প্রদীপ চক্রবর্ত্তী


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

হা হা হা। হ্যারিকেনের শিখার দিকে তাকিয়ে আকাশ পাতাল এক করে হেসে চলেছেন বড়মাইমা। পাশে বসে দিদিমার চাপা স্বরে মৃদু ধমক। মাসিদের চোখের ইশারা, কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। ভাতের পাতে দাদু গম্ভীর। অন্যদিনের তুলনায় একটু দ্রুতই হাত চলছে তাঁর। যেন খাওয়াটা কোনওরকমে শেষ করতে পারলে বাঁচেন। সাড়ে তিনফুটের আমি অবাক চোখে একবার এদিকে চাইছি, একবার ওদিকে চাইছি। দুই মামাতো ভাইবোন আরও ছোট। এবং আমার থেকেও বেশি ক্লুলেস।...
...দাদু খাওয়া শেষ করে উঠে গেলেন। রান্না ঘরের চৌকাঠ পেরোনোর সময় দেখলাম তাঁর চোখের কোনেও ফিকে হাসি। এদিকে, দাদু বেরোতেই মুহূর্তে সব মেঘ উধাও। আকাশ পরিষ্কার। মাইমার হাসির সংক্রমণ সকলের মুখে। দিদিমা হাসতে হাসতে বললেন, 'অভ্যাস নেই। কেন যে এতগুলো সিদ্ধির বড়া খেলে বউমা..."। ছোট ভাইবোন দুটোও হাসতে শুরু করল। সকলকে হাসতে দেখে। ওরা কিছু বোঝেইনি। আমার মনে তখন প্রশ্ন জাগে। এরা কেন গম্ভীর ছিল? এখনই বা কেন সকলে হাসছে? কিন্তু, বড় মাইমার ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি এমনই। ঝোড়ো বাতাস।


*******************
'দুগ্গা ডুবল?' পাশ থেকে কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলেন এক দিদা (মামাবাড়ির গ্রামে সব বৃদ্ধাই আমার দিদিমা)। 'নাগো ঠাগমা। মুখটা জেগে আছে।' পাশ থেকে উত্তর দিলেন জনৈক মামা (মামার বাড়ির গ্রামে সব তরুণই আমার মামা)।  'কী অলুক্ষুণে কথা। শিগগির ঠাকুরের মুখটা ডোবা। কী অনাছিষ্টি কাণ্ড।'
আমার কানে আসছে শব্দগুলো। কিন্তু, দুগ্গা ভেসে আছেন কি ডুবেছেন, বোঝার উপায় নেই। সাড়ে তিনফুট সাইজ। পুকুর পাড়ে প্রমাণ সাইজের সব পায়ের ভিড়ে আটকে গেছি। হাতটা এক মামার হাতে ধরা। কিন্তু, মানুষের পাঁচিল টপকে ভাসান দেখার উপায় নেই। পুকুর আলোয় আলো। হ্যাজাক নয়, আতশবাজি। দেদার জ্বলছে রংমশাল। ফাটছে পটকা।


আরও পড়ুন- আদর্শ শঙ্কর, দুর্গমকে সুগম করাই প্যাশন অভিযাত্রী অনিন্দ্যর


********************
বিশাল বাড়ি। আমার মামার বাড়ি। পেল্লায় বাঁধানো উঠোন। ঠাকুরের ঘরের সামনে লম্বা দাওয়া। ব্যাচে ব্যাচে খেতে বসছেন বুড়ো থেকে ছুড়ো। নবমীর ভোজ। গ্রামশুদ্ধু লোক খাবে। মামারবাড়ির গৌর নেতাইয়ের ভাণ্ডারা। উঁচ নেই। নীচ নেই। বড় নেই। ছোট নেই। তবে নারী পুরুষের একটা বিভেদ রক্ষা করা হচ্ছে। আলাদা খাওয়ার ব্যবস্থা। ...
...আমার মহানন্দ। ধুতি। ও শার্ট। দাদু পরিয়ে দিয়েছেন। ছুটে চলেছি উঠোনময়। আমার চেয়ে একটু বড় এবং একটু ছোট আরও দুই একজন সঙ্গে রয়েছে। তাদের সঙ্গে ক্যাপ ফাটানোর কম্পিটিশন। পরণে ধুতি।  হাতে পিস্তল। বেশ বিপ্লবী বিপ্লবী ফিলিং (দূরদর্শনে তখন সেই সময় বলে একটা ধারাবাহিক হত) মাঝে মধ্যে অবশ্য ধমকও খাচ্ছি। পরিবেশন করছেন যাঁরা তাঁদের অসুবিধা হচ্ছে তো।


********************
'ঠাকুরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাক। এদিক ওদিক দেখবি না।' কড়া ধমক দিলেন জনৈক মামা। কেন তাকাব ঠাকুরের মুখে? কী দেখা যাবে? মনে প্রশ্ন জাগল। জিজ্ঞেস করার সাহস নেই। (এখন অবশ্য বুঝি জিজ্ঞেস করলেও সঠিক উত্তর পেতাম না।) নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গেই ঠাকুরের মুখের দিকে তাকালাম। তাকাতে তাকাতেই কানফাটা শব্দ। পরপর দুবার। ডাবল ব্যারেল বন্দুক এবং গাদা বন্দুকের ফায়ারিং। সন্ধিক্ষণ। বেজে উঠল ঢাক, কাঁসর, শাঁখ। 'আগে তো কামান দাগা হত। সেদিন গেছে।' জনৈক দাদুর আক্ষেপ শোনা গেল।


********************
'আজ আর পুকুর নয়। বাথরুমে স্নান সেরে নে তাড়াতাড়ি। অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে হবে। সকলের তাড়া আছে। তোরা কেউ দেরি করবি না।' নির্দেশটা আমি ও আমার দুই মামাতো ভাইবোনের প্রতি। পুকুর ছাড়া অন্য কোথাও যে স্নান করা যায়, তাই আমরা বুঝি না। বিশেষ করে ছুটির এই সময়টায়। সকাল ১০ টা থেকে দুপুর একটা। ৩ ঘণ্টার আগে ওঠার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু, অষ্টমীতে আমাদের পুকুরে নিয়ে যাওয়ার কেউ নেই। আমাদের দেশে একটাই জিনিস ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় চলে। ধর্মীয় নির্ঘণ্ট। লগ্ন পেরোলে সাড়ে সব্বোনাশ।   


********************
'দাদু। অসুরটাকে বারবার মারে কেন? ওর কী দোষ?'। দাদু রাশভারী। মহাসপ্তমীতে দুগ্গা দালানে এনেছেন। এই একদিনই তিনি বের হন। গ্রামের বাকি হোমরা চোমরাদের সঙ্গে সৌজন্য সম্ভাষণ চলছে। আমরা তিন ভাইবোন পাশে দাঁড়িয়ে।
'বাইরের অসুর নয়, বুবুন।' দাদু বললেন। 'পুজোর আসল উদ্দেশ্য ভিতরের অসুরটাকে মারা। আমাদের সকলের ভিতরেই একটা করে অসুর থাকে। তাকে মারতেই তো প্রতিবছর পুজো করি।' দাদু বললেন। এর বেশি ব্যাখ্যা দেওয়ার লোক তিনি নন। এর বেশি প্রশ্নের সাহসও আমার নেই। মনের কোনে আর একটা প্রশ্ন জমা হল। 'আমার মধ্যে অসুর আছে? অসুর তো মোষের মধ্যে ছিল। আমি কী মোষ?' ৭ বছরের মস্তিষ্কে এর থেকে বেশি ভাবার শক্তি নেই। আজ বড় হয়ে অবশ্য একমাত্র দাদুর কথাটাই বোধগম্য হয়। পুজোর বাকি উপাচারগুলো এখনও অবোধ্য (অবধ্যও বটে)।  


********************
'বোধন, অধিবাস, আমন্ত্রণ। শিব দালানে বুড়োদের আখড়া। সেখানে মহাষষ্ঠীর মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করে চলেছে বুড়ো ভটচায্যি। আমাদের শোনার ধৈর্য্য বা ইচ্ছে কোনওটাই নেই। ক্যাপ ফাটাতে ফাটাতে ছুটতে ছুটতে কানে এল কথাগুলো। আজ থেকে পুজো শুরু। পড়াশোনার বালাই নেই। তবে কাজ কম নাকি? নতুন জামাটা নোংরা করতে হবে। স্কুলে নতুন যে গালাগালিগুলো শিখেছি তা ছোট মামাতো ভাইটার মস্তিষ্কে ইনস্টল করে দিতে হবে। (এতে আমার প্রতি ওর শ্রদ্ধা আরও বাড়বে বলেই আমার বিশ্বাস।) এবং সকাল থেকে বেলা পর্যন্ত ক্যাপ ফাটিয়ে তারপর পুকুরে ছোটা। দুপুরে খাওয়ার পর ধমক খেয়ে একটু শোয়া। সকলে ঘুমালেই ফের আমি উড়নচণ্ডী।


আরও পড়ুন- আসছে বছর আবার হবে...


********************
'এই নাও তোমার ভাগের ভাগ।' পিস্তলের ক্যাপের একটা বড় প্যাকেট এগিয়ে দিল মামাতো বোন। দাদু কিনেছেন প্যাকেটটা তার ভিতরে ছোট ছোট ১২ টি প্যাকেট। প্রতি প্যাকেটে ১২ টি করে রোল। পিস্তল অবশ্য আমি সঙ্গেই এনেছি। ব্যাগে রয়েছে। আর রয়েছে পুজোর জামাকাপড়। ৬ থেকে ৭ সেট জামাপ্যান্ট হয়েছে। আমার ব্যাগ আমিই গুছিয়ে এনেছি(বাড়ির নিয়ম)। তবে মামার বাড়িতে পৌছতেই ব্যাগ নিয়ে নিল বড়মাইমা। আগামী কদিন কী খাব, কী পড়ব সব তিনি দেখবেন (তখনও আমার আর দুই মাইমা আসেননি। বড়মাইমা সব।)... মামার বাড়ি ভারী মজা।


********************
(পুনশ্চ: হুগলি জেলার এক বর্ধিষ্ণু গ্রামে আমার মামার বাড়ি। জ্ঞান হওয়া থেকে ক্লাস সিক্স পর্যন্ত এই ছিল বাঁধা রুটিন। জামাকাপড় দিতে এসে মেজোমামা সঙ্গে করে নিয়ে যেত। তারপর লক্ষ্মীপুজো কাটিয়ে ফিরতাম।)