Rituparna Sengupta on Rituporno Ghosh:`একটা অভিমান রয়ে গেল`, ঋতুপর্ণ ঘোষের স্মৃতিতে কলম ধরলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত
ঋতুদা চেয়েছিলেন, আমি আরও দুটো সিনেমা করি ওঁর সঙ্গে, সে সময় করা সম্ভব হয়নি। `চোখের বালি` ছবির জন্য আমার সঙ্গে কথা হয়েছিল কিন্তু পরিস্থিতির কারণে তা করা হয়নি। `দোসর` আমাকে অফার করেছিলেন ঋতুদা।
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত
ঋতুপর্ণ ঘোষ আমাদের কাছে নতুন যুগের হাওয়া। ভারতীয় সিনেমায় তাঁর অবদান গভীর ও স্বাচ্ছন্দ্যে ভরা। নতুন নানা বিষয়কে, নানা চরিত্রের মোড়কে, নতুন নিরিখে সিনেমাকে আবিষ্কার করেছিলেন ঋতুদা। আর আমার ঋতুপর্ণ ঘোষকে আবিষ্কার করা ছিল একেবারে অন্যরকম। খুব ভালো মানুষ ছিলেন ঋতুদা। অনেক ভালো ভালো কাজ করেছি ঋতুদার সঙ্গে। যদিও খুব বেশি সিনেমা করা হয়নি, মাত্র দুটো ছবি করেছি কিন্তু সেই দুটো ছবিই আমার কেরিয়ারে গুরুত্বপূর্ণ। এখন মনে হয় আরও বেশি কাজ করতে পারলে ভালো হতো।
ঋতুদা চেয়েছিলেন, আমি আরও দুটো সিনেমা করি ওঁর সঙ্গে, সে সময় করা সম্ভব হয়নি। 'চোখের বালি' ছবির জন্য আমার সঙ্গে কথা হয়েছিল কিন্তু পরিস্থিতির কারণে তা করা হয়নি। 'দোসর' আমাকে অফার করেছিলেন ঋতুদা। সেটাও আমি করে উঠতে পারিনি। এরমাঝেও আরেকটা ছবির কথা হয় কিন্তু করে ওঠা হয়নি। এরপরেও আমার সঙ্গে কাজ করার কথা হয়েছিল। দেব, প্রিয়াংশু ও আমাকে নিয়ে একটি ছবির পরিকল্পনা করেছিলেন। তার কিছুদিনের মধ্যেই ঋতুদা চলে গেলেন।
ঋতুদার বাবা আর আমার বাবা অনেকটা একই সময়ে আমাদের ছেড়ে চলে যান। আমরা সেই দুঃখ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতাম। আমার বাড়ি আর ঋতুদার বাড়ি যেহেতু কাছাকাছি ছিল, প্রায়ই ফোন করে বলতেন, 'আজ তাড়াতাড়ি চলে আসবি। আমরা আড্ডা দেব আর একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট করব'। ঋতুদার প্রিয় ব্রেকফাস্ট ছিল লুচি আলুরদম। আমি একদিন ঋতুদার পেন্টিংয়ের খুব প্রশংসা করছিলাম। ঋতুদা বললেন,'তোর যে পেন্টিংটা পছন্দ সেটা তোকে গিফট করব।'কিন্তু তার আর অবকাশ হল না। তার আগেই ঋতুদা চলে গেলেন। আমার প্রতি জন্মদিনে একটা করে শাড়ি পাঠাতেন। সেই শাড়িগুলো অপূর্ব হত। ছবিতে ঋতুদা আমাকে যেরকম শাড়ি পরাতে চাইত, সেরকমই কখনও ঢাকাই কখনও তাঁতের শাড়ি পাঠাত।
আমার বিয়ের কার্ডটাও ঋতুদার ডিজাইন করা। আমাকে বিয়ের দিন শাড়ির পাড়ের সঙ্গে ম্যাচিং করে আমাকে চন্দন পরিয়েছিলেন। মানুষটার মধ্যে একটা অদ্ভুত প্রাণ ছিল, সবাইকে আপন করে নিতে পারতেন। প্রথমবার আমেরিকায় আমার যে ছবি দেখানো হয়েছিল, সেটা ছিল 'উৎসব'। আমেরিকার নানা শহরে দেখানো হয়েছিল সেই ছবি। সেই ট্যুরটা আমি কোনওদিন ভুলব না। একসঙ্গে সব শহরে যাওয়া, আড্ডা, খাওয়া দাওয়া। আর ঋতুদার সঙ্গে থাকার অন্যতম সেরা ব্যাপার হল ওঁর সান্নিধ্য। এতো জ্ঞান ছিল ওঁর। পিকাসোর পেন্টিং দেখে আমাকে অনেক কিছু বলেছিলেন। ওয়েস্টার্ন ছবি কীভাবে আমাদের অনুপ্রাণিত করে? এছাড়াও নানা বিষয়ে কথা হতো।
ঋতুদার মধ্যে একটা ঘরোয়া মন ছিল। সবাইকে ভালোবাসার ক্ষমতা ছিল। প্রত্যেকের জন্য তাঁর মনে জায়গা ছিল। অনেকের ব্যাপারেই দেখেছি ওঁর তাঁদের প্রতি সহমর্মিতা ছিল। আমার সঙ্গে অদ্ভুত যোগাযোগ ছিল। খুব অল্প বয়সেই ঋতুদার হাত ধরে আমার বানিজ্যিক ছবি থেকে অন্যধারার ছবিতে যাত্রা শুরু হয়। সবমিলিয়ে আমার প্রতি একটা ভালোবাসার টান ছিল। তবে ঋতুদার প্রতি আমার একটা অভিমান আছে। আরও কিছু কাজ আমরা একসঙ্গে করতে পারতাম। কিছু আমি পারিনি, কিছু ঋতুদা পারেননি। সেই একটা অভিমান আছে। তবে এটাই চাই মানুষটা যেখানেই থাকুক, যেখানেই জন্ম নিক, পৃথিবীর জন্য নতুন কিছু সৃষ্টি করে যাক। সিনেমার একটা নতুন দিগন্ত খুলেছিলেন ঋতুদা। নতুন ধরনের সিনেমার প্রচার করেছিলেন, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঋতুদা আমার পরিবার ছিলেন। অন্তিম দিনে অনেকের সঙ্গে আমিও ঋতুদাকে সাজিয়েছিলাম।