সৌমিত্র সেন


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

স্ফুলিঙ্গ সমাদ্দারকে চেনেন? 


হ্যাঁ চেনেন বইকি! 'হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য'-র কবিকে চেনেন না, তা হয় নাকি? ওটি আসলে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ছদ্মনাম। আজ, ২৫ নভেম্বর তাঁর জন্মদিন। ১৯৩৩ সালে ২৪ পরগনার জয়নগরে জন্ম।


হেমন্তের জাতক শক্তিকবিকে স্মরণ করতে গিয়ে এই ভরা হেমন্তে আমরা কি 'হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান' কাব্যগ্রন্থের সমনামেরই কবিতাটিকে কোনও ভাবে ভুলে যেতে পারি? বস্তুত, ওই কবিতাটি দিয়েই তো শুরু হতে পারে যে কোনও শক্তি-স্মরণলেখ-- 
'হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান ঘুরতে দেখেছি অনেক/ তাদের হলুদ ঝুলি ভরে গিয়েছিল ঘাসে আবিল ভেড়ার পেটের মতন'! 'ঘাসে আবিল ভেড়ার পেটের মতন' ঝুলি কি আমাদেরও নেই? জীবনমরণস্বপ্নকামনার চিঠি ভরা বেবাক অন্ধকার ধূসর এক ঝুলি, যার ভার বইতে-বইতেই কেটে যায় আমাদের দিন ও রাত্রি, শরৎ ও শীত; যার ভারে ন্যুব্জ আমরা শ্রান্তিসমাহিত অক্ষুব্ধ বিশ্রামের নিটোল পেটের ভিতরে ঢুকে যেতে-যেতে কবিতাপঙক্তির নির্জনে বসেই একা-একা কাঁদি?


ওই ঝুলি আমাদেরও আছে! না থাকলে আমরা এত চট করে শক্তির মতো দুরূহ এক কবির সঙ্গে 'রিলেট' করে যাই কী ভাবে? তাঁর সব কাব্যগ্রন্থের সব কবিতা পড়ার দরকার কী? বিভিন্ন পাঠকের মনোরসায়নও তো বিভিন্ন। সে তার মতো করে চিনতে শেখে, ক্রমে চিনে নেয় তাঁর নিভৃত কবিকে, নির্জন কবিতাটিকে। আর তখনই সে একদা সিপিআই-সদস্য  শক্তির কথা ভুলে যায়, ভবানীপুর টিউটোরিয়াল হোমের শিক্ষক শক্তিকেও ভোলে এবং শুধুই মনে রাখে আদ্য়ন্ত আবেগদীপ্ত বিষণ্ণমধুর এক কবিকে, যিনি জীবনানন্দ-উত্তর বাংলাকাব্যে অত্যন্ত শক্তিশালী এক কবি বলে চিহ্নিত হয়ে থাকেন। 


১৯৬০ সালে শক্তির প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য'-র প্রকাশ। তবে তাঁর প্রথম কবিতা বেরোয় বুদ্ধদেব বসুর 'কবিতা' পত্রে। যদিও শক্তি মূলত 'কৃত্তিবাস'-এরই কবি হিসেবে পরিচিত হন পাঠকমহলে। এক সময়ে হাংরি আন্দোলনের শরিক হয়ে পড়েছিলেন। পরে তা থেকে সরে আসেন। অস্থিরতা তাঁর চিরদিনেরই। পাহাড়-জঙ্গল তাঁকে বরাবরই নিশির ডাকে টানে। বর্ষামেঘ, কুয়োতলার চাঁদ, হেমন্তের অরণ্য, মোরগঝুঁটি, লাল মাটি, শালবন তাঁকে বারবার জীবনের জটিল কান্না আর বেদনাবহ হাসির শিয়রে রেখে আসে। তিনি সেখান থেকেই তাঁর কবিতা পেয়ে যান আর আমাদের তপ্ত হৃদয়ের ঘরবাড়ির ভিতর আলোড়ন তুলে দেন। তিনি না দেখালে কি আমরা জানতাম 'অনন্ত কুয়োর জলে চাঁদ পড়ে আছে'? তিনি না বললে আমরা 'সে কি জানিত না এমনি দুঃসময়/লাফ মেরে ধরে মোরগের লাল ঝুঁটি' বলে শোক করতে শিখতাম? তিনি না চেনালে আমরা দুয়ার-চেপে-ধরা পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস চিনতাম? রাতেরও যে কল্লোল হয়, তা কি আমরা শাক্তপদাবলি ছাড়া জানতাম?



এ ভাবেই তাঁর পরের পর কাব্যগ্রন্থ বাঙালির মনে ও মননে আলোড়ন এনেছে। 'হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান', 'চতুর্দশপদী কবিতাবলী', 'যেতে পারি কিন্তু কেন যাব' আমাদের বিহ্বল করেছে। অবশ্য শুধু তো কবিতা নয়, তিনি একইসঙ্গে লিখে গিয়েছেন ছড়া, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এমনকি ট্র্যাভলগও! সব কিছু থেকেই কবির দ্যুতি বেরিয়ে আমাদের মগ্ন করেছে। তবুও তাঁর কবিতার নেশা থেকে অব্যাহতি পাইনি আমরা। 'তীরে কি প্রচণ্ড কলরব/জলে ভেসে যায় কার শব/কোথা ছিল বাড়ি?/রাতের কল্লোল শুধু বলে যায়-- আমি স্বেচ্ছাচারী'; 'দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া/কেবল শুনি রাতের কড়া নাড়া/অবনী বাড়ি আছো?' আমাদের হাতে ধরে রাখে। 


কেন এমন হয়?


শক্তি আসলে কবিতায় ভাষা ব্যবহারে, শব্দচয়নে এমন এক অভিঘাত আনেন যার হাত এড়াতে পারে না পাঠক। কোনও কোনও কবিতা-তাত্ত্বিক অভিঘাতময় কবিতা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলে থাকেন, কবি তো আসলে সন্ত্রাসবাদী; ভাষার ভিতরে কী নিপুণ সাবলীলতায় অতর্কিতে অন্তর্ঘাত চালান কবি! শক্তির মতো কবির ক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই তাই। এমন ভাবে তিনি পাঠককে আক্রমণ করেন, এত অতর্কিতে যে, সে পালাতে পথ পায় না, পড়ে 'মার' খায়! অবশ্য সেই আঘাতেও গান ওঠে। ভাষার সুরের মসৃণতা মনকে আবিষ্ট করে। 'দ্য  এস্টেট  অফ পোয়েট্রি' বইতে কবিতা-তাত্ত্বিক এডউইন মিউয়ির কবিতাকে নির্দেশ করেছেন 'সামথিং হাফওয়ে বিটুয়িন মিউজিক অ্য়ান্ড স্পিচ' বলে। শক্তির কবিতা সম্বন্ধে ভীষণ ভীষণ খাটে এই কথা। রলা বার্তও তো তাঁর লেখা কাকে বলে এই মর্মের এক আলোচনায় ভাষাতাত্ত্বিক অলৌকিকতায় পৌঁছনোর কথা বলেছেন! 


কেমন সেই অলৌকিকতা?


অজস্র শাক্ত-উদাহরণ আছে। এখন মাত্র একটি। 'আমাকে জাগাও' কাব্যগ্রন্থের 'এইটুকু তো জীবন' কবিতায়: 'এখানে মানুষকে খুব দৌড়ুতে দেয় না, বারণ করে, কেননা এইটুকু তো জীবন, অতো দৌড়ঝাঁপে আলাদা কী পাবে? জীবন ছাড়া মৃত্যুকে পাবার জন্য তাড়াহুড়োর কোনও অর্থ  হয় না'!


বলেছেন বটে! তাঁর কিন্তু মৃত্যুর জন্য কেমন একটা তাড়াহুড়ো ছিলই। সেই চিহ্নই তাঁর কাব্যসমগ্রে ছড়িয়ে রয়েছে। আমরা খেয়াল করি, অথবা করি না। কিন্তু ঝরাপাতার মধ্যে তাঁর মৃত্যুগান ঠিক শোনা যায়। জন্মদিনেও সেই দুঃখটা ভোলা যায় না!


আরও পড়ুন: ভারী যান উঠলেই মিলবে সংকেত, ডিসেম্বরেই খুলে দেওয়া হচ্ছে মাঝেরহাট ব্রিজ