স্বরূপ দত্ত


ওই নারকেল গাছের দিক থেকে সূর্যটা তখন ডোবার আগে চলে যাই চলে যাই বলছে। দিব্যি লাগছে আকাশটা। লাল, নীল, বেগুনি, গোলাপি, কমলা, রঙের ওই বাটিতে বেশ একটা সুস্বাদু রঙের খিচুড়ি হয়েছে। কিন্তু নিয়নের আর সেই আলো চেখে দেখার সময় কোথায়!
ওই হরেক রঙ সাড়ে ছ'টাকা এসে বৃষ্টির গালটায় রিফ্লেক্ট করছে! ভালো করে নিয়ন বৃষ্টির দিকে দেখল একবার। মনে মনে ভাবছে, কোনটা বেশি টলমলে? নলবনের ওই ঢেউ ওঠা, হাওয়া মাতানো কালো জল নাকি, বৃষ্টির চোখের মণিদুটো কেমন যেন শালতির মতো ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা অংশকে ঢেকে দিয়ে!
চোখ সরাতে পারছিল না নিয়ন। কই আগেও তো সে বৃষ্টিকে অনেকবার দেখেছে। এতো সুন্দরী তো কখনও ওকে লাগেনি। তাহলে বৃষ্টির সৌন্দর্য আজ কেন অঝোরে ঝরছে! তাহলে কী সত্যিই মেয়েরা পুরুষের কাছে আসলে আরও বেশি সুন্দরী হয়ে যায়? ওই অনেকটা ফুলের মতো। দেখতে সুন্দর সবসময়ই। কিন্তু মৌমাছিটা এসে পরাগে নিজের ছোঁয়া দিল আর ফুলটা কেমন যেন দুলে উঠে হেসে দিল! তবে, কি আজ নিয়নের খুব কাছে এসে বৃষ্টিও এত অপরূপ! এসব ভাবতে ভাবতেই বৃষ্টির ডাকে সম্বিত ফিরে পেল নিয়ন।
বৃষ্টি বলল, অ্যাই। কী ভাবছো? নাকি আমাকেই দেখছো? রোজই তো দেখো। তাহলে আজ এত বিভোরভাবে? কী মশাই, প্রেম একটু বেড়েছ মনে হচ্ছে। ভ্যালন্টাইনস ডে আসছে। আর অমনি আমার নিয়নবাবুর প্রেমের আলোর ভোল্টেজ বেড়ে গিয়েছে মনে হচ্ছে?বলেই বৃষ্টি এক গাল হেসে গড়িয়ে পড়ল। নিয়নের থাইয়ের উপর কনুইটা রেখে বৃষ্টি ওর মুখটা নিয়নের বড্ড বুকের কাছাকাছি মিশিয়ে দিল।
নিয়ন আর বৃষ্টির প্রেম সবে দিন সাতেকের। সদ্য আসতে চলা বসন্ত। একই অফিস। দুই সহকর্মীকে যেন মিলিয়ে দিয়েছিল। দুজনেই সেক্টর ফাইভে চাকরি করে। কল সেন্টার। নিয়নের বড় সুন্দর কথা বলার ক্ষমতা রয়েছে। মার্জিত। সুবক্তা আর শ্রুতিমধুর গলার স্বর। কোয়ালিটি ডিপার্টমেন্টে অল্প দিনেই বেশ নামডাক করে ফেলেছে সে। একই অফিসে বৃষ্টিও চাকরি করে। ওর আবার HR সেকশন। মাস ৭-৮ চোখাচোখি হয়েছিল। কিন্তু কখনও কথা বলা হয়নি সেভাবে। আসলে নিয়ন একটু অন্যরকম। পয়সার তাগিদেই তাকে এই চাকরিটা করতে হয়। কল সেন্টারের মতো এতগুলো টাকা, পিক অ্যান্ড ড্রপ ফেসিলিটিস তাকে অন্য কোথাও আর দেবে কে? নাহলে নিয়ন যে মনের মানুষ, তাতে এই কর্পোরেট সেক্টর ছাড়া দুনিয়ার সব জায়গাতেই সে মানানসই হয়তো। মনটায় কষ্ট হত নিয়নের। দম আটকে যেত। ওই সিস্টেমেটিক জীবনটা একদম পছন্দ করতে পারত না। এটা করা যাবে না। ওটা কেউ করে না। এরকম করবে না। ছেলেবেলার বয়সটাই শুধু হারিয়ে গিয়েছিল নিয়নের জীবন থেকে। আসলে বড় বয়সে আরও বেশি ছেলেবেলার জীবনটায় তাঁকে কেউ যেন বক্সিং রিংয়ে নামিয়ে দিয়েছে। একদিকে সিস্টেমের লাগাতার মুখোমুখি ঘুসি। অন্যদিকে রিং থেকে বেরোনোর জন্য সারা রাত চোখ খুলে ভাবনা আছে। কিন্তু সেই ভাবনার ঘরের দরজার চাবিটার নাগাল কিছুতেই যেন পায় না নিয়ন! তবু দ্বৈত সত্বা নিয়েও দিনগুলো কোনওরকমে কাটিয়ে যাচ্ছিল। নিজের কাজটুকু ছাড়া অফিসের কোনও বিষয়েই সে ছিল না কোনওদিন। আর মেয়েদের থেকে নিয়ন এতটাই দূরে, ঠিক যতটা সে নিয়ম থেকে দূরে থাকতে চায়। কিন্তু নিয়মও তাকে পিছু ছাড়েনি। তেমনই মেয়েরাও ঠিক যেন ওই মাজরা পোকার মতোই ভিড় করত নিয়নের সাদা ফ্রেমের জীবনে। নিয়নের আলো তো থাকত। কিন্তু মেয়েদের ওই কালো ছোপগুলো বোধহয় তার জীবনটাকেও অনেক বেশি উজ্জ্বল করে তুলছিল।
সেদিন ক্যাফেটেরিয়ায় বসে এক কাপ চা বেশ আয়েস করেই খাচ্ছিল নিয়ন। কোণার দিকের একটা টেবিলে সে একাই বসেছিল। চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে কী করা যায়, এইসবই মনে মনে ভাবছিল। হঠাত্‍ কানে এলো কথাগুলো - যার কথা বলাটাই কাজ, সে এমন কোনায় চুপচাপ বসে! মানে কী!
এই এমনিই বলে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল নিয়ন। কিন্তু বৃষ্টি পড়া শুরু করলে, কতক্ষণই বা আর তার ছাট থেকে বাঁচিয়ে রাখা যায় নিজেকে! তাই বৃষ্টি সামনে বসে ম্যাগির প্লেট থেকে টপাটপ খাচ্ছে আর নিয়নকে কীসব বলে যাচ্ছিল অনবরত, অনর্গল। কিন্তু নিয়নের কানে সে সব ঢুকলে তো! ও তখন অপলক বৃষ্টির ঠোঁটের দিকে। ম্যাগিটা খাওয়ার সময় বৃষ্টি অদ্ভূত একটা কায়দায় ঝুলে পড়া ম্যাগিগুলোকে মুখের মধ্যে শুষে নিচ্ছিল। অবাধ্য ম্যাগিগুলোকে কী ভালো বাধ্য করে ক্লাশরুমে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল যেন বৃষ্টি! সেদিন কথা বাড়েনি আর। কিন্তু রাতও যেন কাটেনি নিয়নের। সারারাত চোখে ভেসেছে বৃষ্টির ঠোঁট আর অবাধ্য ম্যাগির টাগ অফ ওয়ার! আর ওই গন্ধটা। মরশুমের প্রথম বৃষ্টির সোঁদা গন্ধটাই এতদিন চেনা ছিল নিয়নের কাছে। কিন্তু বৃষ্টির গন্ধের নেশা যে, এভাবে সব ভুলিয়ে দেবে, তা কখনও কল্পনাও করেনি সে।
পরের দিন অফিসে গিয়ে খুঁজেছিল বৃষ্টিকে। বৃষ্টি তখন অলরেডি বেরিয়ে পড়েছে। নিয়ন শুনে বলল, ওকে তাহলে কাল দেখা হবে। তেমন কিছু দরকার ছিল না। এমনিই। ও প্রান্তের বৃষ্টি অনেক বেশি সপ্রতিভ, স্বচ্ছন্দ। বুঝতে পারছিল, নিয়নের আলো এবার বৃষ্টির উপর পড়া শুরু হয়েছে। বাড়িতে আয়নার সামনে নিজেকে দেখতে গিয়ে বৃষ্টিরও নিজেকে কেমন যেন উজ্জ্বল লাগছিল। পরের দিন খুব একটা ভনিতা করেনি দুজনের কেউই। অফিসের নিচের রামুর দোকান থেকে সিগারেটটায় একটা টান দিয়েই চারটে পা প্রথম দিন থেকেই একই ছন্দে হাঁটতে শুরু করল।
আর আজ সেই সদ্য প্রেমের তৃতীয় দিন। শনিবার। দুজনেরই অফিস ছুটি হয়ে গিয়েছে সাড়ে তিনটেয়। অন্য কোথাও না গিয়ে পাশের নলবনে গিয়ে ভ্যালেন্টাইন্স ডে-টা কীভাবে কাটাবে সেই অ্যাজেন্ডা নিয়েই যেন দুজনে ঢুকে পড়েছিল। ঘাটে দাঁড় করানো ওই রঙীন বোট দেখে বৃষ্টিই বলল, অ্যাই চলো না একটু চড়ি। খানিকটা ইতস্তত করেও দুজনে উঠে বসেছিল নৌকায়। এক ঘণ্টা। দু পাক। তিনশো টাকায় যে এভাবে পৃথিবী বুকে নিয়ে ঘোরা যায়, নিয়ন টের পেল বৃষ্টির কাঁধ থেকে চুলগুলো সরিয়ে নিতে দেখে। এতটা কাছাকাছি, আগে কখনও কোনও মেয়েকে পায়নি নিয়ন। নিয়ম না মানা ছেলেটা জানেও না, এই সময়কে কাজে লাগানোর ঠিক নিয়মটা কী!
ব্যালান্স জোড়ি। কোনও সমস্যা নেই। বৃষ্টিই বলল, অ্যাই যে, ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে অনেক আনন্দ করব। কিন্তু আজ জানো কী দিন! নিয়ন প্রশ্ন করল কী?
বৃষ্টি বলল, আজ হাগ ডে। তোমার মতো বুদ্ধুর জন্য আলিঙ্গন দিবস। অ্যাই করো না গো, আমায় একটা হাগ করো। নিয়ন তখন মনে নিভু নিভু। বৃষ্টিই হঠাত্‍ সামনে এসে নিয়নের থুতনির কাছে নিজের মাথাটা ঢুকিয়ে দিল। আর ফিরে গেল নিয়নের একেবারে উল্টোদিকে। তারপর নিয়নের দুটো হাত নিজের কোমড়ের উপর দিয়ে নিজে নিজেই নিয়ে বেধেঁ নিলো নিজেকে। নিয়নের শরীরে যেন হঠাত্‍ ভোল্টেজ বেড়ে গেল অনেকটা। ওদিকে বৃষ্টি খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল, এই হলো আমাদের আলিঙ্গন। কী তোমার পছন্দ তো? কোনও নিয়ম নেই। সব একেবারে উল্টো।
উল্টোটা যে এভাবে সব হয়ে যাবে ভাবেনি, দুজনের কেউই। পরের দিন যখন বৃষ্টি খবরটা প্রথম শুনলো, কিছুতেই বিশ্বাস হয়নি তাঁর। বলছে কী এরা! নিয়নদের বাড়িতে আগুন লেগেছিল রাতে। ঘুমের ঘোরেই পুরো শরীরটা জ্বলে গিয়েছে! দাহ করার মতোও নাকি কিছু অবশিষ্ট ছিল না।
না, নিয়ন আর কোনওদিন বৃষ্টির জন্য জ্বলেনি। বৃষ্টিও আর কোনওদিন পড়েনি। সব আবার আগের মতো। নিয়ম মেনেই। সব আছে। কিন্তু কোনও ভালো লাগা নেই। মরে যাওয়ার সাহস নেই। বেঁচে থাকার কারণ নেই। এভাবেই বাড়িকে ৫ টা বছর ঠেকিয়ে রেখেছিল বৃষ্টি। কিন্তু বাবা-মায়ের ইচ্ছেকে আর কত বছর খরা হয়ে আটকে রাখতে পারে বৃষ্টি? বয়সও হয়ে গেল ৩১। এই ছেলে নাকি সোনার টুকরো। ভালো চাকরি। অনেক ভালো রাখবে তোকে। আচ্ছা, তোর যদি এত আপত্তি তাহলে যা না, আবিরের সঙ্গে একটা দিন একটু ঘুরে আয়। ও-ই বলছিল, তাহলে তোরা দুজন-দুজনকে চিনতে পারবি।
অনেক অনিচ্ছাতেও বুক বুজে চিনতেই গিয়েছিল বৃষ্টি। লোকেশন, সেই নলবন। বিকেল। সূর্য ডুবে গিয়েছে। সামান্য আলোর আভা প্রাণপণ তার রেশ রেখে যেতে চাইছে। আবির বলেছিল, চলো না নৌকায় করে এক চক্কর লাগিয়ে আসি। জলে ভয় পাই বলে এড়িয়ে গিয়েছিল বৃষ্টি।
রেলিংয়ে কনুইয়ের ভর দিয়ে দূরের জলের স্রোতের দিকে তাকিয়ে ছিল বৃষ্টি। পিছন থেকে আবির কখন যেন বৃষ্টির কোমড়ে দুটো হাত দিয়ে নিয়মে বেঁধে দিতে চেয়েছিল! এক ঝটকায় সরে যায় বৃষ্টি। কিন্তু ও কিছু বলার আগেই চারিদিক থেকে হৈ হৈ করে আওয়াজ ওঠে।
আগুন, আগুন, আগুন। বৃষ্টি দেখে খানিকটা দূরে ঘাটে বাঁধা একটা নৌকায় বোধহয় স্টোভে রান্না চাপিয়ে পাড়ে এসেছিল মাঝিটা। নৌকাটার কালো কাঠামোয় তখন গেরুয়া রঙের আগুন প্রেম জড়িয়ে ধরেছে। না, এ ভালোবাসা থেকে নিয়ন কিংবা নৌকা, কাউকেই বাঁচানোর কেউ নেই। বৃষ্টির চোখে অঝোরে জল পড়া শুরু হল। কিন্তু সে জলের জোর কী যে, তা দিয়ে নিয়নকে কালো ছাইয়ের অন্ধকার থেকে ফের আলোয় ফেরানো যায়! ও পাড়ের নারকেল গাছগুলোর পাশ থেকেও আগুনরঙা সূর্যটা যেন সব কাজ শেষ করে হারিয়ে গিয়েছে। ৫ বছরের সময়টাই চলে গেল। নিয়মগুলো সব একই আছে। আজ বৃষ্টি বুঝল, নিয়ম মানে কেড়ে নেওয়া।