যা চলছে, তাতে `আ মরি` না বলে `ডুবে মরি বাংলা ভাষা` বলতে হবে না তো? ভাবতে হবে
ভাষা আগে তার সাংস্কৃতিক পরিশুদ্ধতা বজায় রাখুক। রুচি সুন্দর হলেই শুচি হবে ভাষা।
নিজস্ব প্রতিবেদন: ভাষাই হল যে কোনও সংস্কৃতির মুকুট। ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতির অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক, আত্মার সম্পর্ক। অথচ এ রাজ্যে, এ ভূখণ্ডে ভাষাই এখন সব চেয়ে লাঞ্ছিত, অবলুণ্ঠিত, অবমানিত। বিশেষ করে রাজনীতিকদের হাতে।
বেশ কিছু দিন ধরেই দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক নেতাদের (Politicians) মুখের ভাষার মান নেমে গিয়েছে। রাজনৈতিক ভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা রাজনৈতিক বিতর্কের জায়গায় চলে আসছে নিম্নমানের ভাষায় ব্যক্তিগত আক্রমণ শানানোর অপসংস্কৃতি।
সেই অপ-ভাষার কুঠুরি থেকে কখনও উঁকি দেয় চড়াম চড়াম ঢাকের বাদ্যি, কখনও উঁকি দেয় গুন্ডামি করার কথা, কখনও নির্বিকার তুই-তোকারি, কখনও বডিশেমিং, কখনও 'বাপ তোলা', কখনও হাত-পা ভেঙে দেওয়ার শাসানি, কখনও 'খেলা হবে'র চাপা অভিব্যক্তি, কখনও 'টুম্পা'র অবনির্মাণ।
সব মিলিয়ে ক্রমশ বিষয়টা এমন জায়গায় পৌঁছচ্ছে যে, আক্রমণের ভাষা ও আওতা যেন বাঁধাধরাচেনা সৌজন্যের ছক থেকে নিত্যই বেরিয়ে পড়ছে এবং ভাব বিনিময়ের স্বাভাবিক সুস্থতাকে দ্রুত অসুস্থ করে তুলছে।
কেন ভাষা নিয়ে আমাদের এই ভাসা-ভাসা আবেগ?
এর এক বিস্তৃত আর্থ-সামাজিক (socio-economic) কারণ আছে। বেশ কয়েক দশক হল আমরা দেখছি, আমাদের বাঙালি ঘরের একটু অবস্থাপন্ন বাবা-মায়েরা পারলেই ছেলেমেয়েকে ইংরেজি মাধ্যমে (english medium) পড়তে দিচ্ছেন। এর ফলে নিজের ভাষার প্রতি নির্ভরতা কমছে, টানও কমছে। এই ইংরেজি-পোষিত প্রজন্ম জলের মতো পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, বাংলা ভাষা না শিখলে তার জীবনে পেশাগত বিন্দুমাত্র ক্ষতি হয় না। বরং ভাসা-ভাসা বাংলা কিন্তু কাজ চালানোর মতো মসৃণ ইংরেজি জানলেই কেল্লা ফতে। এ ভাবে বাংলা ভাষার প্রতি টান রক্ষা করা সত্যিই কঠিন। যাচ্ছেও না। বাংলা ভাষা এখন বাহুল্যের জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে। হলেও হয় না-হলেও হয় গোছের। ফলে স্ব-ভাষার প্রতি যে-মর্যাদাটা সাধারণত থাকার কথা, সেটা লঙ্ঘিত হচ্ছে। সেটা ফিরে পাওয়ার জন্য কোনও তরফেই তাই কোনও সুনির্দিষ্ট চেষ্টা নেই।
আরও পড়ুন: বিনে স্বদেশি ভাষা, মিটে কি আশা
অথচ আশ্চর্যের শুনতে লাগলেও রবিবার ২১ ফেব্রুয়ারি এ রাজ্যের এক বিশিষ্ট রাজনৈতিক মুখ, অতীতে যিনি নিজেই অসংখ্যবার অপভাষা ব্যবহারে অপরিমেয় দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন, তিনি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের (International Mother Language Day) সূত্রে সটান বলে দিলেন, মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করা জরুরি। শুধু তাই নয়, মাতৃভাষার জন্য় যে একদিন কিছু মানুষ শহিদ হয়েছেন, তা জানাতেও ভোলেন না তিনি। এদিকে, তাঁর মুখে এহেন অভিব্যক্তি শুনে রীতিমতো আশ্চর্যই হয়ে গিয়েছে ভুক্তভোগী রাজনৈতিক মহল। এবং তাঁর চরম প্রতিপক্ষ দলের তরফে একজন তাঁর কথায় বেশ খানিকটা আশ্বস্ত হয়েছেন বলেও জানান। তিনি বলেন, (ওই নেতার) মন পরিবর্তন হলে, ভাষা পরিবর্তন হলে সেটা ভালই।
সত্যিই ভাল। কিন্তু পরিবর্তন কি আসবে? মন বা ভাষা কোনওটিতেই কি অদূর ভবিষ্যতে বদল আসবে? সন্দেহ জাগে, কারণ, এই ভাষা দিবসেই এক তুমুল জনপ্রিয় নেত্রী কথাপ্রসঙ্গে তাঁর বিরোধী দলকে হঠাৎ 'নেংটি ইঁদুরে'র সঙ্গে তুলনা করে ফেলেন!
প্রসঙ্গত, এ বছর ভাষাদিবসের থিম-- Fostering Multilingualism for Inclusion in Education and Society। ঠিক এইখানে রসিকের রসিকতাবোধ জেগে উঠতে পারে এই ভেবে যে, যে-ভাষাটা ক্রমশ ভেতরে-ভেতরে শুকিয়েই যাচ্ছে, তার সঙ্গে Multilingualism-কে কোন মন্ত্রে অন্বিত করা যায়? ভাষার স্রোতকে সতেজ ভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে তবে না তার মধ্যে বহুভাষিক আঘ্রাণ মিশবে! আর এটা করতে হলে তো সর্বাগ্রে ভাষাকে পরিস্রুত করতে হবে। কে নেবে সেই গুরুদায়িত্ব।
আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিসরের বাধা ও বিপত্তি ভুলে ভাষা আগে তার সাংস্কৃতিক পরিশুদ্ধতা বজায় রাখুক। রুচি সুন্দর হলেই শুচি হবে ভাষা।
আরও পড়ুন: 'বাংলার নিজের মেয়ে'র কনভয়ের সামনে এখন কামদুনি, পার্কস্ট্রিট