নিজস্ব প্রতিবেদন: তখন বাংলা সিনেমায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন রথী-মহারথী, 'পরশ পাথর'-এর জন্য একটা ছাপোষা মুখকেই বেছে নিয়েছিলেন সত্যজিত্ রায়। তুলসী চক্রবর্তী ছাড়া 'পরশপাথর' তো ভাবাই যায় না! কালজয়ী পরিচালক মনে করতেন, তুলসী চক্রবর্তী ভারতের মরিস শিভ্যালিয়র। ছবি বিশ্বাস তো বলেছিলেন,''বিদেশে জন্মালে তুলসী চক্রবর্তী একটা অস্কার পেতেনই।'' 


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

কেতা নেই। আলু-থালু জামা-কাপড়। অত্যন্ত সাধারণ চেহারা। অথচ যে কোনও চরিত্রকে জীবন্ত করে তোলার অনবদ্য নৈপুণ্য। বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগের ইতিহাস তুলসী চক্রবর্তীকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। ভাবুন খালি, 'সাড়ে চুয়াত্তর'। তুলসী চক্রবর্তী ছাড়া কেউ পারতেন! সত্যজিত্ রায়ের 'পরশপাথর'। পরেশ দত্তের ভূমিকায় তাঁর অভিনয়ে খুঁত ধরার অবকাশ নেই।


বিদেশি অভিনেতার সঙ্গে তাঁর তুলনা হতো, অথচ মানুষটার নিপাট ভদ্রলোক। চরম অর্থকষ্টেও অতিরিক্ত পারিশ্রমিক নেননি। উত্তর কুমার তাঁর জন্য ৩০০ টাকা পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তুলসীবাবু নিয়েছিলেন, তাঁর প্রাপ্য পারিশ্রমিক ১২৫ টাকা। তরুণ কুমার স্মৃতিচারণা করেছিলেন, ১৯৫৭ সালে 'অবাক পৃথিবী'তে মুদির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। তাঁকে ডাকতে বাড়িতে পাঠানো হয়েছিল ট্যাক্সি। কিন্তু ট্যাক্সিতে বসেননি। বরং হাওড়া থেকে ট্রামে এসেছিলেন টলিপাড়ায়। একবেলা কাজ করে ৩০০ টাকা পারিশ্রমিক নিতেও অস্বীকার করেন তুলসীবাবু। তাঁর প্রাপ্য ১২৫ টাকাই নিয়েছিলেন। 


শোনা যায়, সত্যজিতের প্রথম ছবি 'পথের পাঁচালি'তে অভিনয় করেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। 'পরশ পাথর' ছবির জন্য তুলসীকে বেছে নিয়েছিলেন পরিচালক। ছবিতে মূল ভূমিকায় থাকলেও অত্যন্ত কম পারিশ্রমিক চেয়েছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। তাঁর হাতে কাজ নেই। কিন্তু কম টাকায় তাঁর মতো অভিনেতাকে কাজ করাতে চাননি পরিচালক। তুলসীবাবু পেয়েছিলেন ১৫০০ টাকা। আজকাল যা দুর্লভ! অভিনেতাকে যোগ্য সম্মান দিতে কার্পণ্য করেননি পরিচালক। এজন্যই হয়তো তুলসী চক্রবর্তী, সত্যজিত রায়রা রয়ে গিয়েছেন। 


প্রচারসর্বস্ব দুনিয়ায় একেবারেই বেমানান তুলসী চক্রবর্তী। 'পরশপাথর'-এর  সময় শহরের রাস্তায় বড় বড় পোস্টার দেখে অভিনেতা নিজেই বলেছিলেন, 'এ আমি কি হনু হয়ে গেলাম!' তুলসী চক্রবর্তীকে নিয়ে উত্তম কুমার বলেছিলেন,''তুলসীদার মতো অভিনয় কোনওদিনই পারব না। ওনার মতো জীবন্ত হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। ওনার ঋণ শোধ  করার পথ একটাই। যখনই কাজ পাই পরিচালক, প্রযোজককে বলে ওনাকে ডেকে নিই।'' মহানায়ক, সত্যজিত্ রায়ের মতো ব্যক্তিত্বরা প্রশংসা করছেন, অথচ মাটির মানুষ তুলসী চক্রবর্তী বলতেন,''এটা করতে অভিনয় দরকার হয় না। চারপাশেই তো কত লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাউকে কাঁধে বসিয়ে নিলেই হয়!'' ট্রামে যাতায়াত করতেন বলেই বোধহয় মানুষের স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততা এতটা ভালো পর্যবেক্ষণ করতে পারতেন। সে কারণে এতটা সাবলীল হয়ে উঠত অভিনয়! তুলসী চক্রবর্তীর কাছে যা ছিল,'জলভাত', খোদ মহানায়কের কাছেও তা কঠিন।  


স্বামী-স্ত্রীর সংসার হলেও চরম অর্থকষ্টে দিন কাটত তুলসী চক্রবর্তীর। টাকা জোগাড়ে মাঝে মাঝে পুরোহিতের কাজও করে নিতেন। এমনকি তাঁর চিকিত্সার জন্য অর্থ সংকটও দেখা দিয়েছিল। ১৯৬১ সালের ১১ ডিসেম্বর ইহলোকের মায়া কাটান তুলসী চক্রবর্তী। এত কম পয়সায় কাজ করতেন যে জমাতে পারেননি। স্ত্রী ঊষারানি স্বামীর মেডেল বিক্রি করে অর্থের জোগাড় করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর শেষ শ্রদ্ধার ব্যবস্থাও ছিল না। অবশ্য বেঁচে থাকতেও এসবের ধার ধারতেন না তুলসী চক্রবর্তী। সাহিত্যিক শংকর 'মানব সাগর তীরে' বইতে লিখেছেন,''যদি তুলসী চক্রবর্তী, রবি ঘোষ, নৃপতি চ্যাটার্জির মতো অভিনেতা বিদেশে জন্মাতেন, তাঁদের স্মরণে এক-একটা সরণি থাকত।'' তবে বাংলা সিনেমা, বাংলা ভাষা যত দিন বেঁচে থাকবে ততদিন বাঙালির হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন তুলসী চক্রবর্তীরা।                 



 



১৮৯৯ সালের ৩ মার্চ কৃষ্ণনগরের গোয়ারিতে জন্মেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। বাবার অকালমৃত্যুর পর জ্যাঠা প্রসাদ চক্রবর্তীর বাড়ি জোড়াসাঁকোয় চলে আসেন। জ্যাঠার নাটকের দলে যোগ দিলেন। সেই দলে কীর্তন ও শ্যামাসংগীত গাইতেন তুলসী চক্রবর্তী। এরপর মদের দোকানে ওয়েটার, তারপর ঘড়ি সারাইয়ের দোকানে কাজ করেছেন। বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলেন বর্মায়। সেখান থেকে ফিরে ছাপাখানায় কম্পোজিটরের কাজ জোটালেন। তখনই থিয়েটারের হ্যান্ডবিল ও পোস্টার দেখে অভিনেতা হতে ইচ্ছে হল তাঁর। ৩২ টাকার মাইনের কাজ ছেড়ে স্টারে যোগ দিলেন ৮ টাকায়। হিরে চিনতে ভুল হয়নি স্টার থিয়েটারের তত্কালীন মালিক অপরেশ মুখোপাধ্যায়ের। ১৯২০ সালে 'দুর্গেশনন্দিনী' নাটকে প্রথম স্টেজে অভিনয় করলেন তুলসী চক্রবর্তী। ১৯২৭ সাল পর্যন্ত স্টার থিয়েটারের থাকার পর যোগ দেন মনমোহন থিয়েটারে। ১৯৩২ সালে নিউ থিয়েটারের 'পুনর্জন্ম' সিনেমায় অভিষেক হয় তাঁর।    


আরও পড়ুন- ব্যক্তিগত সম্পর্ক গুলিয়ে দিচ্ছে রাজনীতি? প্রশ্ন তুলল অনীক দত্তের ছবি