নির্ণয় ভট্টাচার্য্য, কলকাতা: সন্তান দলের মিছিল। না, রাম নারায়ণ রাম বা বাম নারায়ণ বাম কোনটাই নয়। গতকাল, ২৩শে এপ্রিল যে জমায়েতটা দেখল যাদবপুর এইটবি বাসস্ট্যান্ড তা সুমনের সন্তানদের। কবীর সুমন মানে যেমন কবীরের সন্তান, ঠিক তেমন এঁরাও প্রত্যেকে কবীর সুমনের সন্তান। "তোমাকে চাই" নামক অ্যালবামের ২৫ বছর পূর্তি উদযাপন করতে দুপুর তিনটে-সাড়ে তিনটে নাগাদ এইটবি-তে জড়ো হয়ে পদযাত্রা করে বৈষ্ণবঘাটায় কবীরের বাড়ি অবধি যাওয়ার পরিকল্পনাটা ছিল নেহাত উপলক্ষ্য মাত্র। বা বলা ভাল ছুতো। হ্যাঁ ছুতোই, কারণ এই পথচলা কার্যত হয়ে উঠেছিল এবং হয়ে উঠতে চেয়েছিল বিগত আড়াই দশক ধরে সুমনের সৃষ্টি চেতনার, প্রকাশের এবং অভিব্যক্তির 'স্তন্য পান করে' সুঠাম হয়ে ওঠার সেলিব্রেশন (ক্ষমা করবেন, বারবার 'উদযাপন' শব্দটা লিখতে গিয়ে কেমন একটা বার-ব্রত মনে হচ্ছে, তাই 'সেলিব্রেশন')। পড়ুন- কবীর কথা


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

সামনে, সুমনে সুসজ্জিত ট্যাবেলো। লাউড স্পিকারে বাজছে সুমনের গান। আর সেই গানই মুখে মুখে ফেরা মানুষের গান হয়ে উঠছে পেছনের মিছিলটায়। সকলের, সক্কলের উচ্চারণে-আস্ফালনে-দৃপ্ততায় তখন শুধুই সুমন। অধিকাংশের হাতে ধরা রয়েছে প্ল্যাকার্ড। সে প্ল্যাকার্ডেও সুমনেরই বাণী। হ্যাঁ, বাণীই। কবীর সুমন গানের ক্ষেত্রে 'বাণী'র পরিবর্তে 'কথা' শব্দটিকে যতই পছন্দ করুন না কেন, তাঁর গানের 'কথা' সন্তানদের কাছে আক্ষরিক অর্থেই 'বাণী' হয়ে উঠেছে এই আড়াই দশকে। আর সেই বাণীই লেখা ছিল আকাশ পানে উঁচিয়ে ধরা প্ল্যাকার্ডগুলোতে। গিটার তো ছিলই, একজনকে দেখা গেল মাউথ অর্গান মুখে। লহমায় মনে পড়ে যাচ্ছিল মঞ্চের কবীর সুমনকে। সেই চেনা দৃশ্য, দু'কাঁধ বেয়ে এগিয়ে আসা হোল্ডারে আটকানো মাউথ অর্গান, তিনি বাজাচ্ছেন-গাইছেন, আবার কখনও হোল্ডারটি খানিকটা নামিয়ে নিয়ে কথা বলছেন। এভাবেই চেনা চেনা পথ দিয়ে পায়ে পায়ে এগোচ্ছে মিছিল, পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো করে অগ্রভাগে নাচছেন হিয়া। পথের দু'ধারের মানুষের মুখে স্মিত হাসি, বিজেপি কর্মী বোঝাই আগন্তুক গাড়ির চোখে বিস্ময়! মিছিল চলেছে...সেই খানে হবে দেখা।


অবশেষে গন্তব্যে। দরজায় আছে নম্বর লেখা ১৯/জি। কবীর নিবাস। এবার যেন বাঁধ ভাঙল। সপ্তমে চড়ল গলা। সব আমাদের জন্যে। অবাক তিনি বেড়িয়ে এলেন বাড়ির অন্দর থেকে। শুরু হল "সাড়া দাও, সাড়া দাও..."। তিনিও উদাসীন থাকতে পারলেন না, সাড়া দিলেন সন্তানদের ডাকে। একের পর এক সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। অপত্য স্নেহে আদরে চুমুতে ভরিয়ে দিলেন ঘেমে স্নান চকচকে মুখগুলোকে। তাঁর দুয়ারের সামনেই চেয়ার পেতে বাসানো হল তাঁকে। চারিদিকে সমবেত সন্তানরা, ফুলে-মিষ্টিতে এক পশলা কবীর সম্বর্ধনা, কেক কাটা। আর এসব আনুষ্ঠানিকতায় তিনি যেন কিঞ্চিত কুণ্ঠিত। এদিকে আবার তিনি উতলা হয়ে উঠছেন ছেলেমেয়েদের গরম লাগায়, তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে যাওয়াতে। তবে সেসব দীর্ঘস্থায়ী হল না, সন্ততিদের সঙ্গে জুড়ে দিলেন খোশগল্প। অতীত-বর্তমান-প্রেম-প্রণয়-প্রতিবাদ-'ইনকন্সিসটেন্সি' এবং 'কন্সিসট্যান্টলি' সঙ্গীতের গোলামি, কথা ঘুরতে থাকল এই আবর্তেই। "তোমাকে চাই" রেডিওতে সম্প্রচারিত না হয়েও কীভাবে এই বিপুল জনপ্রিয়তা পেল তা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজনের কথাও উল্লেখ করলেন কবীর। তবে এসবই ছিল আনুষাঙ্গিক, ২৩শের সন্ধ্যায় সুমনের মোকামটি ছিল অন্য গতে বাঁধা। এই শুভদিনে সকলে যেমন এসেছেন 'পিতার সদনে', পিতাও তেমন তাঁর বলা সব কথার নির্যাস দিয়ে আসলে উত্তর প্রজন্মকে পথ চেনাতে চেয়েছেন। এই দুনিয়াকে তিনি যেভাবে চিনেছেন তার এক আঁজলা বিবরণ তিনি দিয়েছেন সন্তানদের। অবশেষে বলেছেন, প্রেমই বোধ হয় একমাত্র পারে এই দুনিয়াকে সঠিক পথ দেখাতে। নিজেকে বারংবার 'প্রবলেমেটিক ইন্ডিভিজুয়্যাল' হিসাবে চিনতে পারা এই সুমন তাঁর ছেলেমেয়েদেরকে দিয়ে যেতে চান বাঁচার সুমন্ত্রনা। অস্ফুটে যেন বলে ওঠেন, "প্রবলেমেটিক ইন্ডিভিজ্যুয়াল হয়ে ওঠ"। রাস্তায় বসে সন্তান সন্ততিরা ঘিরে রয়েছেন তাঁকে, তিনি অনর্গল বলে চলেছেন...মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করছেন...হঠাৎ একটা ঠাট্টা শুনে হেসে উঠছেন...আর দূর থেকে থেকে গোটা দৃশ্যটা দেখে মনে হচ্ছে- ওই তো লক্ষ ছেলেমেয়ে নানি নাতনি দামাল, সবুজদ্বীপের মতো মাঝখানে...