্গে। আসলে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত মানেই সামান্য কয়েকজন নিবিষ্ট শ্রোতা। সেই ধারণাকে খানিকটা হলেও বদলে দিলেন ‘জলসাঘর’ ছবির সঙ্গীত পরিচালক বিলায়েত খাঁ। ‘জলসাঘর’ ছবির অন্যতম চরিত্র হয়ে উঠল সেই সুর। ‘মিঞা কি মলহার’ গেয়ে উঠলেন শ্যাম চৌরাশি ঘরানার সালামত আলি খাঁ। দাদরায় ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন বেগম আখতার। পিলুর মূর্চ্ছনায় ভরিয়ে তুললেন বাঙালি সিনেপ্রেমীকে। কত্থকের ছন্দে মাতালেন রোশন কুমারী। সামন্ততান্ত্রিক সেই প্রথা কোথাও যেন ভেঙে গেল মুহূর্তের মধ্যে। ভারতীয় মার্গসঙ্গীতকে মূলধারার বাংলা ছবিতে আরও নিবিড় করে তুললেন সত্যজিৎ রায়।
সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালি‘, ‘অপরাজিত‘, ‘অপুর সংসার’,‘পরশপাথর’-কে অন্যমাত্রায় নিয়ে গিয়েলেন রবি শঙ্কর। কলকাতার ভবানী সিনেমা হলে ‘পথের পাঁচালি’-র রাফ কাট দেখেছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। ছবির সঙ্গীত পরিচালনার ভার নিয়ে ভাবতে সময় নেননি আর। কলকাতার ডিক্সন লেনে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের বাড়িতে তার আগেই দুই কিংবদন্তির সাক্ষাৎ। পথের পাঁচালির মিউজিক রেকর্ডিং হল প্রায় একদিনে। দুর্গার মৃত্যুর দৃশ্যে তারের শেহনাই ব্যবহার করলেন রবিশঙ্কর। সম্পূর্ণ এডিট কিন্তু তখন দেখেননি সেতার মায়েস্ত্রো। ছবি মুক্তির পর রবিশঙ্কর দেখলেন, সত্যজিতের সুগভীর সঙ্গীত ভাবনায় সে দৃশ্য পেয়েছে অন্য মাত্রা। বেশ কিছু দৃশ্যে ফাঁক ভরাটে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের শৈল্পিক কাজগুলো বেরিয়ে এসেছিল সত্যজিতের কাছ থেকেও। নিজের ভাবনাকে কখনও সত্যজিৎ চাপিয়ে দেননি, রবি শঙ্কর নিজেই বারবার সে কথা বলেছেন।
২৬ মিনিটের ছবি ‘পিকু’তেও বাঁশির সুর তাই মনে থেকে যায় দর্শকের। তেমনিভাবেই ‘পরশপাথর’ ছবির সঙ্গীত পরিচালক রবিশঙ্করকেও যেন অন্যভাবে চিনতে পারেন সিনেপ্রেমীরা। ‘দেবী’ ছবিতে সত্যজিৎ কাজ করলেন আলি আকবর খাঁয়ের সঙ্গে। ১৯৫২ সালের ‘আন্ধিয়া’ ছবি দেখে সরাসরি আকবর সাহেবের কাছে প্রস্তাব রেখেছিলেন সত্যজিত্। দীর্ঘ মহড়াও চলেছিল তাঁদের। কয়েকটি মাত্র সুর বেছে নিয়েছিলেন ‘একগুঁয়ে’ সত্যজিৎ। তাঁকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়নি, সাক্ষাৎকারে সে কথা জানালেও সত্যজিতের সঙ্গীতবোধকে সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা করে কথা রেখেছিলেন আলি আকবর।
আরও পড়ুন: সত্যজিৎ শতবর্ষ: সত্যজিতের কাজের সব চেয়ে বড় কথা হল ওঁর টোটাল ডিসিপ্লিন
আকবরের সে কথাই সত্যি প্রমাণিত হল। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘সীমাবদ্ধ’, ‘জন অরণ্য’-এর বেহালা, চেলো, ডবল বাস গিটার,ডিম্পানি, ড্রামসের ব্যবহারে সঙ্গীত পরিচালনাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেলেন সত্যজিৎ স্বয়ং। ‘তিন কন্যা’র মতো অন্য ছবির ক্ষেত্রেও সত্যজিতের থিম মিউজিকই আজও বুঝিয়ে দেয় সিনেমার প্লট।
ছবির আবহসঙ্গীতকে কোথাও আবশ্যিক করে তোলার ক্ষেত্রেও সত্যজিতেরই অবদান। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ভাষা বদলের সঙ্গে সঙ্গে আবহসঙ্গীতকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন অন্য পর্যায়ে। ‘সোনার কেল্লা’, ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ কিংবা ‘গুপি গাইন, বাঘা বাইন’ বললেই কিছু সুর ভেসে ওঠে অজান্তেই। সে সুরে পিয়ানোর সঙ্গে পাহাড়ি মেঠো গন্ধ মিশে যায়। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-য় লাবণ্যর মুখে অমিয়া ঠাকুরের কণ্ঠে ‘এ পরবাসে রবে কে’ এবং পাহাড়ের খুদের সরল সুরের ভয়ানক একাকিত্বের সুরের মোহে পড়ে যান দর্শক। তাই বাখ,বিটোফেন, মোজার্টের প্রভাবের পাশাপাশি একাকিত্বের সুর সত্যজিতের ছবিতে বারবার এল রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে। ‘চারুলতা’ ছবিতে রিনি রিনি সুরে বাজতে থাকে ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে’। চারুর গলায় ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’-র মধ্যে যে নিঃসঙ্গতা, ছোটবেলার গ্রামকে ফিরে দেখা তা কোথাও যেন মিশে যায়, ‘তিন কন্যা’ ছবির ‘মণিহারা’য়। ‘দূরে বাজে করুণ সুরে’-র সিংহেন্দ্রমধ্যমের আর্তি কখনও কি ভুলতে পারবেন দর্শক?
একইভাবে কলের গানে সমাপ্তির অপূর্বর সদ্য প্রেমের অসহায়তা বোঝাতে ‘বসিয়া বিজনে’-র ব্যবহারে সত্যজিত্ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন নিজের দক্ষতা। ‘ঘরে বাইরে’-র ‘একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ’, কিংবা কলকাতা ট্রিলজির ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’-তে ক্যামেরাবন্দি রইলেন সত্যজিতের রবি ঠাকুর ।
পশ্চিমি নোটেশন ছেড়ে বাংলা নোটেশনে ফিরলেন সত্যজিৎ। অপেরা ধাঁচের ‘গুগাবাবা’য় এ শিল্পী হয়ে উঠলেন চিরপ্রণম্য। ভৈরবীর সুরে ‘দেখো রে নয়ন মেলে জগতের বাহার‘, এ ছাড়াও ‘এক যে ছিল রাজা’, কর্নাটকি ঢঙে ‘পায়ে পড়ি বাঘ মামা’, ‘মোরা দুজনায় রাজার জামাই’-কে অনুপ ঘোষালের কণ্ঠে অমর করে দিলেন সুরস্রষ্টা সত্যজিৎ। অমর পালের কণ্ঠে ‘কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়’ ফ্যাসিস্টবিরোধী সুর হিসেবে গাঁথা রইল বিশ্বের সঙ্গীত ভাণ্ডারে। কর্নাটকি সুর, বাদ্যযন্ত্রকে অন্যভাবে নিয়ে এলেন বাংলা ছবিতে। ‘চারুলতা’য় কিশোর কুমারের কণ্ঠে ‘আমি চিনি গো চিনি’-র ব্যবহার কিংবা আগন্তুকে নিজের কণ্ঠে গান চেনাল অন্য সত্যজিৎকে। কিংবদন্তি মিউজিক স্রষ্টা মরিস জ্যর বলতেন, সত্যজিতের ছবির সুর যেন তাড়া করে বেড়ায়, একাকিত্বের দর্শন যেন। ঠিক তাই কাশবনের পাশ দিয়ে রেলগাড়ি ছুটে গেলে এখনও বিশ্বের যে কোনও সিনেপ্রেমী গুনগুন করতে থাকেন ‘পথের পাঁচালি’র সেই সুর। সুরের ভাষা, ছন্দের ভাষায় সারা বিশ্বের শিল্পীরাও তাই অভিবাদন জানান সত্যজিত্কে, গেয়ে ওঠেন, ‘মহারাজা তোমারে সেলাম।’