``রাজা তো মর গ্যায়া, রানি আভি জিন্দা হ্যায়``,`দিল বেচারা`য় যেন নিজের গল্পই বললেন সুশান্ত!
সিনেমা দেখছি তো? নাকি বাস্তব? সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যেতে লাগলো...
রণিতা গোস্বামী : সুশান্তের শেষ ছবি, যা দেখার জন্য এতদিনের রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা তো ছিলই। সময় মতো বসেও গেলাম ছবি দেখতে। অন্যান্য ছবির থেকে 'দিল বেচারা' দেখার জন্য যে আলাদা আবেগ কাজ করবে, সেটাই স্বাভাবিক। ছিলও তাই। তবে সিনেমা শুরু হওয়ার পরই যেন অদ্ভুত ভাবে সবকিছু পাল্টে গেল। সিনেমা দেখছি তো? নাকি বাস্তব? সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যেতে লাগলো।
ল্যাপটপ চালিয়ে বসে সুশান্তকেই তো দেখছি। সেই ঠোটের কোণ থেকে চুঁইয়ে পড়া প্রাণোবন্ত সেই একই তো হাসি। হ্যাঁ, ছবি দেখার থেকেও 'দিল বেচারা'তে সুশান্তকে দেখাই যেন নিজের অজান্তেই মনের মধ্যে অগ্রাধিকার পেল। শুধু আমার কেন, এটা হয়ত প্রায় সব দর্শকেরই হয়েছিল। ছবির শুরুর দিকে 'এক থা রাজা, এক থি রানি। দোনো মর গ্যায়ে, খতম কাহানি, পর অ্যায়সি কাহানিয়া কিসিকো আচ্ছি নেহি লাগতি', কিজি বসুর (সঞ্জনা সঙ্ঘী) মুখ থেকে ডায়ালগটা শুনে কিছুটা চমকেই গেছিলাম। তবে কাহানি যাতে ভালো লাগে, মন ছুঁয়ে যায়, ম্যানি সেই ব্যবস্থা করে দেন। নাহ... কিজির গল্প কিন্তু শেষ হতে দেননি ম্যানি। ক্যান্সারে আক্রান্ত, বাবা-মাকে ঘিরে চলা কিজির 'বোরিং', মৃতপ্রায় জীবনে প্রাণ ঢেলে দিলেন ম্যানি ওরফে ইম্যানুয়েল রাজকুমার জুনিয়র। নিজের জন্য নয়, প্রেমিকা, বন্ধু কিজির ইচ্ছাপূরণ করতেই শুরু ম্যানির পথ চলা। '' আমিও অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখি, তবে সেগুলো পূরণ করতে ইচ্ছা করে না'', কিজির বাবাকে একথাই বলে ছিল সুশান্ত, থুরি ম্যানি।
হ্যাঁ, ছবি দেখতে দেখতে ঠিক এভাবেই সবকিছু গুলিয়েই যায়। ম্যানির জীবন মিশে যাবে সুশান্তের সঙ্গেই। 'আমিও একজন অ্যস্ট্রনট, আগামী সপ্তাহেই নাসা যাচ্ছি', এই কথাগুলো কিজি বসুর মা কে মজা করেই বলছিল ম্যানি। এই জায়গাতে এসেও আবারও গুলিয়ে গেল, ম্যানি নাকি সুশান্ত? সুশান্তও তো ঠিক এমনটাই চেয়েছিলেন? এটাই ভাবছেন তো? চাঁদে জমি কেনা, নাসাতে গিয়ে ট্রেনিং নেওয়া, নিয়মিত টেলিস্কোপ দিয়ে তারা দেখতো সুশান্ত।
'কিজি আর ম্যানি'র গল্প মিষ্টি, আবেগঘন একটা স্বল্প সময়ের প্রেমের গল্প। তবে এই স্বল্প সময়ে কীভাবে দাপিয়ে বেড়ানো যায়, জীবনকে উপভোগ করে বেঁচে নেওয়া যায়, যেতে যেতে তা আরও একবার শিখিয়ে গেলেন সুশান্ত। সত্যিই তো ''জন্ম কবে, মৃত্যু কবে, তা আমরা ঠিক করতে পারি না, তবে কীভাবে বাঁচবে সেটা আমরা ঠিক করতে পারি''। 'দিল বেচারা'র গল্প এমন একটা গল্প যেখানে কিজি ও ম্যানি জানে যে, মৃত্যু তাঁদের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ছে। তবু সেই কড়া নাড়ার শব্দকে এড়িয়ে জীবনে কীভাবে বেঁচে নিতে হয়, তা শিখিয়ে গেলেন ম্যানি। ছবির শেষের দিকে চিঠিতে ম্যানির লেখা '' ইয়ে রাজা তো মর গ্যায়া, পর মেরি রানি আভি জিন্দা হ্যায়, আর তবতক মেরি কাহানি ভি জিন্দা হ্যায়''। এই ডায়ালগটাতেও যেন বাস্তবের সঙ্গে অদ্ভুত মিল। মনে হল, তাই তো সুশান্তের রানি, প্রেমিকা তো এখনও আছেন, আর তিনিও হয়ত সুশান্তের এই ছবি দেখছেন...। ছবি শেষে কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভাবতে ভাবতে মনে হয়, সুশান্তও কি তাঁর জীবনে শেষটা জানতেন? কীভাবে সবকিছু এভাবে বাস্তবের সঙ্গে মিলে যেতে পারে? এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা অবশ্য বৃথা। তবে শেষ বেলায় এটা নিজের মুখেই অস্ফুটে যেন বেরিয়ে যায় It's Not Seri Sushant...
'ছিছোঁড়ে'-র পর আবারও একবার 'দিল বেচারা'তেও জীবনের গল্প বলে গেলেন সুশান্ত। গোটা ছবিতে আরও একবার জীবন্ত হয়ে উঠলেন তিনি। বারাবর বাঁচতে শিখিয়ে যাওয়া ছেলেটা কীভাবে নিজেই চলে যেতে পারে? প্রশ্নটা যেন মনের থেকে কিছুতেই যেতে চায় না...।
যাইহোক, সুশান্ত সিং রাজপুতের পাশাপাশি ছবিতে অনবদ্য কিজি বসু ওরফে সঞ্জনা সঙ্ঘীও অনবদ্য। 'রকস্টার', 'হিন্দি মিডিয়াম'-এর সেই ছোট্ট সঞ্জনা যে বয়স বাড়ার সঙ্গে অভিনয়েও যে পরিণত তা 'দিল বেচারা'তে বেশ বোঝা গেল। সুশান্তময় এই ছবির পরও আলাদা করে দর্শকদের মনে দাগ কাটলেন সঞ্জনা। যে 'দিলা বেচারা' তিনি যে তাঁর আগের মন ছুঁয়ে যায় কিজির মা-বাবার ভূমিকায় স্বস্তিকা মুখোপাধ্য়ায় ও শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়। ঠিক যেমনটা মেয়ের প্রতি যত্নশীল, চিন্তাশীল, সচেতন মধ্যবিত্ত বাঙালি মা, বাবা হয়ে থাকেন, ওনারও ঠিক তেমনটাই। বলাই বহুল্য ছবিটিকে পূর্ণতা দিতে তাঁদের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। অতিথি শিল্পীর ভূমিকায় নজর কেড়েছে সইফ আলি খান। ছবির সঙ্গে মন ছুঁয়ে যায় এ আর রহমান-এর করা মিউজিক। ছবিতে সিনেমাটোগ্রাফিও যে দুর্দান্ত তা বলাইবাহুল্য। চিত্রনাট্য ছোটখাটো কিছু ফাঁক রয়েছে ঠিকই। তবে সবকিছুই ঢাকা পড়ে গিয়েছে হাসি-কান্না-মজা-ঠাট্টায় মেশা 'দিল বেচারা'য় উঠে আসা জীবনের গল্পে।